(০১)
অমানুষ
-বিচিত্র কুমার

তুমি কি মানুষ? নাকি অন্ধকারের পুতুল?
তোমার চোখের তারায় কি থাকে কোনো নক্ষত্রের স্বপ্ন?
নাকি শূন্যতার গভীরে হারিয়ে যাওয়া এক অদৃশ্য কালো গর্ত?
তোমার হাসি কি এক ঝর্ণার মৃদু কলতান?
নাকি তীক্ষ্ণ কাঁচ ভাঙার শব্দ, যা প্রতিটি হৃদয়কে করে ক্ষতবিক্ষত?

তোমার অস্তিত্ব কি প্রকৃতির গভীরতার মতো নিঃশব্দ?
নাকি বজ্রপাতের মতো বিধ্বংসী, যা উড়িয়ে দেয় জীবনের সবুজ পাতাগুলি?
তোমার প্রতিটি পা কি ছুঁয়ে যায় কোনো ভালোবাসার বীজ?
নাকি জমাট বাধা রক্তের পথ, যা পেছনে রেখে যায় শূন্যতা?

তুমি কি জানো কীভাবে একটি বৃক্ষ জন্মায়?
প্রতিটি শেকড়ে ছুঁয়ে যায় জমিনের মায়া।
তুমি কি জানো কীভাবে একটি পাখি গান গায়?
তোমার শ্বাসে কি কখনো অনুভব করেছ তার সুরের নীলিমা?
নাকি কেবল শিখেছ পাখির ডানার রঙ কেড়ে নেওয়া?

তুমি কি অনুভব করো সময়ের অনন্ত প্রবাহ?
যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে লুকিয়ে থাকে অশ্রুর গল্প।
তোমার হৃদয় কি জানে সেই স্রোতের ভাষা?
নাকি তা পাথর হয়ে আছে, যেখানে ঢেউ এসে ফিরে যায় পরাজিত?

অমানুষ, তোমার কি কোনো আয়না আছে?
যেখানে তুমি নিজেকে দেখো, নিজের চোখের অন্ধকার?
তোমার মনের গহীনে কি জ্বলছে কোনো আলো?
নাকি কেবল ছায়ার মায়াজালে বোনা এক অসীম শূন্যতা?

তোমার স্মৃতিতে কি বাস করে কোনো ভালোবাসার গল্প?
নাকি প্রতিটি অধ্যায়ে লেখা আছে বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া?
তুমি কি জানো, প্রতিটি ফুল ফোটে তার নিজস্ব ব্যথা নিয়ে?
তোমার অন্তর কি কোনো ফুলকে ভালোবাসতে শিখেছে?
নাকি তার রঙ কেড়ে তাকে মৃত শাখায় ঝুলিয়ে রাখে?

তুমি কি কখনো অনুভব করেছো শিশুর হাসির উষ্ণতা?
নাকি সেই হাসি চুরি করে তাকে ছেড়ে দিয়েছ শীতল অন্ধকারে?
তুমি কি কখনো দেখেছ বৃদ্ধের চোখে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা?
নাকি কেবল শুনেছো তার নীরব আর্তনাদ?

অমানুষ, তোমার অস্তিত্বের মূল্য কোথায়?
তুমি কি এক সূর্য, যে আলো ছড়ায়?
নাকি সেই শুক্রতারা, যা সকালে বিলীন হয়ে যায়?
তোমার ছায়ায় কি বেড়ে ওঠে আশার বৃক্ষ?
নাকি কেবল বিষাক্ত লতায় ছেয়ে যায় চারপাশ?

তোমার পথ কি শুধুই ধ্বংসের?
তুমি কি কেবল জানো পোড়ানো, ভাঙা আর ছিন্ন করার শিল্প?
নাকি কখনো শিখেছো নতুন কিছু গড়তে,
একটি জীবন, একটি ভালোবাসা, একটি স্বপ্ন?

