(০১)
হেমন্তিকা

হেমন্তের আকাশে মেঘেরা যেন প্রেমিক-প্রেমিকার চুপিচুপি কথোপকথন,
নীল আর সাদা মিলে তৈরি করছে এক আশ্চর্য মিলনমঞ্চ।
পাখিদের গান ছুঁয়ে যায় ঘাসের দেহ, যেন অজানা অনুভবের প্রথম স্পর্শ,
পাতার মর্মরধ্বনি যেন কবিতা হয়ে ঝরে পড়ছে বাতাসের চূড়ায়।

ধানের ক্ষেতে স্বর্ণমুকুট পরা হেমন্তিকা, তুমি কি প্রকৃতির রাণী?
তোমার গায়ে লেগে থাকা হলুদ রঙ যেন কারো সোহাগ মাখানো শাড়ি,
পাকা ধানের গন্ধে মাতাল হওয়া হাওয়ায় লুকিয়ে আছে মনের গভীর বার্তা,
তুমি কি ভালোবাসার একান্ত দিকচিহ্ন? একমুঠো নিঃশ্বাস?

দেখো, ঝরা পাতারা নদীর ধারে বসে গল্প করছে সূর্যের সঙ্গে,
তাদের উড়ান যেন প্রাচীন যুগের প্রেমপত্র, যা হেমন্তে জেগে ওঠে।
রুক্ষ মাটি সিক্ত হচ্ছে শিশিরের চুম্বনে, যেন প্রিয়তমার চোখের জল,
প্রতিটি ফোঁটায় বয়ে যায় নীরব প্রেমের দীর্ঘশ্বাস।

আকাশের কুয়াশা যেন তোমার ঘোমটা, যা শীতের ছোঁয়ায় ঘনায়,
তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে এক স্নিগ্ধ অমল মুখ—হেমন্তিকার।
তুমি কি জানো, নদীর ঢেউয়ের ছন্দ তোমার চলার শব্দের মতো?
তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ প্রকৃতিকে ভরে তোলে প্রেমের রসে।

আলোর রূপালি রেখা হেমন্তের সকালকে আলিঙ্গন করে,
যেন তুমি কারো হাত ধরে পথ চলেছ কোনো এক অন্তহীন স্বপ্নে।
তোমার চোখে দেখি খেজুর গাছের শান্ত দাঁড়িয়ে থাকা—
তুমি কি প্রকৃতির ধৈর্য, নাকি প্রেমের অমরতা?

হেমন্তিকা, তোমার অস্তিত্বে মিলিয়ে যায় সময়ের গভীরতা,
তুমি প্রেমের প্রতীক, প্রকৃতির অন্তর্গত ছন্দ।
তোমার প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক জীবন্ত কবিতা,
যা কখনো শেষ হয় না, কেবল নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে।

(০২)
হেমশ্রী

হেমন্ত এসেছে শীতল শ্বাসে, যেন পাহাড়ি ঝরনা শান্ত নদীর কাছে আশ্রয় চায়।
পাকা ধানের সোনালি সুবাসে বাতাস ভরে ওঠে, যেন প্রেমিকার চুলের গন্ধে প্রিয়তম বিভোর।
গাঁয়ের পথের ধুলো উড়ছে, সূর্যের আলোয় সোনার মতো ঝলমল, যেন কুমারের হাতে গড়া মৃৎপাত্র।
শালিকের ডাকে ভোরের শিহরণ, যেন নতুন প্রেমের মৃদু ফিসফিস।

গাছের ঝরা পাতা যেন প্রেমের অতীত স্মৃতি, মাটিতে শুয়ে আছে নীরবে।
আকাশে ভাসছে সাদা মেঘ, যেন নববধূর সাদা ঘোমটা হাওয়ায় উড়ছে।
নদীর ধারে কাশফুলের সারি, যেন কুমারী মেয়ের খোঁপায় সাদা ফুলের মেলা।
বাঁশবনের নীরবতা গভীর, যেন বিরহী প্রেমিকার কান্না দমিয়ে রাখা।

