বিমূর্ত রাতে উদ্ভাসিত ক্যানভাস
স্বর্ণমুদ্রার অশ্লীল পূর্ণতায় ভরে ওঠে যার কবিতার পরতে পরতে, তিনি প্রেমদ্রোহী ও জীবন বিরহের কবি মোশাররফ হোসেন । কালের ¯্রােতের সমসাময়িক জীবনবোধের অস্থিরতার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন সুহাসিনী শান্তিদায়িনী জীবন-মরন ও ঘোরলাগা কবিতার আমরন স্পর্শ । তাঁর "বিমূর্ত রাতের ক্যানভাস" কাব্যগ্রন্থ চিরায়িত প্রেম আলো-আঁধারের সৃষ্টি জ্যামিতিক রহস্য এবং বিদ্রহীতার ঘনত্বে আবৃত। গ্রন্থের প্রাতিটি কবিতার পঙ্তির উপমা শিল্পরূপ অলঙ্কার উৎপ্রেক্ষা চিত্রকলা ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ বর্ণনায় ফুটে উঠেছে চিরবাস্তব চিত্রপটের ক্ল্যাসিক সৌন্দর্য ও রোমান্টিকতার রূপমাধুরী। নিটোল হৃদয়ের শিথীল-বন্ধন ছিন্ন করে প্রিয়তমেষু চলে যাচ্ছে বলে আসন্ন বিদায়ের আঁধারক্ষণে অশ্রু¯œাত রাতের পীড়িত-বেদনা ও বিরহে আছন্ন ছবি এঁকেছেন কারুচিত্রিত কবিতায় । ধু¤্র-নিশীতের বিদায়ে যেমন তন্দ্রাচ্ছন্নতা, আকুলতা ঘিরে নিশ্চুপ আলোরদেবতা প্রদীপশিখা- তেমনি আকাশে অস্তগামী চাঁদের ব্যথীত কান্না কবিকে জাগ্রত হওয়ার জন্য ক্রন্দন করছে এবং বিলসিয়া ধ্বনিত হচ্ছে যেন তাঁর প্রতিটির কবিতার ফাঁকে ফাঁকে শতবছরের অমিত দাবদাহ মৃত কবিপ্রিয়ার কণ্ঠবাণী আর বাঁকা লাইনগুলোর ঝলক যেন নূতন প্রিয়ার অবিশ্রান্ত করুণ কাজলরেখা। এবং তাঁর কবিতায় রয়েছে বৈসম্য নারীপ্রেমের নৈসর্গিক ছোঁয়া ও দুর্দান্ত প্রেমের কল্পিত চিত্রকথা, নারীর শাড়ির এবং খোঁপার কেয়া ফুলের গন্ধ, অঙুলস্পর্শ আর চুম্বনশব্দ । শুধু শব্দ নয় কবিতাগুলোতে উঠে এসেছে ভাষা সংগ্রামের শহীদ সন্তানের জন্য মাতৃহৃদয়ের বেদনার সঙ্গে মিলে থাকা লুণ্ঠিত স্বদেশ মাতার রূপমূর্তি । সন্তানের নাম উচ্চারণের মধুর আনন্দ থেকে মাতৃকণ্ঠ বঞ্চিত, শাসকের দমন ও হত্যা তাঁর কণ্ঠকে কীভাবে রুদ্ধ করেছে তা কবিতা পাঠে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় । মোশাররফ হোসেনের "বিমূর্ত রাতের ক্যানভাস" যে জন্যে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে- তা হলো- ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর জ¦ালাময়ি ভাষণ। অধিকার বঞ্চিত বাঙালির শত সহ¯্র বছরের সংগুপ্ত আশা-আকাঙ্খার ধার বয়ে পূর্ণউচ্চারণ গভীর ভাবে অন্তর ছোঁয়া ভাষণ। সেদিনের ভাষণে তাঁর উত্থিত সেই অমিতবিক্রম তর্জণীর সঙ্গে কণ্ঠ যখন একই সমান্তরালে পৌঁছে দেয় : তখন বাঙালির অভিনব জীবনের আস্বাদের স্পৃহা প্রবল শানিত হয়ে ওঠে, জাতিকে অনুপ্রাণিত করে, আন্দোলিত করে স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জণের নেশায় ।