অমানুষ, তুমি কি মানুষ হওয়ার গল্প জানো?
মানুষ হওয়া মানে প্রতিটি ব্যথা থেকে নতুন জীবন তৈরি করা।
মানুষ হওয়া মানে আঁধারের গভীরে দাঁড়িয়ে আলো জ্বালানোর প্রতিজ্ঞা।
তুমি কি জানো,
যে পাথর ছোঁড়ে, সে কখনো ফুল ফোটাতে পারে না।
তুমি কি জানো,
যে রক্ত ঝরায়, সে কখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারে না।

অমানুষ,
তোমার মুখোশ খুলে দেখাও,
তোমার ভেতরের শূন্যতা আর অন্ধকার।
তুমি কি জানো,
অমানুষ হয়ে বাঁচা মানে নিজের মরণের আগেই মরতে শেখা।

মানুষ হও!
একটি অশ্রু থেকে জন্ম দাও ভালোবাসার সমুদ্র।
একটি শূন্যতা থেকে তৈরি করো এক নতুন পৃথিবী।
মানুষ হও!
কারণ প্রকৃতি ক্ষমা করতে জানে,
কিন্তু অমানুষের আত্মা কখনো শান্তি খুঁজে পায় না।

(০২)
অধম ও উত্তম
-বিচিত্র কুমার

অধম কে?
সে কি এক ক্ষুদ্র কণা, সময়ের স্রোতে বিলীন?
নাকি তার হৃদয়ে বসত করে এক অন্ধ মেঘের দল?
উত্তম কে?
সে কি মহাসমুদ্র, যার প্রতিটি ঢেউয়ে লুকিয়ে থাকে জীবনের জাগরণ?
নাকি সে এক পাহাড়, যে ঝড়ের মুখেও মাথা তুলে দাঁড়ায়?

অধম দেখে দিগন্তের পাড়,
সে ভাবে, "এখানেই শেষ।"
তার চোখে দিগন্ত এক দেয়াল,
যা পার হওয়া অসম্ভব।
উত্তম তাকায় সেই একই দিগন্তে,
সে বলে, "এ তো শুরু, এখান থেকেই আকাশ ছোঁয়ার যাত্রা শুরু হবে।"

অধম হাঁটে অভিমানের ছায়ায়,
তার প্রতিটি পদক্ষেপ ভারী হয়ে পড়ে নিজেরই দুঃখে।
সে ভাবে, "পৃথিবী আমার শত্রু।"
উত্তম হাঁটে সাহসের আলোয়,
তার প্রতিটি পদক্ষেপ এক নতুন গল্পের সূচনা।
সে বলে, "পৃথিবী আমার বন্ধু।"

অধম ভালোবাসে কেবল নিজের প্রতিচ্ছবি,
সে দাঁড়ায় আয়নার সামনে আর দেখে নিজেকে।
তার ভালোবাসা সীমাবদ্ধ, সংকীর্ণ, আর বন্দি।
উত্তম ভালোবাসে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণকে,
তার ভালোবাসা বয়ে চলে বাতাসের মতো, ছড়িয়ে যায় দূর অজানায়।

অধম যখন কাঁদে,
তার অশ্রু হয়ে ওঠে করুণার নদী,
যে নদী কেবল নিজেকে ধুয়ে নিয়ে যায় শূন্যে।
উত্তম যখন কাঁদে,
তার অশ্রু হয়ে ওঠে পবিত্র জলধারা,
যে জল দিয়ে সে শুষে নেয় পৃথিবীর বেদনা।

অধম যুদ্ধে যায় তার ক্ষুধার জন্য,
তার অস্ত্র তৃষ্ণার্ত,
তার যাত্রা শুধুই লুটপাটের পথে।
উত্তম যুদ্ধে যায় সত্যের জয়গান করতে,
তার অস্ত্র শান্তির রূপকথা,
তার যাত্রা এক নতুন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে।

অধমের জীবনে রাত মানে এক চিরন্তন অন্ধকার,
যেখানে তার মন বুঁদ হয়ে থাকে কষ্টের ছায়ায়।
তার কাছে তারা মানে জ্বলন্ত ফোঁটা,
আর চাঁদ মানে এক শীতল পাথর।
উত্তমের জীবনে রাত মানে বিশ্রামের মৃদু গান,
তার তারা মানে আশার মশাল,
আর চাঁদ তার কাছে প্রেরণার সঙ্গী।

অধমের হৃদয়ে জমা থাকে অভিশাপ,
তার প্রতিটি কথায় ফুটে ওঠে অবিশ্বাস আর হিংসা।
উত্তমের হৃদয়ে ফুটে ওঠে কুসুম,
তার প্রতিটি বাক্যে মিশে থাকে মায়া আর সহানুভূতির সুবাস।

