এক বর্ষার জোসনা রাতে, আমি আর আমার বন্ধুরা ঠিক করলাম মধুমতি নদীতে নৌকায় ভ্রমণে বের হবো। নদীর দুই পাড়ে কাশফুল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, বাতাসে দোল খাচ্ছিল। এমন এক চমৎকার রাতে জোসনার আলোয় ভেসে যেতে কার না ভালো লাগে!

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্যমী ছিল আমির। সে বলল, "চল, আজ রাতে আমরা নদীর মাঝে যাব। নৌকা ভাড়া করবো, আর সারা রাত কাটাবো জোসনা উপভোগ করে।" সবাই তার কথায় সায় দিলাম। রাত তখন প্রায় আটটা, আমরা নদীর ধারে গেলাম। সেখানে ছোট একটি নৌকা ভাড়া করলাম।

নৌকায় চেপে বসতেই মনে হলো যেন এক রূপকথার জগতে চলে এসেছি। নদীর জলে জোসনার আলো চিকচিক করছে, কাশফুলের সাদা মাথাগুলো হাওয়ায় দুলছে। আমরা সবাই নৌকার ডেকে বসে গল্পে মেতে উঠলাম।

আমাদের সঙ্গে ছিল রিফাত, যার গল্প বলা খুব পছন্দ। সে শুরু করল, "জানো, এমন এক রাতে অনেক পুরনো কাহিনি শুনেছিলাম। এক রাজকুমারী ছিল, তার নাম ছিল চন্দ্রিকা। সে খুব ভালোবাসত নদীর ধারে বসে জোসনা দেখতে। একদিন সে এমনই এক রাতে তার প্রেমিক রাজকুমারের সাথে দেখা করতে বের হয়েছিল।"

সবাই রিফাতের গল্পে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। তার কাহিনিতে মুগ্ধ হয়ে আমরা নদীর মাঝখানে চলে এলাম। নৌকার মাঝি হাসান চাচা বললেন, "আপনারা নদীর মাঝখানে এসে পড়েছেন। এখানকার পরিবেশ একদম অন্যরকম।"

হাসান চাচার কথা সত্যি। নদীর মাঝখানে এসে চারপাশের দৃশ্য যেন আরো রোমান্টিক হয়ে উঠল। নদীর জল থেকে ভেসে আসা হালকা হাওয়া, জোসনার মিষ্টি আলো, কাশফুলের দোল খাওয়া সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্নের রাজ্যে চলে এসেছি।

আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার পাশের সিটে বসা নীলার মুখে এক অদ্ভুত হাসি। নীলা আমার কলেজের বন্ধু, আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "নীলা, তুমি কি ভাবছো?"

নীলা হেসে বলল, "কিছু না, এমন রাতের জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। এমন পরিবেশে বসে মনের কথা বলার মতো সুন্দর কিছু আর হয় না।"

নীলার কথা শুনে আমারও মনে হলো, সত্যিই তো! কতদিন আমরা ব্যস্ততার মাঝে কাটিয়েছি, প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সুযোগ হয়নি। আমরা সবাই আবার গল্পে মেতে উঠলাম, হাসাহাসি, গানবাজনা সবকিছু মিলিয়ে মুহূর্তগুলো হয়ে উঠল অসাধারণ।

কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই নীরব হয়ে গেলাম। নৌকা ধীরে ধীরে ভেসে চলল, জোসনার আলোয় নদীর জল মায়াময় হয়ে উঠল। আমি আর নীলা ছাউনির এক পাশে গিয়ে বসলাম। আমাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না, শুধু নদীর হাওয়া আর কাশফুলের মৃদু দোল খাওয়া দেখতে দেখতে সময় কাটছিল।

নীলা হঠাৎ বলে উঠল, "জানো, এমন একটি রাতে আমার মনে হয় প্রকৃতির সাথে আমাদের এক অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। আমরা যতই ব্যস্ত থাকি, প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্য আমাদের মুগ্ধ করে রাখে।"

আমি বললাম, "তুমি ঠিক বলেছো, নীলা। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্যই আমাদের মনের শান্তি এনে দেয়।"

নীলা হেসে বলল, "তাহলে আমরা কি আজ সারারাত এখানে কাটাবো?"

আমি বললাম, "কেন নয়? চল, আজ রাতটা আমরা প্রকৃতির সাথেই কাটাই।"

আমাদের এই কথার মাঝে হাসান চাচা বললেন, "আপনাদের গল্প শুনতে শুনতে আমারও মন ভরে গেছে। আজ রাতটা আপনারা উপভোগ করুন।"

রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসছিল, কিন্তু জোসনার আলো আমাদের ভাসিয়ে নিচ্ছিল। আমরা সবাই একসাথে গান গাইতে লাগলাম, নৌকা নদীর বুকে ভেসে চলল। চারপাশে শুধু কাশফুলের সাদা রঙ আর জোসনার মিষ্টি আলো। এমন রাত আমরা আগে কখনো কাটাইনি।