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার রক্ষার সংগ্রাম কতটা কলহপূর্ণ ও হিং¯্র ছিলো তা সুস্পষ্টভাবে তোলে ধরেছেন কবি তাঁর এই গ্রন্থে। ব্যক্তিসত্তার উর্ধ্বে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে বাংলার মেলবন্ধনের প্রত্যাশায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভগীরথের মতো এই বাংলার ভাব গঙ্গারসংগ্রাম- ওই বক্তৃতা ছিলো তিক্তযন্ত্রণা ও নিপীড়নমূলক। বাঙালি জাতির হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস সব রকমের বঞ্চণা-গঞ্চণা, নির্যাতন-নিপীড়ন আর লাঞ্ছণা মিশ্রিত ডাক- যে ডাকে, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ, নানা স্তরের পেশাজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্রনেতা, শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী, বেশ্যা, উলঙ্গকিশোর নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ পাকবাহিনীর আক্রমন ও গনহত্যা রোধে ঝড় তোলে প্রতিশোধ এবং সশস্ত্রযুদ্ধের পাশাপাশি মননশীলতার মধ্য দিয়ে যুদ্ধকে গতিশীল করতে নেমে পড়ে। অবশেষে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ণরূপ কবি সুন্দরভাবে ও সাবলীল ভাবে বর্ণনা করেছেন। স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে আমাদের সকলের জন্য বইটি পড়া অত্যন্ত জরুরী। কবি মোশাররফ হোসেন ভূঞার "বিমূর্ত রাতের ক্যানভাস" গ্রন্থটির উল্যেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- কবি বাংলার আবহমান প্রকৃতির প্রতি অঢেল ভালোবাসার কারুকার্যময় রূপ নিপুণ ও নিঁখুতভাবে তুলে ধরেছেন! তেরোশ নদীর ফর্সা জলে প্রতিবিম্বিত তারা জ্বলা আকাশের ছবি । কবি নদীর চঞ্চল¯্রােতে অচঞ্চল আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুঁটিয়ে তুলেছেন। সাজিয়েছেন নদীর তীরে পথপাড়ে সারিবদ্ধ দেবদারুর ঘনবদ্ধ হয়ে অন্ধকারের স্তব্ধরূপ রচনা, গরীব দুখী ও খেটে খাওয়া দিনমজুর মেহনতি মানুষের জীবনচক্র অত্যন্ত প্রাঞ্চল্যকরভাবে রচনা করেছেন । কবির অন্তর্চক্ষুতে উদ্ভাসিত হলো সৃষ্টিলোকের গভীর সত্য, জন্ম মৃত্যু সৃষ্টি বিনাষ যা কিছু স্তব্ধ ও মূক ছিলো তার আবরণ যেন উন্মোচিত হয়ে গেল। তিনি দেখতে পেলেন সর্বত রয়েছে গতির চাঞ্চল্য সৃষ্টির রহস্য, নিপীড়িত মানুষের ব্যরাতুর আর্তনাদ- কেন বিনাশ বিলাসী মানুষ ধ্বংসের চর্চায় নির্ঘুম রজনী পোহায়? কেন চলার পথে সভ্যতা বেঁকে যায়? তাই তিনি গেয়েছেন-
‘অস্ত্র ভান্ডারের ছাদ ছুঁয়ে গেছে সভ্যতা বিনাশী মারনাস্ত্র / অদ্ভূত এদের নাম- মাভেরিক, ট্রাইভেন্ট, হারপুন / স্প্যারো, তমাহক, ব্যানটাম, অ্যাথ্রাক্স, ব্যাপটর, টাইফুন ইত্যাদি / মুহূর্তেও মাঝে ধ্বংস করে দিতে পারে একেকটি মহাদেশ।’ ইতিহাসজ্ঞান ও নান্দনিক প্রাকৃতিক সৃষ্টির রহস্য ও বিদ্রহের স্থিরতর শান্তি মিশিয়ে কবি স্থাপিত করেছেন তাঁর " বিমূর্ত রাতের ক্যানভাস" নামক কবিতাগ্রন্থ- তথা চিরন্তন সত্তাকে তুলে ধরেছেন ।