অধম ও উত্তম—
দুজনেই জন্মায় এক মাটিতে,
তবু একজন নিজের শিকড় কেটে ফেলে,
অন্যজন শিকড়ে জল ঢেলে বড় করে জীবন।
অধম সময়কে দোষ দেয়,
সে বলে, "আমার ভাগ্যই খারাপ।"
উত্তম বলে, "ভাগ্য আমি নিজেই গড়ব,
পাহাড় ভাঙব, সমুদ্র পাড়ি দেব।"

জীবন তাদের একই দিক থেকে ডাক দেয়,
তবু অধম পেছন ফিরে পালায়,
আর উত্তম এগিয়ে চলে বুক ভরা সাহস নিয়ে।
অধমের পৃথিবী ছোট, একটুকরো ছায়ায় বন্দি।
উত্তমের পৃথিবী বিশাল, আকাশ আর সূর্যের আলোয় ভরা।

তাহলে তুমি কে হবে?
অধমের মতো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে?
নাকি উত্তমের মতো আলো ছড়িয়ে এগিয়ে যাবে?

(০৩)
জীবনের গল্প
-বিচিত্র কুমার

জীবন এক অমৃত কাব্য, যার প্রতিটি ছত্রে লুকিয়ে থাকে তৃষ্ণার চিরকালীন রূপ।
সে যেনো এক প্রাচীন অরণ্য, যার প্রতিটি বৃক্ষ ইতিহাসের সাক্ষী,
যেখানে পাতার ফাঁকে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়লেও পৌঁছায় না তলায়।
জীবন এক শিকল, যা শৃঙ্খলা আনে, কিন্তু বেঁধে ফেলে নিজস্ব অন্তরালের অন্ধকারে।

জীবন এক নদীর মোহনা,
যেখানে এসে মিলিত হয় আশা, বেদনা, আর অপরিসীম প্রতীক্ষার স্রোত।
সে এক বেহালার তার,
যার সুর মন ভাঙে, কিন্তু অন্তর্গত ব্যথার কথা বলে না।
জীবন এক প্রাচীন মন্দির,
যার প্রতিটি ভাস্কর্যে জড়ানো আছে হাজারো প্রার্থনা,
কিন্তু দেবতা হয়তো কেবল নীরব।

জীবন এক চাঁদের জোছনা,
যা মুগ্ধ করে, অথচ নিজের আলোয় গলে যায় প্রতিমুহূর্তে।
জীবন এক ঘূর্ণিঝড়,
যা ভেঙে দেয় সবকিছু, আবার তৈরি করে নতুন রূপ।
জীবন এক পাহাড়ের চূড়া,
যা ছুঁতে চায় মন, কিন্তু শ্বাস নিতে হয় মাঝপথেই।

জীবন এক দিগন্তের শেষে বসে থাকা ক্লান্ত বিকেল,
যেখানে আকাশের রঙ মিশে যায় অন্ধকারের সঙ্গে।
জীবন এক প্রাচীন বই,
যার প্রতিটি পৃষ্ঠায় অক্ষর ধূলি হয়ে উড়ে যায়, কিন্তু গল্প থেকে যায়।
জীবন এক উড়ন্ত ঘুড়ি,
যার সুতোটা শক্ত হাতে ধরা, তবুও হাওয়ার ইচ্ছায় মিশে যায় আকাশে।

জীবন এক জলের আয়না,
যেখানে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, কিন্তু স্পর্শ করতে গেলেই তা ভেঙে যায়।
জীবন এক নক্ষত্রপথ,
যা অসীম, কিন্তু পথ দেখাতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
জীবন এক কবি,
যার প্রতিটি শব্দে মিশে থাকে কালের ছাপ, অথচ পাঠ শেষে কেউ তাকে মনে রাখে না।

জীবন এক খরস্রোতা নদী,
যা গর্জনে ভরিয়ে দেয় চারপাশ, কিন্তু গভীরেই মিশে থাকে তার নীরবতা।
জীবন এক দহন,
যার তাপে সবকিছু গলে যায়, অথচ ছাইয়ে লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনার বীজ।
জীবন এক অগ্নিকুণ্ড,
যেখানে পুড়ে যায় অহংকার, কিন্তু জন্ম নেয় নতুন আলো।

জীবন এক গুহার চুপচাপ ভেতর,
যেখানে অন্ধকার আছে, কিন্তু ছায়া নেই,
শব্দ আছে, কিন্তু প্রতিধ্বনি নেই।
জীবন এক সেতু,
যা ভেঙে পড়ে ক্লান্ত পথিকের ভারে,
তবুও সেই পথিক জানে, তার ওপারেই হয়তো মুক্তি।

