শহরের নিঃসঙ্গ রাস্তাগুলো বয়ে যায় চুপচাপ নদীর পাশে। প্রাচীন পাথরের ঘ্রাণে মেখে থাকা শ্যাওলা জমেছে ব্রিজের পায়ে—
কেউ দেখেনা, কেউ বোঝেনা, কেউ শোনেনা পাথরের কথা।
জেগে ওঠা শীতল হাওয়ায় রাত্রির আলোর মতো—
নদীর বুক ভেসে আসে দুরন্ত ব্যথার ঢেউ।
প্রান্তরের নির্জন বৃক্ষেরা জেগে থাকে,
শূন্যতার আর্তি নিয়ে তারা ঝরায় পাতার মর্মর গান—
বিষণ্ণ নক্ষত্রেরা তেমনি লুকিয়ে থাকে ঘন মেঘের আড়ালে।
শহরের পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ দোকান,
পুরোনো পেঁচার ডাকে ঝিমিয়ে পড়ে।
ধূসর সময়ের কবিতা লেখা ছিলো ল্যাম্পপোস্টের শরীরে—
রাত্রি গভীর হলে তার ছায়া ঢেকে দেয় সব শব্দ,
সব স্মৃতি।
এখানে কেউ আসে না, শুধু একলা বাতাস খেলে যায়;
মায়াবী নদীর ছলছল ধ্বনি মনে করিয়ে দেয়—
শব্দেরও একা থাকা হয় কখনো কখনো।
কোনো ম্লান চাঁদের আলোয় ভাসমান কুমুদী—
নদীটি স্নিগ্ধতার শরীর গড়ে তোলে প্রতিদিন,
অন্তহীন সে ভাসে; প্রতিটি ঢেউ যেন কালের সাক্ষী।
নদীর কূলের বালি জড়িয়ে,
সে গড়ে তোলে নতুন নতুন অতীতের স্তূপ।
কতশত বছর পার হয়ে গেছে, কত জন্মও, তবু সে, নদীর অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শহরের ঘুম ভাঙেনি—
আলোর নিচে ঝুলে থাকা জোনাকিরা থেমে গেছে অনেক আগেই,
তারা শুধু জেগে থাকে অবসন্ন রাতের প্রহরী হয়ে।
কখনো হঠাৎ শোনা যায়—
কিশোর বয়সের খিলখিলানো হাসি,
বাতাসে ভেসে আসে অচেনা সুরের ঘ্রাণে—
তবু কেউ সেই পলকের আড়ালে হারায়,
নীরবতা ছুঁয়ে নদীর ঢেউ ফিরে আসে আবারও,
কখনোই জাগেনা সেই গোপন স্মৃতিরা।
পথের পাশে নির্জনতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা—
তাদের ছায়া আঁকা আছে নদীর বুকে— জলের নহরে,
তারা জানে না, কোথায় গেলে মুছে যায় নিঃশব্দ কান্না।
তারা শুধু ঘুমিয়ে থাকে দীর্ঘ সময়ের বুকে,
অপেক্ষা করে এক চিরন্তন ভোরের আলোর।
নদী জানে, শহরের বুকে কত ইমারত গড়ে ওঠে,
কত স্বপ্ন ডুব দেয় সময়ের ঢেউয়ে।
কেউ তাদের খোঁজ করে না, শুধু নদী দেখে যায়—
আলো আধাঁরের মিশ্রণে,
সে বয়ে চলে এক অনন্ত মায়া নিয়ে।
তবু রাতের আড়ালে, ঘুমন্ত জোছনার আলো জ্বলে—
শহরের প্রতিটি ঘুমন্ত আত্মা জানে না,
নদীও জানে না সে কাহিনি,
কত হাজার বছর ধরে সে মুছে দিয়েছে নিজেকে
কালের স্রোতে— শুধু রয়ে গেছে
নীরব নদীর দীর্ঘশ্বাস।
আর কিছুই নয়—
শুধু নদীর বুকে অজানা আলোর ক্ষণিকের ছায়া,
ফিরে ফিরে আসে এক বেহুলার বিলাপের মতো—
জীবনের ব্যর্থ প্রেমের মতো,
শহরের উদাসীন প্রেমিকের মতো,
নির্জন রাত্রির বুকে হিম শীতল বাতাসের মতো,
নদীর বুক ভেঙে দেয় এক গোপন ব্যথা—
তবু সে থামে না, থামতে জানে না—
শুধু বয়ে চলে,
বয়ে চলে,
একাকীত্বের গভীর গান নিয়ে,
মৃত্যুর চেয়ে একা আর কিছু নয়।