গভীর রাত, সারা পৃথিবী নিস্তব্ধ। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি বিছানায় শুয়ে আছি, বাইরে হালকা বাতাস বইছে। হঠাৎ করেই দরজায় টোকার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো, কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। এত রাতে কে এলো? আমার মনে অজানা ভয়ের স্রোত বইতে লাগল। হাত-পা কাঁপছে থর থর করে।

আমি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠলাম। চারদিকে তাকালাম, বাড়ির ভেতরে কোন সাড়াশব্দ নেই। শুধু বাইরের বাতাসের হালকা শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। দরজার দিকে এগোতে গিয়ে আমি যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। কৌতূহল আর ভয়ের মিশ্রণে আমার মন কাঁপছে। দরজার দিকে চোখ রেখে ধীরে ধীরে সামনে এগোলাম।

দরজার কাছে পৌঁছে আমি একটু থামলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। কিছু দেখা যাচ্ছে না, সবকিছু অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আমি আরও একবার দরজার পাশে কানে লাগালাম। কিছু শুনতে পাচ্ছি না, যেন চারদিক নিশ্চুপ।

মনে সাহস সঞ্চয় করে আমি দরজা খুললাম। দরজা খুলতেই একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল। আমি বাইরে তাকালাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। চারপাশে অন্ধকার, শুধু গাছের পাতা নড়ছে বাতাসে। আমার মনে হল, হয়ত সব কিছুর পেছনে একটা যুক্তি আছে। আমি দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আবার টোকা পড়ল দরজায়।

এবারে টোকা ছিল আরও জোরে। আমি আতঙ্কে পেছনে ফিরে তাকালাম। মনে হল, কাউকে দেখলাম দরজার ওপাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমি আবার দরজা খুললাম, কিন্তু এবারও কিছু দেখতে পেলাম না। হঠাৎ করে মনে হল, যেন কারো শ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। আমি আবার কানে লাগিয়ে শুনলাম, কিন্তু কিছু শুনতে পেলাম না।

হঠাৎ মনে হল, কোন অশরীরী আত্মা হয়ত আমার সাথে খেলছে। আমি ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেলাম, দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আবার টোকা পড়ল। এবার টোকা পড়ল খুব জোরে। আমি ভয়ে পেছনে সরে গেলাম, দরজা খুলতেই একটা তীব্র বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল।

বাতাসের সাথে একটা কাগজ উড়ে এসে পড়ল আমার পায়ের কাছে। আমি কাগজটা তুললাম, দেখলাম সেখানে কিছু লেখা আছে। লেখা ছিল, "তুমি একা নও।"

আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কে এই বার্তা দিল? কেন? আমি কাগজটা হাতে নিয়ে চারপাশে তাকালাম, কিন্তু কিছু দেখতে পেলাম না। ধীরে ধীরে কাগজটা পকেটে রেখে আমি দরজা বন্ধ করলাম।

পরদিন সকালে আমি কাগজটা নিয়ে বাইরে গেলাম। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সব ঘটনা জানালাম। পুলিশ আমার কথা শুনে ঘটনাস্থলে এল, কিন্তু কোন অদ্ভুত কিছু পেল না। তারা বলল, হয়ত এটা কোন মজা বা ভয়ের খেলা।

কিন্তু আমার মন সেদিন থেকেই আর শান্ত নেই। কাগজের বার্তাটা আমার মাথায় ঘুরছে। "তুমি একা নও।" এ কথার মানে কি? কে আমাকে এই বার্তা দিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই।

আমার জীবনে এই ঘটনাটা সবসময় একটা অজানা রহস্য হয়ে থেকে গেল। রাতের সেই টোকা, অজানা ভয় আর কাগজের বার্তা আমার জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে রইল।।