চাষার মুখে হাসি, তার খেতের সোনালি ধান যেন প্রেমের ফসল।
পুকুরের জলে পড়ে থাকা পাতা, যেন বিচ্ছেদের চিঠি ভেসে গেছে স্মৃতির অতলে।
পাখির মৃদু কলতান, মনে করায় দূরে থাকা প্রেমিকার কণ্ঠস্বর।
পাড়ার মন্দিরে সন্ধ্যার ঘণ্টাধ্বনি, যেন ভালোবাসার নিবেদন আকাশে তুলে দেয়।

জীবনের মতো হেমন্তও তার দ্বন্দ্ব নিয়ে আসে—সৌন্দর্যের মাঝে বিষণ্ণতা।
শিশির ভেজা ঘাসের শীতলতা, যেন প্রিয়জনের অনুপস্থিতির ব্যথা।
তবু হেমন্তে প্রেমের অমোঘ টান, যেন জীবন আর মরণের মাঝেও ভালোবাসার আহ্বান।
প্রকৃতির এই রূপবর্ণিল ক্যানভাসে, হেমন্তের ছোঁয়ায় প্রেম যেন নবজীবন পায়।

তুমি যদি হেমন্ত হও, আমি হব কাশফুলের দোলা।
তুমি যদি ঝরা পাতা হও, আমি হব তোমার মাটির আশ্রয়।
তুমি যদি শিশিরবিন্দু হও, আমি হব তোমার সকালের আলো।
এই প্রেমের কবিতা, হেমন্তের রঙে রাঙানো এক চিরন্তন প্রতিশ্রুতি।

(০৩)
হেমা

হেমন্তের হলুদাভ আলোয় মোড়া ভোর,
যেন সোনালি স্বপ্নের চাদরে ঢাকা এক প্রান্তর।
আকাশে ঝুলে থাকা কুয়াশার গহনা,
পাখির ডানায় মিশে থাকা শিশির বিন্দুর গান।
তোমার নামের প্রথম অক্ষরেই দেখি
রৌদ্রছায়ার নরম কোলাজ।

হেমা, তুমি যেন হেমন্তের দখিনা হাওয়া,
কোনো এক ঘুমন্ত নদীর পাশে দাঁড়িয়ে গাওয়া
এক চিলতে সুরের প্রতিধ্বনি।
তোমার চুলের ঢেউ—
ঝরা পাতার স্রোতে ভেসে যাওয়া নদীর ঢাল।
তোমার চোখ—
হেমন্তের আকাশে ঝুলে থাকা
চাঁদের মৃদু আলোর ছায়াপথ।

আমি তোমার স্পর্শ খুঁজি—
গাছের শুকনো পাতার ফাঁকে ফাঁকে
যেখানে ঘাসের উপর শিশিরের নৃত্য।
তোমার গলার স্বর,
যেন দূরের গ্রামে বাঁশির সুরে গাঁথা এক উৎসব।
তোমার হাসি,
হেমন্তের সরু পথে ছড়িয়ে থাকা কাশফুলের মেলা।

তুমি কি জানো, হেমা?
তোমার নামে আমার হৃদয় দুলে ওঠে—
মাঠের ধানগাছে জেগে ওঠা নরম রোদ্দুরের মতো।
তোমার মুখের আলো
হেমন্তের শেষ বিকেলের ম্লান সোনাঝরা ছায়ায় মাখা।
তোমার আঙুলের ইশারায়
আমি আঁকি নদী, গাছ, মাঠ, আর আকাশ।

হেমন্তের রাতের তারাভরা আকাশে
তোমার নামে চিঠি লিখি।
আমার প্রতিটি শব্দে খুঁজে পাই
ঝরা পাতার গান আর কুয়াশার শিহরণ।
তুমি যদি হেমন্তের কবিতা হও,
তবে আমি তার প্রতিটি পঙক্তির বৃষ্টি।

তুমি হেমন্তের রূপকথা,
যেখানে প্রকৃতির প্রতিটি রেখায় লেখা প্রেম।
তুমি আমার হৃদয়ের কাব্যিক স্বপ্ন,
ঝরে পড়া পাতায় দোলা লাগানো হাওয়া।
তুমি যদি পাশে থাকো, হেমা,
তবে হেমন্ত চিরদিন থাকবে।

