আমার আব্বা
পান্না আকন্দ
এ আমাদের ভিটেমাটি, এখানে আব্বা-আম্মা ও আমি থাকি।
এখানকার ঢেঁকিঘরে আমার জন্মের আঁতুড় পেতেছিল আম্মা
এখানের ধুলিমাখা পথেই বেড়ে উঠে আমার গতর, সেই থেকে
কাদামাটি মেখে কেটেছে আমার শৈশবের প্রতিটি বছর।
আব্বার কাঁধে লাঙল-জোয়াল, গরুর হাঁকে প্রতিটি ভোর
আর আম্মা নুয়ে পড়া বারান্দায় বসে কোরআন পড়তেন
জীবন তখনো বুঝিনি, দেখতাম আম্মা নীরবে কাঁদতেন।
সূর্য উপরে উঠতে উঠতেই জেগে উঠতো পাড়ার কৃষক
ভোরের শিশিরে পা ধুইয়ে পাড়ি দিত বিলের জমিতে
এ বিলের জমিটুকুই ঘিরে আমার ও আমাদের জীবন।
বেলা যখন মাথার উপর আব্বা ফিরতেন ক্লান্ত দেহে
রুপালি ঘামে ঝলমল করতো আব্বার দাড়িওয়ালা মুখখানি
ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে ডাকতেন মা-রে ওমা আমার
‘এক মগ পানি দাও মা, গলাটা শুকাইয়ে কাঠ হয়ে গেছে।‘
ইরিধান লাগানো শেষে, আব্বা গল্প করতেন আম্মাকে ডেকে
‘এবার ফসলের প্রথম মাড়াই থেকে বেঁচবো দুইমণ ধান
তোমার একটা শাড়ি ও একজোড়া পঞ্চের জুতা নিবো
আর আমার মায়ের জন্য দু-জোড়া পায়জামা কামিজ।‘
সবুজ জায়নামাজ পাতা ফসিলমাঠ হাসতো আব্বা দেখতেন
তৃপ্তির চোখে-মুখে থাকতো, গোলায় ফসল তোলার অপার স্বপ্ন,
বৈশাখে প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা শুরু হলে আব্বার বুক মুচড়ে যেতো
কিছু নিয়ে যেতো ঝড়ে, আর বাঁধভাঙা ঢলে আব্বার স্বপ্নের ফসল।
তখনো দেখিনি আব্বার চোখে-মুখে গ্লানি অথবা হাহাকার
আব্বা বলতেন - ‘যা হয়েছে সব উপরওয়ালার ইচ্ছায়’
আমারে বুকে টেনে বলতেন ‘মা’রে অগ্রহায়ণে ঝড় হয় না
আমাগো সরকার যদি ভরতুকি দেয়, তবে দিবো তোর জামা কিনে।‘
সেবার বর্ষায় বেতের পাটিতে আব্বা বুনতেন তার দুঃখগুলো
নিথর চোখে তাকিয়ে দেখতেন পাকাধান মাঠে থৈ থৈ পানি
বার বার অজুর ছলে আব্বা ঢাকতেন নীরব দুঃখের কান্না
আবারো কার্তিক’র ফসল রুপনের অপেক্ষা…
এভাবেই আব্বা পাড়ি দিয়েছেন জীবনের আশিটি বছর
আব্বার দেহ আজ নুয়ে পড়েছে, কপালে তার বলিরেখা
না না এতো বলিরেখা নয়! বয়সের ভাড়ে কুঁজো হওয়া নয়!
এ যে জীবনভর দুঃখ বহনের মানচিত্র আঁকা।
২৩ এপ্রিল ২০২০