জীবন এক শূন্যতার আরাধনা,
যেখানে পূর্ণতার জন্য কাতর হয়ে ওঠে প্রতিটি মুহূর্ত।
জীবন এক আঁধারের সূচনা,
যার প্রতিটি বিন্দু আলো খুঁজতে খুঁজতে নিজেই অন্ধ হয়ে যায়।
জীবন এক আকাশভরা বৃষ্টি,
যা শীতল করে, আবার ভেজায় হৃদয়ের গভীর বেদনায়।

জীবনের গল্প শেষ হয় না,
কারণ সে এক অনন্ত ক্যানভাস, যেখানে আঁকেন অদৃশ্য শিল্পী।
তাঁর তুলি মিশে থাকে আমাদের রক্তে,
তাঁর ক্যানভাস ছুঁয়ে থাকে আমাদের শ্বাসে।
জীবন একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক,
তাকে মাপার চেষ্টা করাই হয়তো আমাদের চিরন্তন ব্যর্থতা।

(০৪)
সিঁড়ি

সিঁড়ি—একটি বৃত্ত, যেখানে শুরু আর শেষ একসাথে মিলেমিশে থাকে,
যেন প্রবাহিত নদী, যার কিনারা অনন্তকাল পর্যন্ত অদৃশ্য।
প্রথম ধাপে পা রাখা যেন বিশাল পর্বতের চূড়ায় ওঠার প্রত্যাশা,
পাথরের মতো কঠিন, অন্ধকারে ডুবে থাকা, একাকিত্বের ঢেউয়ে হেলানো।

প্রথম ধাপটি যেন ভাঙা স্বপ্নের টুকরো—
জীবনের শূন্যতার মতো হালকা, কিন্তু ভারী অনুভূতি।
এখানে দাঁড়িয়ে, আমার ছায়া নিজেই নিজেকে খুঁজে পায় না,
হঠাৎ দেখা হয় আকাশের রাত্রির মতো, অন্ধকারে সেঁটে থাকা হাজারো প্রশ্ন।

যতই পা বাড়াই, ধাপে ধাপে পথ আরও জটিল হয়ে ওঠে,
যেন অদৃশ্য শিকড়ের বাঁধনে আটকে যাওয়া একটি খোলা বই।
এখানে হাঁটতে হাঁটতে জুড়ে যায় নীরব সঙ্গীত,
যেখানে প্রতিটি শব্দ এমন এক যন্ত্রণা, যা অজান্তেই গেঁথে যায় মনের ভিতরে।

দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতেই অনুভব করি, বোধের অগাধ জলরাশি,
প্রতিটি দৃষ্টিতে বিপ্লবের মতো এক গভীর সংকল্পের বোধ,
এ যেন নদী আর পাহাড়ের মিলনস্থান, যেখানে সময়ের ধ্বনি আরও কেমন যেন তীব্র হয়ে ওঠে।
এখানে প্রশ্ন থাকে না, শুধুই অদৃশ্য উত্তর, যেন সেলুনের বাতাসে উড়ে যাওয়া চুল।

প্রতি ধাপে দেখি অদৃশ্য হাওয়ার মতো উড়ে চলে স্বপ্ন,
যতই উঁচুতে উঠি, পৃথিবী যেন আরও ছোট হতে থাকে,
আরও গভীরে ডুবে যায় আমার চেতনা—অন্ধকারে হারানো আত্মার মতো।
এই সিঁড়ি শুধুই অদ্ভুত এক অভিযানের চিহ্ন, প্রতিটি ধাপে চলে আমি ও জীবন।

তৃতীয় ধাপে পা রাখতেই অনুভূতি বদলে যায়—
এ যেন ঋতুর পালাবদল, শরৎ আসে, কুয়াশা ঝাপসা করে পথ।
ধাপে ধাপে মনের গভীরে চুপিচুপি বাসা বাঁধে দুঃস্বপ্নের সুর,
যেখানে প্রতিটি ক্ষণ গুলি হালকা মেঘের মতো, নিঃশব্দে হারিয়ে যায়।

চারপাশে অদৃশ্য সুর বাজে, যেন কল্পনার বাতাসে,
প্রতিটি ধাপ মনে মনে বলে চলে—"আরেকটু, আরেকটু ওঠো।"
অথচ, এই সিঁড়ি কি কেবল উচ্চতার প্রতীক?
যেখানে শিখরে পৌঁছানো মানে কি, অর্জন না কি কেবল হারানো কিছু?