(০৪)
হেমনন্দিনী

হেমনন্দিনী, তুমি কি জানো, হেমন্তের আলোয় তুমি হয়ে উঠো একটি শঙ্খচূড় স্রোতস্বিনী—
তোমার চুলের আলগা স্পর্শ যেন ঝরে পড়া শিউলির প্রথম কোমলতা।
তোমার কণ্ঠের মায়া হেমন্তের শুকনো পাতায় বাজে এক চিরন্তন বাঁশি,
যা শুনে দূরের কুয়াশায় ঢাকা বটগাছও নত হয় বিনম্র প্রেমে।

তোমার হাসি যেন হেমন্তের শিশির ভেজা ভোর—
প্রতিটি কণায়, প্রতিটি আলোয় এক দুর্লভ উষ্ণতার স্পর্শ।
তুমি যখন নদীর ধারে দাঁড়াও, তোমার শাড়ির কাঁপুনিতে
দাঁড় কাঁপিয়ে ওঠে ভাটিয়ালি গানের সুরে।

তোমার চোখ, হেমনন্দিনী, হেমন্তের আকাশের মতো প্রসারিত,
যেখানে এক ফালি চাঁদ হঠাৎ করে হারিয়ে যায় মেঘের ফাঁকে।
তোমার মুখের বাঁকা হাসি— যেন চাষির ফসল কাটা সুখের গান,
যার মর্মে মিশে আছে ধানক্ষেতের ঘ্রাণ।

তোমার পায়ের শব্দ— শুকনো পাতার ওপর ঝরাপাতার সঙ্গীত,
যেন পল্লীর পথে জেগে ওঠে এক পুরোনো প্রার্থনার সুর।
তুমি যখন হাত বাড়াও, হেমন্তের প্রথম শীতল হাওয়া
আমার ভেতর বুনে দেয় এক অপরিসীম ভালোবাসার বাসনা।

হেমনন্দিনী, তুমি কি জানো,
তোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে আছে হেমন্তের ছায়া-রোদ্দুরের মিতালী?
তোমার সাথে কথা বললেই মনে হয়, যেন শরৎ আর হেমন্ত মিলেমিশে
গড়ে তুলেছে এক কল্পনার স্বর্গ, যেখানে সবই মধুর।

তুমি হেমন্তের মেঘ, তুমি তারই কুয়াশা,
তুমি নদীর ঢেউ, তুমি জোনাকির আলো।
তুমি ভালোবাসার প্রতীক, তুমি প্রকৃতির হৃদস্পন্দন,
হেমনন্দিনী, তুমি আমার কবিতার শেষ না হওয়া অনুপ্রেরণা।

(০৫)
হেমকুমারী

হেমন্তের সকালে জেগে ওঠে হেমকুমারী,
নরম রোদ যেন তার অলস মুখের চুম্বন।
কুয়াশার চাদর সরিয়ে তার চুলে লেগে থাকে শিশিরের মুক্তো,
ঘাসের ওপরে যেন ছড়িয়ে পড়ে তার হাসির ছটা।

তার চোখে গভীরতা, শীতল বাতাসের মতো স্পর্শকাতর,
পাখির ডাকে মেশা এক সুর,
মনে হয় যেন দূরের কোনো পাহাড়ি ঝরনা।
তার চরণ পড়ে মাঠের ধানখেতের মাঝে,
কানে বাজে ধানের গন্ধে মাতোয়ারা সুরের খেলা।

হেমন্তের দিনগুলো তাকে আলিঙ্গন করে রাখে,
আকাশে সাদা মেঘেরা তার শাড়ির আঁচল টানে।
বটের ছায়ায় বসে সে আঁকে নকশা,
পাতার ঝরাপাতায় যেন তার হাতের আল্পনা।

দিগন্তে সূর্য যখন তার আলো ছড়ায়,
হেমকুমারীর মুখে খেলে যায় সন্ধ্যার লজ্জা।
তারে ভরা রাত যেন তার চোখের তারায়,
প্রকৃতি তার কাছে চিরকালীন প্রেমিক।

