খড়কুটোতে ছাওয়া মেটো ঘরের মেঝেতে
খেজুর পাতার একখানা পাটি বিছিয়ে,
এক হাতের বাহুতে মাথা রেখে
অন্য হাত বুকে পিঠে মাথার চুলে বুলাতো।
আমার ঘুম না এলে,
রুপ কথা চাঁদের বুড়ি আর সাত রাজার গল্প শোনাতো।
ছোট্ট ছোট্ট করে মৃদু সুরে ছাড়া কিম্বা গান শুনিয়ে,
অনায়সে দুচোখের পাতা বুঁজিয়ে দিতো।
আমি একুশে শ্রাবণে এসেছি ধরণীতলে,
তাই বাবা আমাকে শ্রাবণ বলেই ডাকে।
আর মা আমাকে আদর করে ডাকে খোকা বলে।
কারণে অকারণে ক্ষণে ক্ষণে ডাকতো মা
খোকা মণি, কোথায় আমার খোকা!
আমি যেখানেই থাকি,
সেখান থেকেই সাড়া দিতাম, বলতাম জি!
দৌড়ে এসে লাফিয়ে পড়তাম মায়ের কোলে।
দুই হাতে উঁচু করে চুমু দিতো সারা গায়ে,
বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে
বলতো, ওরে আমার কলিজার টুকরো রে!
কোথায় ছিলে? খিদে লাগেনাই! চলো খাবে!
সেই যে কখন খেয়েছে!
আর খাওয়ার কোনো নাম চিন্তা নাই মুখে!
ছোট্ট একটা থালে একমুঠো ভাতের সাথে
ভর্তাভাজি কিছু হবে।
ছোট ছোট ভাতের দলা করে
তুলে দিতো আমার মুখে।
আমি খেতে চাইতাম না বলে,
কোলে বসিয়ে সারা পাড়া ঘুরিয়ে
এটা সেটা দেখিয়ে কতকিছু বুঝিয়ে
খাওয়াছেন পেট ভরে।
আজো মাঝে মাঝে মনে হয়
মা যেনো দূরে কোথাও বসে
মাছের কাটা বেছে একমঠো ভাত নিয়ে
আমাকে খোকা বলে ডাকছে।
আয় খোকা আয়,
আর এক দলা আছে, খেয়ে নে!
বড় অভাবের সংসার,
তিন বেলায় ভাত জোটে দুইবার।
নিজে না খেয়ে বাবাকে না খাওয়ায়ে
প্রয়োজনে অন্যের থেকে করেছে ধার।
তবুও অভাব কি জিনিস সেটা বুঝতে দেয়নি আমার।
একদিন চৈত্রের দুপুরে
বাবা যখন কামলা খেটে ফিরলেন বাড়ি।
আমার খাওয়া দেখে,
হাতমুখ ধুয়ে আমার পাশে বাবু দিয়ে বসেছিলেন তিনি।
কতো খুশি মুখ তার মায়ের কাছে করেছিলো আব্দার,
কোই রে, খেতে দাও, খুব খিদে লেগেছে আমার।
সেই রাতে! একমুঠো খেয়েছি ডাল দিয়ে,
আর সারাবেলা দানা পড়েনি পেটে।
বাবার কান্ড দেখে মা আচলে মুখটা চেপে,
নয়নের নোনা জল ঝরিয়ে কাঁদছিলো নিরবে।
তখন বাবা ধমক দিয়ে বলে
আমার কথা কি কানে যায়?
আর সহেনা দেরি মরি খিদের জ্বালায়।
মা আঁচলে নয়ন মুছে মৃদু সুরে বলে, ঘরে
খাবার নায়।
বাবা শুকনো মুখ কালো করে বলে,
সকালে যে টাকা দিলাম চাল কিনতে?
মা বলে সেটাতো খোকার স্কুলে লেগেছে।
মায়ের মতন এমন আপন ধরণীতলে কে?
মা যে আমার স্বর্গ নরক খোদা রি পরে।
আপন আপন সবাই বলে স্বার্থ মিটাইলে।
মা আমাকে নিজ হাতে গোছল করিয়ে
সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে আসতো স্কুলে।
নিজে ছেঁড়া শাড়ি পড়ে
আমার গায়ে নতুন নতুন পোশাক দিয়ে বলতো
আমার লক্ষী ছেলে, অনেক বড় হবে
কতো বড় চাকরি করবে,
কতো টাকা কামাবে,
আমার খোকা যখন আমার জন্য দামি শাড়ি আনবে
বাজার থেকে খাঁসির গোস আনবে
বড় বড় মাছ কিনবে।
তখন আমি সারা পাড়ার লোকের দেখিয়ে বলবো,
দেখো দেখো আমার খোকা,
আমার জন্য কতো কিছু এনেছে!
তখন আমি গর্ব করে বলবো,
এমন একটা ছেলে আর কয়জনার আছে?
মাগো, তোমার খোকা আজ অনেক বড় হয়েছে,
কামিয়েছে কতো টাকা!
কতো বড় বাড়ি তার কতো একর জায়গা।
দেখো মা, তোমার খোকা তোমার জন্য খাসির গোস্ত, রুইমাছের মাথা
আরো হরেক রকমের খাবার সাজিয়ে করছে অপেক্ষা।
আমার মা, খাবে! পেট ভরে খাবে।
আর আমি দুচোখ ভরে দেখব মায়ের খাওয়া।
কতো দিন তোমার হাতের মাখানো ভাত খায় না!
মা, মাগো! একবার উঠে চোখ মেলে দেখো!
আমি তোমার সেই আদরের একমাত্র খোকা।
যার চোখের একফোঁটা অশ্রুজল ছিলো মুল্যবান পান্না।
সেই পান্না আজ অঝোরে ঝড়ছে
না পেয়ে তোমার দেখা।
আমার মা, আমাকে খাওয়ে নিজে না খেয়ে
ঘুমিয়ে আছে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে।,,,সংক্ষিপ্ত