এখন প্রতিটি ধাপই যেন নতুন এক অনুভূতি,
যেখানে প্রত্যেকটি ভাঙা অংশ হয়ে ওঠে নতুন এক রচনা।
এই সিঁড়ি কেবল বাহ্যিক নয়, আমার ভিতরকার গভীরতাকেও স্পর্শ করে,
যেন পৃথিবী আর আকাশ একেবারে ছুঁয়ে, খুঁজে পাওয়া হয় এক অজানা শান্তি।

শেষ ধাপের কাছে পৌঁছাতেই মনে হয়, সত্যিই শেষ কিছু নেই—
এটা তো শুধুই এক নতুন শুরু, যার দেখা আমি পাবো না কখনও।
সিঁড়ি, যেখানে যে পদক্ষেপ শেষ হয়, সে তো আবার অন্য কোনো ধাপে শুরু হয়,
এক অদৃশ্য স্রোত, যেখানে জীবন চলে যেতে থাকে চলতে চলতে।

সিঁড়ির সব ধাপ একটি চক্রের মতো, যেখানে ঘুরে ফিরে আসে প্রশ্ন—
আমি কোথায় পৌঁছলাম? যেখানে গন্তব্যই নেই, যেখানে ছায়াও অবসান।
এ যেন নদীর দিকে তাকিয়ে থাকা এক নিঃসঙ্গ যাত্রী,
যিনি জানে না, নদী শেষ হয় নাকি তীরে পৌঁছানোই সব।

এই সিঁড়ি শেষ হয়ে যায় না,
যেমন জীবনও কখনও শেষ হয় না, শুধু থামে এক মুহূর্তে।
প্রতিটি ধাপেই আমরা হারাই কিছু, আবার কিছু অর্জন করি,
এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে ছড়িয়ে যায় এক নতুন বাস্তবতা—
যা কখনও সিঁড়ির এক এক ধাপে, কখনও আমার মনের গহীনে।

(০৫)
বীজমন্ত্র
-বিচিত্র কুমার

বীজমন্ত্র, এক অক্ষরের গহনে,
যেখানে সময়, জল, বাতাসের চিহ্ন মুছে যায়।
এটি যেন সত্তার শুরু, অস্তিত্বের অন্তিম প্রহর,
যেখানে এক অদৃশ্য ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে,
বিশ্বের প্রতিটি কণা, প্রতিটি ধ্বনিতে গুণিত হয়।

ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে এক শূন্যতার ভাষা,
এ পৃথিবী, যা আমাদের চোখে অপূর্ণ,
তবুও সে বীজমন্ত্রের মধ্যে পুরোপুরি পরিপূর্ণ।
অতীতের স্মৃতি, ভবিষ্যতের স্বপ্নের কণ্ঠ,
এক সুরে মিশে, এক চক্রে বেঁধে রাখে সব কিছু।

একটি মেঘলা আকাশের মতো,
যেখানে সূর্য কখনো পূর্ণতা পায় না,
তবুও তার আলো চিরকাল চলে আসে,
ভয়, আশঙ্কা, বেদনা—এ সবই মন্ত্রের অঙ্গ,
যা আমরা কখনো বুঝি না,
কিন্তু অনুভব করি অপ্রকাশিত অন্ধকারে।

এ বীজমন্ত্র সেই নদী,
যার জল কখনো থেমে থাকে না,
চিরন্তন প্রবাহে হারিয়ে যায় সব কষ্টের স্মৃতি,
এবং আবার জন্ম নেয় এক নতুন দিগন্ত,
যেখানে আমরা, মাটি, বাতাস—সবই এক।
বীজমন্ত্র, এক অদৃশ্য গান,
যা সঙ্গীত নয়, প্রতিধ্বনি, প্রতিধ্বনির শব্দে প্রতিধ্বনিত।