শূন্যতার মাঝেও সে খুঁজে পায় ভরা পূর্ণতা,
ঝরা পাতার শব্দে সে খুঁজে পায় সুরের মাধুর্য।
হেমন্ত তার কাছে শুধু ঋতু নয়,
এ যেন প্রকৃতির গভীর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি।

তার শীতল ঠোঁটের স্পর্শে মাটি পায় শান্তি,
জীবনের গন্ধ যেন মিশে যায় বাতাসে।
হেমকুমারী, তুমি শুধু প্রকৃতি নও,
তুমি আমার হৃদয়ের অন্তিম আকাঙ্ক্ষা।

তোমার হাতে ধরা হেমন্তের সুবর্ণ উপহার,
আমার হৃদয়ে যেন চিরন্তন বাসা বাঁধে।
তোমাকে দেখে মনে হয়,
জীবনের প্রতিটি ঝরা পাতায়ও আছে এক নতুন গল্প।

(০৬)
হেমজ্যোতি

হেমন্ত এসেছে নিঃশব্দ চরণে, যেন কোনো পরী মেঘের চাদর সরিয়ে দাঁড়িয়েছে নিভৃত বনে। তার পরিধানে রয়েছে কুয়াশার ধোঁয়া, গায়ে হলুদ পাতার গয়না—এক অদ্ভুত মায়াবী আবেশ। আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে, যেমন কৃষকের চোখ জোড়া জ্বলে ওঠে নতুন ধানের মুগ্ধ রোশনায়।

মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শিশিরের মুক্তো, যেন রাত্রির চুপচাপ কান্নার অশ্রুবিন্দু। হেমন্ত তাকে সাজিয়েছে বধূর মতো, মৃদু মৃদু বাতাসে তার আঁচল উড়ে যায়—মনে হয়, এই আঁচলে লুকিয়ে আছে সৃষ্টির অমল প্রেম।

পথের ধারে কাশফুলের গুচ্ছ, যেন সরল পত্রে লেখা কোনো দেহাতি কবির প্রেমপত্র। বাতাসে ঢেউ তোলে, সূর্যের রোদে সেগুলো ঝিকমিক করে—ঠিক যেন নববধূর কপালে সোনার টিপ।

আকাশের সাদা মেঘগুলো কেমন অলস ভঙ্গিতে ভাসে, ঠিক যেন কোনো স্বপ্নবিলাসী শিল্পীর মনের ক্যানভাস। আর সেই মেঘেদের ফাঁকে ফাঁকে রোদ উঠে, হেমন্ত যেন হাসি ফুটিয়ে দেয় পৃথিবীর চরণতলে।

পাখিরা দল বেঁধে যায়, তাদের ডানায় যেন রঙিন স্বপ্ন আঁকা। গাঙচিলের উড়াল দেখে মনে হয়, তারা কোনো দূরের দেশে প্রণয় বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। নদীর জল ছুঁয়ে তারা উড়ে যায়—নদীর বুকে তখন ভেসে ওঠে এক সোনালি জ্যোতি।

আমার হৃদয়ে বেজে ওঠে এক নির্ঝরের সুর, হেমন্তের প্রতিটি দোলা আমার ভেতরে এক অলিখিত কবিতা হয়ে বাজে। তোমার চোখে যেন হেমজ্যোতির আলো—আমার সমস্ত প্রেম, সমস্ত বেদনা সেই আলোয় ডুবে যায়।

তুমি যদি আসতে হেমন্তের এই স্নিগ্ধ সকালে, আমরা দু’জনে মিলে ঘাসের ওপর শুয়ে গল্প করতাম। তোমার কণ্ঠে শুনতাম পাখির গান, তোমার চুলে গুঁজে দিতাম কাশফুলের মালা। সময় থেমে যেত আমাদের পাশে, হেমন্ত তার সমস্ত রূপ মেলে ধরত আমাদের চোখে।

হেমজ্যোতি, এই প্রেম যেন চিরন্তন। হেমন্তের প্রতিটি শীতল ছোঁয়া আমাকে মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি আর প্রেম একে অপরের পরিপূরক। তুমি, আমি, আর হেমন্ত—এই মিলনই তো চিরকালের রূপকথা।

দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।