বহুদিন পর আজ তাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন খুব কাছের কারো সঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বারটা ডায়াল করতে যাব, ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে উঠল। প্রথমে একটু চমকে উঠলাম। এত রাতে কে আসতে পারে?

ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, "কে?" কোন উত্তর নেই। একবার, দুবার, তিনবার জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। মনে এক অদ্ভুত ভয়ের সঞ্চার হল। এত বড় ফ্ল্যাট, আর আমি একা। কার সাথে এই মুহূর্তে কথা বলব, কার কাছে ভরসা পাব?

দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে, হ্যান্ডেলের দিকে হাত বাড়ালাম। বাইরে কী আছে, সেটা জানার জন্য আমার কৌতূহল বেড়েই চলেছে। অর্ধেক মনের জোর নিয়ে দরজার লক খুললাম, খুব ধীরে দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম। বাইরে কিছুই নেই। ফ্ল্যাটের করিডোরে সম্পূর্ণ নীরবতা। যেন চারপাশের সবকিছু নিঃশব্দ হয়ে গেছে।

ভয়ের মেঘ আমার মনের ওপর ছেয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম, আমি কি ভুল শুনেছি? হয়তো কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ত্রুটি। দরজা বন্ধ করেই আবার ভেতরে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম, কিন্তু অস্বস্তি কমল না।

ফোনটা হাতে নিলাম, আবার ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আবার সেই ডোরবেল। এবার আরও জোরে বেজে উঠল। দৌড়ে দরজার কাছে গেলাম, এবং পুরো দমে দরজা খুললাম।

বাইরে কিছু নেই। কেউ নেই। শূন্য করিডোরের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা শীতল অনুভূতি হলো। মনে হলো যেন কেউ অদৃশ্য হয়ে গেছে। দরজা বন্ধ করে আবার ফিরে এলাম ঘরে। এবার সত্যিই ভয়ে কাঁপছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন কেউ আমাকে দেখছে, কিন্তু আমি তাকে দেখতে পারছি না।

আমার মন খুব অস্থির হয়ে উঠল। একাই আছি, কেউ নেই পাশে। এমন সময় আবার ডোরবেল বেজে উঠল।

সাহস করে আবার দরজা খুললাম। এবারও কেউ নেই। তবুও, আমি ফ্ল্যাটের বাইরে পা বাড়ালাম। করিডোরে নেমে চারপাশটা দেখলাম। কোথাও কেউ নেই। ফিরে এলাম আবার ফ্ল্যাটে।

ফ্ল্যাটে ফিরে এসে দরজাটা ভালভাবে লক করলাম। এরপর চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার ফোনটা নেই। কিছুক্ষণ আগে তো হাতে ছিল। দরজার কাছে গিয়ে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও ফোনটা নেই।

মনে হলো যেন কেউ আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে গেছে। একা, ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকলাম। এভাবেই কাটল সারা রাত। সকালে দিনের আলো ফ্ল্যাটের মধ্যে প্রবেশ করল, তখনও ভয়ের কাঁপুনি কমেনি। দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম ফোনটা মেঝেতে পড়ে আছে।

তুলে নিলাম ফোনটা, আর ভাবতে লাগলাম সেই অদ্ভুত রাতের ঘটনা। এটা কি সত্যিই ঘটেছিল, নাকি শুধুই আমার কল্পনা?

যখন সেদিনের ঘটনা ভাবি, এখনও শরীর কাঁপে। সেই রহস্যময় ডোরবেলের আওয়াজ, সেই নিঃশব্দ করিডোর, আর সেই হারিয়ে যাওয়া ফোন—সবই আমার মনের ভেতরে গভীর ছাপ রেখে গেছে।

পরের দিন আমি কাজের ব্যস্ততায় ডুবে গেলাম, কিন্তু মনের মধ্যে সেই রাতের ঘটনার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তাড়া করে ফিরল। প্রতিটা মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল যেন কেউ আমাকে অনুসরণ করছে, কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। অফিসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারছিলাম না, মন সব সময় ফিরে যাচ্ছিল সেই রাতে।

একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবার সেই ভয়ের অনুভূতি গ্রাস করল। মনে হল যেন কেউ আমার আগমনের অপেক্ষায় আছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম ফ্ল্যাটের বাতি জ্বলছে, অথচ বের হবার সময় বন্ধ করেই গিয়েছিলাম। আরও অবাক হলাম যখন দেখলাম ডাইনিং টেবিলে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো পড়ে আছে।

কাগজটা তুলে দেখি, তাতে লেখা:

"আমরা তোমাকে দেখছি।"

হাত কাঁপতে লাগল। কে লিখল এটা? কেন লিখল? মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন। কোন কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। ফোনটা হাতে নিয়ে পুলিশকে কল করতে যাব, এমন সময় ফোনটা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন কারও অদৃশ্য হাত আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে গেল।

এবার ভয়টা আরও গভীর হয়ে গেল। ফোন ছাড়াই ফ্ল্যাটে একা, সাহায্যের কোন উপায় নেই। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বাইরেও কেউ নেই। পুরো পরিবেশ যেন আরও অদ্ভুত এবং রহস্যময় হয়ে উঠল।

রাতে খাওয়া-দাওয়া করতে ইচ্ছা করল না। সবকিছু এলোমেলো লাগছিল। ভয়ে রাতের খাবারটা ফেলে দিলাম। মনে হচ্ছিল যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভয়ের কারণে ঘুম আসছিল না। রাতের নীরবতা আরও ভারী হয়ে উঠল। প্রতিটা শব্দেই চমকে উঠছিলাম।

ঠিক মধ্যরাতে আবার সেই ডোরবেলের আওয়াজ। এবার আর সাহস করে দরজার কাছে গেলাম না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় বসে রইলাম। ডোরবেল বাজতেই থাকল, কিন্তু আমি আর উঠলাম না। মনে হচ্ছিল যেন কোন দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছি।

পরদিন সকালে উঠে দেখলাম দরজার নিচ দিয়ে আরও একটা কাগজের টুকরো ঢুকানো হয়েছে। এতে লেখা ছিল:

"আমরা চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমরা আবার আসব। প্রস্তুত থাকো।"

মনে হল যেন একটা বড় বোঝা বুক থেকে নেমে গেল। এতদিন পর প্রথমবারের মতো একটু স্বস্তি পেলাম। কিন্তু সাথে সাথেই আবার ভাবতে লাগলাম, এরা কারা? কেন আমাকে এইভাবে ভয় দেখাচ্ছে? কেন আমার ফ্ল্যাটকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে?

বাকী দিনগুলো কিছুটা স্বাভাবিকভাবে কাটালেও মনের মধ্যে সেই ভয়ের স্মৃতি থেকে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যিই কি ঘটেছিল সেই ঘটনা, নাকি শুধুই আমার কল্পনা? কিন্তু প্রতিবারই সেই কাগজের টুকরোগুলো প্রমাণ দেয়, এটা কল্পনা নয়, বাস্তব।

আজও আমি সেই রহস্যের সমাধান পাইনি। তবে একটাই কথা, আমি সবসময় প্রস্তুত থাকি, যেন আবার তারা ফিরে না আসে। সেই ভয়ের রাতগুলো আমার জীবনকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন আমি সবসময় সতর্ক থাকি, কারণ জানি, কেউ না কেউ সবসময় আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে।‌‌

একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার পেছন থেকে কেউ ডাক দিল, "মিস্টার আরিফ?" আমি ঘুরে তাকালাম, একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, চোখে চশমা, তার হাতে একটি নোটবুক।

"জি, আমি আরিফ," বললাম।

"আমার নাম সাইদ। আমি একজন সাংবাদিক। আপনার ফ্ল্যাটে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে বলে শুনেছি। আপনার সাথে এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই।"

আমি তাকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানালাম। ফ্ল্যাটে ঢুকে বসার পর, তিনি তার নোটবুক খুলে বললেন, "আমার কাছে কিছু তথ্য আছে। আপনার ফ্ল্যাটটি আগে একজন বিজ্ঞানীর ছিল। তিনি এখানে একটি গোপন গবেষণা করছিলেন। তবে, একদিন হঠাৎ করে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ তার খোঁজ পায়নি।"

এতদিন পর আমি কিছুটা কৌতূহল ও আশঙ্কায় তার কথা শুনছিলাম। "বিজ্ঞানী? কী ধরনের গবেষণা করছিলেন তিনি?"