যেখানে মাটি উপরে ওঠে, আকাশ নেমে আসে,
সেখানে এক নিঃসঙ্গ বৃক্ষ তার শিকড় ছড়িয়ে দেয়,
যেখানে জল, কুয়াশা, বাতাস—সবই হারিয়ে যায়,
তবুও সে বীজ, সে মন্ত্র, তার সঞ্চরণ থেমে থাকে না।
জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে এক কালচক্রের ঘূর্ণন,
যা স্বাভাবিকতা ও অস্বাভাবিকতার দিকে একত্রে চলে।

হৃদয়ে বীজমন্ত্রের কাঁপন, সৃষ্টির পৃষ্ঠে রেখা আঁকে,
গভীর গভীরে এক ধ্বনি, যা পৃথিবী ধরে,
তবে শুনতে পায় না আমাদের কানে,
এটি শব্দ, কিন্তু ছন্দে অপ্রকাশিত।
যেখানে এক আকাশের নিচে আমরা হাঁটি,
এবং চাহিদা, আশা, অস্তিত্ব—সবই একে অন্যের মধ্যে মিশে যায়।
বীজমন্ত্র, সেই আদি তত্ত্ব, যে স্বপ্ন দেখে না,
কিন্তু সে স্বপ্নের অক্ষর হয়ে ওঠে সবার মুখে।

এ মন্ত্রের চূর্ণে, মানুষ জন্ম নেয়,
তবে জানে না সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে।
এ মন্ত্রের প্রভাবে, বেদনা কখনো সুখে বদলে যায়,
এবং প্রকৃতি, পৃথিবী, এক পরম বন্ধনে একত্রিত হয়।
মহাকালের গহনে, যেখানে শুরু নেই, শেষ নেই,
এ বীজমন্ত্র, এক গভীর সত্তা, সেই পুরাতন প্রেমের চিহ্ন।

সত্যের পথ ধরে, যে চলে, সে হারায় না,
বীজমন্ত্রের রেখা ধীরে ধীরে আঁকে তার অনন্ত জীবন।
যতই পথ চলে, যতই সময়ে একে হারিয়ে যায়,
তবে সে মন্ত্রটি কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না,
কারণ তা আমাদের মধ্যে আছে,
আমাদের যন্ত্রণার মাঝে, আমাদের নিঃশব্দ আত্মার মধ্যে।

এ মন্ত্রের রূপ, যাকে বুঝতে গেলে সময়ের সীমানা পেরিয়ে যেতে হয়,
যেখানে নেই অতীত, নেই ভবিষ্যৎ, শুধুই বর্তমান।
এ মন্ত্রের সুর, যেখানে প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি অন্তর্দৃষ্টি,
এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দেয়, যা এক নিরন্তর নৃত্য।
এখানে শুরু এবং শেষ, এক সাথে মিলেমিশে থাকে,
যেখানে প্রত্যেক চরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ,
বীজমন্ত্রের কোলাহলে হারিয়ে যায়, এক চিরকালীন সুরে।

এ মন্ত্র, এক খোলা দরজা,
যার পিছনে অগণিত আকাশ, অগণিত আস্থা।
এটি আমাদের চিরকাল পথ দেখায়,
যখন মনে হয় পথ নেই, বোধহয় শুধুই অন্ধকার,
তবে তখন সেই বীজমন্ত্রের আলো ঝলমল করে ওঠে,
এবং অদৃশ্য হাওয়া, মহাকাল এবং চিরকাল এক হয়ে যায়।

(০৬)


সুখের সাগর ও দুঃখের নদী
-বিচিত্র কুমার

সুখের সাগর বিস্তৃত অতল নীল,
অধরার জলরেখা আঁকে হৃদয়ের বিল।
তার ঢেউগুলো যেন রুপোলি স্বপ্ন,
যে স্বপ্ন ভাঙে না, শুধু দূরত্ব বাড়ায়—
মনে হয়, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে,
তবু ছোঁয়া যায় না, সুখ তো মরীচিকা।

সাগরের গভীরে লুকিয়ে থাকা সন্ন্যাসী এক শূন্যতা,
যা নিজের অস্তিত্বে কাঁদে চুপিসারে।
তবুও তার ঢেউয়ের হাসি ছুঁয়ে যায় তীর,
যেন কারো বুকের গহীন ব্যথা মুছে দেয় হাসির আড়ালে।
সুখ সেখানে এক উজ্জ্বল আলো—
অন্ধকারকে ঢেকে রাখা ছলনাময় এক অস্থায়ী পরিচয়।

