(০১)
শুভ্রতার ছোঁয়া
-বিচিত্র কুমার
শরতের আকাশে গাঢ় নীলের গভীরতা, যেন অচেনা অরণ্যের অন্তর্গত রহস্যের পরিচায়ক। সাদা মেঘেরা ভাসছে হালকা কোমলতা নিয়ে, যেন মধুর স্বপ্নের কল্পনায়। সূর্যের সোনালী রশ্মি মাটিতে পড়ে, একটি নিত্যসন্ধির মত, প্রত্যেকটি কণাকে আলোকিত করে, যেভাবে একটি কবিতা এক একটি স্তবকে জীবন পায়।
বাতাসের মধ্যে শরতের ঠান্ডা ছোঁয়া, কুয়াশার নরম আচ্ছাদনকে সাথে নিয়ে, মাটির সবুজ আবরণে এক শাশ্বত নিরবতার সুর বুনে দেয়। ফুলের মধুর সুবাস বাতাসে মিশে, যেন প্রতিটি নিশ্বাসে একটি অমৃত ভরে দেয়, আর পাতা ঝরার সুর তো যেন প্রকৃতির আত্মজীবনী।
নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের মাঝে, শরতের এই সকালের শান্তি একটি অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি এনে দেয়। সূর্যের কিরণগুলো যেমন গভীর অন্ধকারকে আলোতে পরিণত করে, তেমনি এই ঋতু জীবনের গভীরতম অনুভূতিকে আমাদের মাঝে তুলে ধরে।
এই শুভ্রতার ছোঁয়া, এমন এক অনুভূতি যে চিরকাল শান্তির উৎস হয়ে, হৃদয়ের গভীরে, প্রকৃতির এক অমল শ্লোকের মত স্থায়ী হয়।
(০২)
শরতের মাধুরী
-বিচিত্র কুমার
শরতের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে সোনালী রঙের তলে,
নীলিমার আভা সমগ্র পৃথিবীকে স্নিগ্ধ করে।
বিকেলের আলো লুটোপুটির নরম সুরে,
বনের মধ্যে গুঞ্জন করে প্রাকৃতিক কাব্য।
হিমেল হাওয়ার বুনো খেলায় নাচে পাতারাও,
প্রতি ঝরে পড়া পাতা যেন সুরের কণিকা হয়ে যায়।
বৃষ্টি ছাড়ানো গাছের ডালে শিশিরের স্রোত,
যেন এক মিষ্টি প্রলাপ বুনেছে প্রকৃতি বড় দোতলা।
চাঁদের আলোয় দৃষ্টিনন্দন ঝিলমিল বেলাশেষ,
পাহাড়ি নদীর স্রোতে শোনায় মুক্তি সুর।
ফুলের বাগানে চঞ্চল মৌমাছির মৃদু গুঞ্জন,
শরতের এই রূপে হৃদয় অভিভূত, সিক্ত বরণে।
প্রকৃতির গর্ভে সৃষ্টির এই মাধুরী,
মনকে মেলে দেয় এক গভীর শান্তির সুদূর।
হৃদয়ের ক্যানভাসে আঁকা এই মাধুরী কাহিনী,
শরতের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির গূঢ় রহস্য।
(০৩)
নীল আকাশের নূপুর
-বিচিত্র কুমার
নীল আকাশের নূপুর বেজে ওঠে গোধূলির সোনালি আলোর মাঝে, যেন অদৃশ্য কোনো দিগন্তে লুকিয়ে থাকা এক দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। শরৎ তার নীরব আগমনে আনে এক অলৌকিক পরিবর্তন—মেঘের সাদা তুলোর ছায়া লেগে থাকে আকাশের গায়ে, আর শিউলি ফুলের সুবাস ঢেউ খেলে যায় বাতাসের প্রতিটি স্পন্দনে।
এই নীলিমার গভীরে লুকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত রহস্য, যা ছুঁতে চায় হৃদয়ের অলীক অনুভূতিগুলো। মেঘেদের অপূর্ব রূপকল্পে যেন কোনো বিস্মৃত প্রেমিকের কাহিনি লেখা হয়, আর কাশফুলের সাদা রাজ্যে প্রতিটি বাতাসে মিশে থাকে এক অজানা শোকের সুর। এমন সুর, যা হৃদয়ের তন্ত্রীতে আঘাত করে, মনে করিয়ে দেয় কোন এক হারানো দিনের গল্প।
পাহাড়ের বুকে নেমে আসে সূর্যের রক্তিম আলো, আর সেখানে আলোর কারুকাজে ফুটে ওঠে এক পরাবাস্তব দৃশ্যপট—যেন আলো-অন্ধকারের ছায়ায় গাঁথা এক পরম রহস্যের চাবি। গোধূলির আগমনে আকাশের রং বদলে যায়, আর সেই রংয়ের পালাবদলে লুকিয়ে থাকে এক অনন্ত আকাঙ্ক্ষার আভাস।
এই নীল আকাশের নূপুর যেন সময়ের অন্তহীন এক সরল রেখা, যার প্রতিটি ধ্বনি বয়ে আনে মাটির গন্ধ, জলের সুর। যেন কোথাও থেকে ভেসে আসে চিরকালের এক ধ্রুব সত্য, যা মেঘের ক্যানভাসে আঁকা আলোর ছায়ায় প্রতিফলিত হয়। সেই সত্য বলে যায়, শরতের প্রতিটি ক্ষণেই লুকিয়ে থাকে এক অনন্ত আশার রূপকথা।
(০৪)
শরতের সন্ধ্যা