এই ঘটনার পর থেকে আমি রাতে ভালো ঘুমাতে পারি না। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়। মনে হয়, আমি যেন সব সময় কারো নজরে আছি। সময়ের সাথে সাথে আমার এই ভয় বাড়তে থাকে। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি এই ঘটনাকে ভুলে যেতে, কিন্তু পারি না।

একদিন, আমি একজন মনোবিদের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তিনি বললেন, হয়ত এটা আমার মনের ভুল, হয়ত আমি নিজেই আমার ভয়কে বড় করে দেখছি। কিন্তু আমি জানি, ওই রাতে যা ঘটেছিল তা শুধু আমার মনের ভুল নয়। মনোবিদ কিছু মেডিটেশন এবং রিলাক্সেশন টেকনিক শিখিয়ে দিলেন। এগুলো আমাকে কিছুটা সাহায্য করল, কিন্তু মন থেকে সেই ভয় মুছে যায়নি।

এরপর এক রাতে আবার টোকা পড়ল আমার দরজায়। এবার আমি আর ভয় পেলাম না। ধীরে ধীরে দরজা খুললাম। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, "তুমি একা নও।" আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এটা কি কোন দুঃস্বপ্ন? নাকি বাস্তব? বৃদ্ধা হাসিমুখে বললেন, "আমার সাথে এসো।"

আমি বৃদ্ধার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তিনি আমাকে গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা পুরনো বাড়ির দিকে নিয়ে গেলেন। বাড়ির সামনে একটা বড় গাছ ছিল, গাছের নিচে একটা পাথরের বেঞ্চে তিনি বসে পড়লেন। আমি তাঁর পাশে বসে জানার চেষ্টা করলাম, কেন তিনি আমাকে এখানে নিয়ে এলেন।

বৃদ্ধা বললেন, "তোমার ভয় তোমাকে গ্রাস করছে। তোমার মনের ভয়কে জয় করতে হবে।" আমি তাঁর কথা শুনে অবাক হলাম। তিনি জানালেন, তাঁর নাম প্রতিমা দেবী, তিনি একজন আধ্যাত্মিক গাইড। তিনি বললেন, "তোমার জীবনে যা কিছু ঘটে, তার পেছনে কোন না কোন কারণ থাকে। তোমাকে সেই কারণটা খুঁজে বের করতে হবে।"

প্রতিমা দেবীর কথায় আমার মনে কিছুটা সাহস এল। আমি তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ধীরে ধীরে আমার ভয়ের মুখোমুখি হতে লাগলাম। প্রতিদিন রাতে আমি একা বসে মেডিটেশন করতাম, নিজের ভয়কে অনুভব করতাম। কিছুদিন পর, আমি বুঝতে পারলাম, আমার ভয় আসলে আমার মনেরই সৃষ্টি।

এক রাতে, আমি আবার সেই কাগজটা হাতে নিয়ে বসে আছি। হঠাৎ মনে হল, বার্তাটা আসলে আমার নিজের মন থেকেই এসেছে। "তুমি একা নও।" এর মানে আমি বুঝতে পেরেছি, আমার মনই আমার সঙ্গী। আমার ভয়, আমার সাহস, সব কিছুই আমার মনের ভেতরে।

এই উপলব্ধি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। আমি বুঝলাম, আমি নিজেই আমার ভয়ের স্রষ্টা, আবার আমিই সেই ভয়কে জয় করতে পারি। প্রতিমা দেবীকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি ফিরে এলাম। এখন আমি রাতে শান্তিতে ঘুমাই। আমার ভয় আর আমাকে কাবু করতে পারে না।

প্রতিদিনের জীবন আবার স্বাভাবিক হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে সেই রাতের কথা মনে পড়ে, সেই টোকা, সেই বার্তা। আমি বুঝেছি, জীবনে যাই ঘটুক, সব কিছু আমাদের নিজস্ব মনের প্রতিফলন। "তুমি একা নও।" এটা শুধু একটা বার্তা নয়, এটা আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের শুরু।