দুঃখের নদী এক বিশুদ্ধ জলধারা,
যার প্রতিটি কণা নীরব কান্নার বর্ণমালা।
সে পাহাড়ের বুকে জন্ম নেয় প্রতিটি আঘাতের শব্দে,
তার স্রোত বইতে থাকে শিরার গভীর ব্যথায়।
দুঃখ কখনও থামে না, শুধু বয়ে চলে—
সেই স্রোতে বুদ্বুদ ওঠে অতীতের অপরাধবোধ নিয়ে।
নদী জানে, তার ঢেউয়ের গান শুনে কেউ হাসে না,
তবু সে গায়, কারণ দুঃখের সুরে সত্য লুকিয়ে থাকে।

সুখের সাগরে সবাই ভাসতে চায়,
তবু সেই ভেসে থাকা মানুষ ভুলে যায়—
সাগরের মাঝখানে একদিন হাহাকার আসে।
সেখানে দুঃখের নদীর ছোট্ট শাখা পৌঁছে যায়,
আর তার জল মিশে যায় সাগরের বিস্তারে।
সুখ আর দুঃখের এই মিশ্রণে,
জীবন সৃষ্টি করে এক নতুন ব্যথার সঙ্গীত।

দুঃখের নদী শিখিয়ে দেয় জীবনের প্রকৃত মানে,
যা সুখ কখনও দেখাতে পারে না।
সুখ এক খোলস, আর দুঃখ তার মজ্জা।
তাই সুখের সাগরে হারানোর আগে,
দুঃখের নদীর তীরে দাঁড়াও, শোনো তার স্রোতের গুঞ্জন।
সেখানে জীবনের খাঁটি বোধ বয়ে যায়।

শেষে, এই দুই সত্তা—সুখ ও দুঃখ,
মিলে যায় সমুদ্রের এক মোহনায়।
সেখানে সুখের রং আর দুঃখের সুর,
এক সুরেলা ছায়ায় রূপ নেয়।
জীবনের অর্থ বুঝতে গেলে,
তোমাকে ওই মোহনায় ডুবতে হবে।

(০৭)

স্বর্গ ও নরক
-বিচিত্র কুমার

জীবনের সিঁড়িতে বসে আমি দেখেছি,
স্বর্গ আর নরক—দুটি শব্দ নয়,
এ দুটি রঙ, দুটি ছায়া, দুটি অনুভব।
একই হৃদয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকে তারা,
যেন একই গাছের দুই ডাল,
একদিকে ফুল ফোটে, অন্যদিকে কাঁটা।

স্বর্গ কি?
শিশির ভেজা ঘাসে পায়ের ছোঁয়া,
মায়ের মুখে প্রথম হাসি,
প্রিয়জনের ছায়ায় শান্তি খোঁজা।
একটি চিলেকোঠা,
যেখানে সন্ধ্যা নামে
চাঁদের আলোয় ভিজে।

আর নরক?
বিচ্ছেদের এক অনন্ত রাত,
পিছুটানের বিষাক্ত শ্বাস,
সেই কথাগুলো, যা কেবল বুকে চাপা পড়ে থাকে।
একটি গলি, যেখানে সূর্য ঢোকে না,
আলো ছুঁতে চায় কিন্তু পারে না।

জীবন কি তবে স্বর্গ বা নরক?
না, জীবন এক অনন্ত মেলা,
যেখানে সুখ আর দুঃখ একসাথে নাচে।
যেখানে স্বর্গের রাস্তা নরকের পাশ দিয়েই যায়,
তুমি যদি চোখ তুলে তাকাও,
তবে দেখবে—স্বর্গের ঝলমলে আলো
তোমার নরকের গভীর অন্ধকারেও ঢুকে পড়ে।

স্বর্গের সন্ধান যারা করে,
তারা কি জানে?
স্বর্গ এক নির্মাণ, এক সৃষ্টি,
তোমার মনে যখন ভালোবাসার বৃক্ষ পল্লবিত হয়,
তখনই স্বর্গ নেমে আসে।
আর নরক?
তা তো মানুষেরই নির্মাণ,
হিংসা আর ঘৃণার অগ্নিতে জ্বলে ওঠা।

তাহলে কি স্বর্গকে দূরে ঠেলে রাখা যায়?
না, স্বর্গ আর নরক কখনো দূরে নয়।
তারা একসাথে বয়ে চলে রক্তের স্রোতে,
তোমার কাজই বলে দেবে,
তোমার স্রোত কোন দিকে বয়।