আমির বলল, "জানো, আমাদের এই নৌকা ভ্রমণ আমাদের সবার জীবনে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এই মুহূর্তগুলো আমরা চিরকাল মনে রাখব।"

রাত গভীর হলেও আমাদের আনন্দের কোনো কমতি ছিল না। নৌকার ছাউনিতে বসে আমরা গানের সুরে মেতে উঠেছিলাম। আমির তার গিটার নিয়ে এসে বাজাতে শুরু করল। নীলার কণ্ঠে গান ভেসে এলো:

"জোসনা রাতে তুমি আমি,
নদীর তীরে বসে,
স্বপ্ন দেখি আমরা দুজন,
সাথী সাথী হয়ে।"

নীলার কণ্ঠে যেন একটা মায়াবী জাদু ছিল, যা আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করে রাখল। আমরা সবাই তার গানের সাথে গলা মেলালাম। নদীর স্রোতের সাথে মিশে গানের সুর আরও মধুর হয়ে উঠল।

রিফাত হঠাৎ বলে উঠল, "আমাদের সবার কিছু না কিছু স্বপ্ন থাকে, তাই না? এই রাতটা যেন আমাদের সেই স্বপ্নের প্রতীক হয়ে উঠেছে।"

নীলা মৃদু হেসে বলল, "হ্যাঁ, রিফাত। আমাদের সবার মনে হয় কিছু না কিছু লুকানো স্বপ্ন থাকে। আজকের এই রাত যেন সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন।"

আমির গিটার বাজাতে বাজাতে বলল, "তাহলে চল, আজ আমরা সবাই নিজেদের স্বপ্নের কথা বলি। কে কি স্বপ্ন দেখে, কিসের জন্য আমাদের হৃদয় স্পন্দিত হয়।"

প্রথমে আমি কথা বললাম। বললাম, "আমি সবসময় চাই একটা সুন্দর পরিবার, একটা শান্তিময় জীবন। এই নদীর মতো মসৃণ আর শান্তিপূর্ণ।"

নীলা বলল, "আমার স্বপ্ন হলো একদিন একজন সফল শিল্পী হওয়া, যার ছবি সারা বিশ্বে পরিচিতি পাবে। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমার ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে চাই।"

রিফাত বলল, "আমার স্বপ্ন হলো পৃথিবী ঘুরে দেখা, নতুন নতুন জায়গা আর মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া। তাদের গল্প শুনে আমার নিজের গল্পের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা।"

আমির বলল, "আমার স্বপ্ন হলো কবিতা ও গল্প, উপন্যাসের নিয়ে কাজ করা। এমন গল্প তৈরি করা ইচ্ছে আছে মনে যা কিনা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।"

আমাদের কথাগুলো শুনে হাসান চাচা মৃদু হেসে বললেন, "তোমাদের স্বপ্নগুলো খুব সুন্দর। আমারও এক সময় অনেক স্বপ্ন ছিল, কিন্তু জীবন আর নদীর স্রোতের মতো সব কিছু বদলে যায়। তবে আজকের এই রাতের মতো কিছু মুহূর্ত আমাদের স্বপ্নগুলোকে জাগিয়ে তোলে।"

আমাদের সবার মনে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি হলো। এমন রাতে আমাদের স্বপ্নের কথা বলা, নিজের ইচ্ছা আর আকাঙ্ক্ষার কথা শেয়ার করা যেন আমাদের আরও কাছাকাছি এনে দিল।

রাত আরও গভীর হলো, আমরা সবাই নদীর তীরে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের মন তখনও সেই রোমান্টিক রাতের মায়ায় বন্দী ছিল।

নীলা হঠাৎ আমার হাত ধরে বলল, "তুমি জানো, আজকের রাতটা আমি কখনো ভুলবো না। এই জোসনা, এই নদী, এই স্বপ্নের রাত আমার হৃদয়ে চিরকালের জন্য গেঁথে থাকবে।"

আমি মৃদু হেসে বললাম, "আমিও নীলা, আমাদের এই মুহূর্তগুলো চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের বন্ধুত্ব, আমাদের স্বপ্ন সবকিছুই যেন আজকের এই রাতের মতোই সুন্দর আর মধুর হয়ে উঠুক।"

নৌকা ধীরে ধীরে তীরে এসে ভিড়ল। আমরা সবাই নদীর ধারে নেমে দাঁড়ালাম, জোসনার আলো এখনও নদীর জলকে রূপকথার মতো করে রেখেছিল।

আমির বলল, "আজকের রাত আমাদের সবার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। এই স্মৃতিগুলো আমরা চিরকাল মনে রাখব।"

সবাই একসাথে সম্মত হলাম। আমরা সবাই একসাথে নদীর তীর ধরে হাঁটতে লাগলাম, আমাদের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত মায়াবী অনুভূতি। জোসনার আলো, কাশফুলের দোল খাওয়া, নদীর হাওয়া সবকিছু মিলে আমাদের এই রাতটাকে এক চিরন্তন রোমান্টিক গল্প করে তুলল।