"তা ঠিক জানা যায়নি, তবে মনে হয় কিছু প্যারানর্মাল বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন। স্থানীয়রা বলেন, তিনি একটি বিশেষ ডিভাইস তৈরি করেছিলেন যা মানব মনের গোপন ক্ষমতাগুলো উদ্ঘাটন করতে পারত।"

আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। "তাহলে আমার সাথে যা ঘটছে, তা কি তার গবেষণার ফল?"

"এটা হতে পারে," সাইদ বললেন। "তবে এর পেছনে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। আপনি যখন প্রথমবার ডোরবেলের আওয়াজ শুনেছিলেন, তখন কি কোন বিশেষ ঘটনার কথা মনে আছে?"

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। "হ্যাঁ, আমি তখন আমার পুরনো বন্ধুকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আমরা অনেক দিন ধরে কথা বলিনি।"

সাইদ মাথা নেড়ে বললেন, "আমি মনে করি, আপনার বন্ধুর সাথে আপনার কোন বিশেষ সংযোগ থাকতে পারে। আপনার বন্ধুটি কি কোনভাবে বিজ্ঞানী বা তার গবেষণার সাথে যুক্ত ছিল?"

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, "না, আমার জানা মতে নয়।"

সাইদ বললেন, "তাহলে হয়তো আপনার বন্ধু জানেন না যে তিনি কিছুর অংশ। আপনার সাথে কথা বললে হয়তো তিনি কিছু খুঁজে পাবেন। আপনি আবার চেষ্টা করতে পারেন?"

আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়লাম। এত ভয়ের পরও আবার সেই ঘটনার মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসল। সাইদকে বিদায় জানিয়ে আবার ফোনটা হাতে নিলাম। নম্বর ডায়াল করলাম, আর ফোনটা বাজতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধুর কণ্ঠ ভেসে এল, "হ্যালো, আরিফ? এতদিন পর!"

"হ্যালো, কেমন আছিস?" বললাম, মনটা তখনও উত্তেজনায় কাঁপছিল।

আমরা কিছুক্ষণ কথা বললাম, আর তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। আমি জানালা দিয়ে দেখলাম, বাইরে একজন ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আবার সেই ভয়ের অনুভূতি। বন্ধুকে বললাম, "ভাই, আমি তোকে একটা অদ্ভুত গল্প বলব।"

সবকিছু তাকে খুলে বললাম। শুনে সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, "আমি জানতাম না, কিন্তু আমার বাবার একজন বন্ধু ছিলেন বিজ্ঞানী। তিনিই হয়তো তোমার ফ্ল্যাটে কাজ করতেন।"

আমার বন্ধুর কথায় সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগল। সেই বিজ্ঞানী, তার গবেষণা, আর আমার বন্ধু—সবকিছুই যেন একটি পাজলের টুকরো।

আমার বন্ধু বলল, "আমি আমার বাবার সাথে কথা বলব। দেখি কিছু তথ্য পাওয়া যায় কি না।"

সেদিন রাতেই আবার ডোরবেল বেজে উঠল। এবার আমি প্রস্তুত ছিলাম। সাহস নিয়ে দরজা খুললাম, বাইরে সেই ছায়ামূর্তিটা দাঁড়িয়ে। সে আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে এল, আর বলল, "ভয় পেও না। আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।"

কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, সেই ছায়ামূর্তি আসলে বিজ্ঞানীর আত্মা। তিনি আমার মাধ্যমে তার অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে চান। তার কথায় আমার মনে কিছুটা স্বস্তি এল।

বিজ্ঞানীর নির্দেশনা মেনে আমি তার গবেষণার ফাইলগুলো খুঁজে বের করলাম। কয়েকদিন ধরে কাজ করে অবশেষে সেই ডিভাইসটা চালু করতে সক্ষম হলাম। বিজ্ঞানীর আত্মা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল।

এখন আমি সেই ডিভাইসের দেখাশোনা করি, যাতে এটি মানুষের মনের গোপন ক্ষমতা উদ্ঘাটনে সাহায্য করতে পারে। সেই রাতের ভয়াবহ স্মৃতি আজ আর ভয় নয়, বরং এক রহস্যময় অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে রইল।