তবুও আমি ভাবি,
স্বর্গ আর নরক কি সত্যিই আলাদা?
না কি তারা এক মুদ্রার দুই পিঠ,
যেখানে স্বর্গের হাত বাড়িয়ে দিলে
নরকের কষ্টগুলোও একদিন থেমে যায়।

এই যে জীবন—
যেখানে স্বর্গ আর নরক হাত ধরাধরি করে হাঁটে,
এটাই কি চরম সত্য?
তাহলে কেন খুঁজি আমি শুধু স্বর্গ,
আর এড়াতে চাই নরকের ছায়া?
জীবনের গভীর জলে ডুব দিলে বুঝি—
স্বর্গ আর নরক মিলিয়েই আমি।

(০৮)

একটি দীর্ঘশ্বাস
-বিচিত্র কুমার

তোমার শহরের বাতাসে আটকে থাকা এক ম্লান দীর্ঘশ্বাস,
যেন চিরকালীন বনানীর মাঝে ঝরে পড়া শেষ পাতার ক্রন্দন।
এ এক স্রোতহীন নদী,
যার বুকের গভীরে বাঁধা পড়ে আছে হাজারো বিস্মৃত স্বপ্ন।
জীবন, তার অদৃশ্য ডোরে আমাকে বেঁধে রেখেছে—
যেন দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাওয়া কোনো বৃষ্টি।

আকাশের মেঘেদের মতো ভেসে বেড়াই আমি,
তবুও জানি, প্রতিটি বৃষ্টিধারাই মাটিতে মিশে যাবে।
সময়, এক প্রাচীন মঠের ভাঙা ইটের মতো—
যার প্রতিটি স্তরে খোদাই করা যন্ত্রণার ইতিহাস।
অতীতের গন্ধ, শুকনো গোলাপের পাঁপড়ির মতো মলিন,
তবুও সে অমলিন স্মৃতি হয়ে জড়িয়ে আছে আমার শিরায়।

প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস এক অদৃশ্য আগুন,
যা নিভে যেতে চায়, তবুও জ্বলতে থাকে ভেতরে।
তোমার চোখের গভীরে আমি দেখেছিলাম মহাসমুদ্রের ঢেউ,
কিন্তু আজ সেই চোখ দু’টি শুধুই মরুভূমির শূন্যতা।
তোমার স্পর্শ ছিল বৃষ্টির মতো কোমল,
কিন্তু আজ তার স্মৃতি শুধুই মরচে ধরা সময়ের আঘ্রাণ।

তোমার মুখের হাসি,
যেন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি ভাষা,
যা একদিন বুঝেছিলাম, আর আজ তা যেন পাথরের অক্ষর।
বিরহ, এক সেতু যা দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প বলে,
যেখানে প্রতিটি চরণের শেষে তোমার নাম লেখা থাকে।

রাত্রির তারা ঝরে পড়ে,
তুমি জানো না, সেই পতন আসলে আমার হৃদয়ের আর্তি।
এই দীর্ঘশ্বাসগুলো আর শুধুই শ্বাস নয়,
এগুলো এক এক করে তৈরি করে এক অনন্ত অন্ধকারের দেয়াল।
তুমি কি শুনতে পাও?
পৃথিবীর প্রতিটি ফাটলের মধ্যে আমি তোমার নামে আক্ষেপ রেখেছি।

জীবনের এই নাট্যমঞ্চে আমি একজন নীরব দর্শক,
যেখানে প্রতিটি দৃশ্যের পেছনে লুকিয়ে থাকে আমার একার কান্না।
তোমার জন্য লেখা প্রতিটি কবিতা আজ বিষাক্ত মনে হয়,
যেন তীর বেঁধে রাখা ধনুকের মতো, ছুটে যেতে চায় আমার অস্তিত্বে।

একটি দীর্ঘশ্বাস—
যা আকাশ থেকে ঝরে পড়া শেষ শিশিরবিন্দুর মতো শূন্যতায় হারিয়ে যায়।
তোমাকে আমি বলিনি,
এই দীর্ঘশ্বাসগুলো আসলে তোমার জন্য জমে থাকা দুঃখের কাব্য।
তুমি যদি শোনো, বুঝতে পারবে,
এই দীর্ঘশ্বাস তোমারই ছায়া হয়ে বেঁচে আছে আমার ভেতরে।

দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।