-বিচিত্র কুমার
শরতের সন্ধ্যা। এক অপরূপ নিস্তব্ধতার আস্তরণে ঢাকা পড়ে সারা প্রকৃতি। আকাশের রঙ এক অদ্ভুত ধূসর-বেগুনি, যেন পুরানো সুতীর রং চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে। অদূরে কোনো গাছের পাতায় সোনা রঙের আলো লেগে উঠছে, আর তার ছায়া পড়ে বয়ে চলা নদীর জলে। জলে হঠাৎ হাওয়া লাগলে তরঙ্গগুলো যেন স্বর্ণাভ সুতোর মাকড়সার জাল বুনে চলে।
দূরে কোনো মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যার আকাশে। একটা অলীক নীরবতার চাদর যেন মনের ভেতর জড়িয়ে ধরে। মাটির রাস্তার ধুলো উড়িয়ে মৃদু হাওয়াটা বয়ে যায়; তার শীতল স্পর্শে মনে হয়, কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে কোনো হারানো গানের সুর।
অন্ধকার আর আলোর মাঝে তফাৎ বোঝা যায় না। আলো যেমন ফুরিয়ে আসছে, তেমন করেই দুঃখের চাদরটাও খুলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আকাশের এক কোণে চাঁদ উঠে আসে, যেন সন্ধ্যার চোখের জল মুছে দিয়ে যায়। এই মুহূর্তটা শরতের, এই মুহূর্তটা নীরবতার। যেন প্রকৃতি তার হৃদয়ের সব অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়ে গেছে এক শীতল বাতাসের মধ্যে।
পাশের ক্ষেতগুলো ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশায়, যেন নরম তুলোর আস্তরণ। বাতাসে কোথাও কোথাও ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ মিশে আছে। গাছপালা দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ সাক্ষী হয়ে; তাদের ছায়াগুলো যেন দীর্ঘশ্বাসের মতো মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে। প্রতিটি ধাপে সন্ধ্যার শূন্যতা যেন হৃদয়ে একটা নিঃশব্দ সঙ্গীত বাজিয়ে যাচ্ছে। শরতের সন্ধ্যা এক গভীর অনুভূতি, যেন অন্তরের গহীনে কোনো অনাবিল স্বপ্নের আরাধনা।
সন্ধ্যার এই ক্ষণগুলো মনে করিয়ে দেয় সেই হারানো কথা, যেখানে প্রেম আর বেদনা মিশে একাকার হয়ে যায়। হৃদয় হাহাকার করে ওঠে— যেন শরতের সন্ধ্যার সাথে মিলিয়ে যেতে চায় কোনো চিরকালের অপেক্ষায় থাকা প্রেমের গান।
(০৫)
শিউলি ও কাশফুলের প্রেম
-বিচিত্র কুমার
শিউলি ফুলের সাদা পাপড়ির উপর ভোরের শিশিরের মতো তার চোখ। তার শরীরে এক অদ্ভুত মাধুর্য, মাটির কাছাকাছি থেকেও যেন আকাশের চাঁদ। কাশফুলের দোলনীর নরম হাতছানি তাকে প্রতিদিনই নতুন করে ডাকে—যেন বাতাসের মাঝে চিঠির মতো ভেসে আসে তার মন কেমন করা কথা।
কাশফুল নীরব, তার দোলায় যেন মৃদু হাসির ঝংকার। তার সাদা রেশমের মতো ফুলগুলি যখন বাতাসের সাথে খেলা করে, তখন শিউলির মনে হয় যেন কাশফুল তাকে আলতো করে ছুঁয়ে যায়। গভীর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, শিউলি তাকিয়ে থাকে সেই দোল খাওয়া কাশফুলের দিকে। তার চোখে এক গভীর আর্তি—যেন সে প্রশ্ন করে, "তুমি কি আমাকে জানো? তোমার এই দোলায় কি আমার প্রতিচ্ছবি?"
কাশফুল যেন কিছু বলে না, তবুও বাতাসে তার প্রতিধ্বনি শিউলির কানেই আসে, "তোমার নীরবতাই আমার শান্তি, তোমার মাধুর্যই আমার প্রেম। আমরা তো প্রকৃতির খোলা আকাশের নীচে আছি—এই খোলা হাওয়ায় আমাদের প্রেম খেলে যায়, নীরবে, নিঃশব্দে।"
শিউলি ধীরে ধীরে ফুল ফোটায়, আর কাশফুল তার সাদা পাপড়ি মেলে ধরে। তারা দুজনেই জানে, এই মিলন শুধু চোখের দেখা নয়—এ এক অন্তরের সুর, প্রকৃতির ভাষায় লেখা এক শাশ্বত কবিতা। যেন তারা প্রকৃতির বুকে চিরকালীন প্রেমের একটি স্বপ্ন আঁকে, এক সাদা-সবুজ ক্যানভাসে।
------
https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL