দিনের আলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিম আকাশে সূর্যের শেষ কিরণগুলি মিশে যাচ্ছিল গোধূলির রঙিন আলোর সাথে। ধীরে ধীরে রাতে অন্ধকার নেমে এলো, সরু রাস্তায় আমি একাই চললাম। মাঝে মাঝে খড়মড় শব্দে ভয়ে আমার হাত পা শিউরে উঠে। জনমানুষ শুনশান রাস্তা, আশেপাশে কেউ নেই।

এমন সন্ধ্যাবেলা যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে নিজের রূপ বদলাচ্ছে, তখনই আমাকে বাড়ি ফিরতে হচ্ছিল। গ্রামে আমাদের বাড়িটা বেশ পুরনো। শহরের কাজ শেষ করে অনেকটা রাতেই ফিরতে হয়। অন্ধকারে এই সরু রাস্তাটা পেরিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়, আর এই রাস্তা সবসময় ভীতিকর মনে হয়।

আমি একা একা হাঁটছিলাম। ভেবে দেখলাম, এমন অন্ধকারে হাঁটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হলো? কিন্তু আর কোনো উপায়ও তো নেই। গ্রামটা এতটাই নির্জন যে, সন্ধ্যার পর খুব কমই মানুষ বের হয়। রাস্তাটার দুধারে ঘন গাছপালা, জঙ্গল যেন রাস্তার ওপর ঢেকে আসে। আমি দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম, যেন দ্রুত বাড়ি পৌঁছাতে পারি।

মাঝে মাঝে পায়ের নিচে শুকনো পাতার খড়মড় শব্দে আমি থেমে যাই। মনে হয় যেন কেউ আমার পেছনে হাঁটছে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়, কিন্তু সাহস করে আবার হাঁটা শুরু করি। ভাবি, এই হয়তো আমার কল্পনা, বাস্তবে তেমন কিছুই নেই।

হঠাৎ, একটি মেঘাচ্ছন্ন রাতে রাস্তার ধারে একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। মনে হলো কেউ একজন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে আমার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হতে লাগলো। কিন্তু আমি সাহস করে সামনে এগিয়ে গেলাম।

"কে...কে আপনি?" আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করলাম।

কোনো উত্তর পেলাম না। ধীরে ধীরে আমি আরো কাছাকাছি গেলাম। হঠাৎ সেই ছায়ামূর্তিটি হাওয়ার মত অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার মনে হলো, আমি হয়তো ভুল দেখেছি। কিন্তু ততক্ষণে আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে।

আবার হাঁটতে শুরু করলাম। মনে হলো, পেছনে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। পেছনে ফিরে তাকালাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। আবার সামনে চলতে শুরু করলাম। একটু পরেই সেই একই খড়মড় শব্দ আবার শুনতে পেলাম।

রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে দুটি রাস্তা বাড়ির দিকে যায়, একটি ছোট্ট বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে, আরেকটি একটু বড় রাস্তা দিয়ে। বাঁশঝাড়ের রাস্তাটি একটু শর্টকাট, কিন্তু সেখানে যেতে ভয় লাগে। আজ সাহস করে সেই শর্টকাট রাস্তাই নিলাম।

বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হলো, পেছন থেকে কেউ আমাকে ডাকছে। "এই যে!" আমি থেমে গেলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম। কোনো মানুষ নেই, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। কিন্তু কণ্ঠটা পরিষ্কার শুনতে পেলাম। এটা কি আমার কল্পনা?

ভয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করলাম। বাঁশঝাড়ের মাঝামাঝি পৌঁছালে আবার সেই ডাক শুনতে পেলাম, এবার একটু জোরে। "এই যে! শুনছেন না?" এবার আর সাহস করে পেছনে তাকাতে পারলাম না। দৌড়াতে শুরু করলাম, যেন আমার প্রাণের মায়া নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে পারি।

বাঁশঝাড়ের শেষে এসে যখন রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন কিছুটা স্বস্তি পেলাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছালাম। এবার আর পেছনে তাকাবো না, এমন প্রতিজ্ঞা করলাম। হঠাৎ, আমার সামনে এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়ালেন। "তুমি কেন এত দেরি করছো?" বৃদ্ধার প্রশ্নে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

"ক...কেন, আপনি কে?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

"আমি এই গ্রামের বাসিন্দা। এই রাস্তায় একা একা হাঁটা খুব বিপজ্জনক। তুমি কি জানো না, এখানে অনেক ভৌতিক ঘটনা ঘটে?" বৃদ্ধা বলে উঠলেন।

আমি তার কথায় অবাক হলাম। "আপনি কেমন ঘটনা বলছেন?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

"অনেক বছর আগে এই রাস্তায় এক মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে সে আত্মা এখানে ঘোরে। অনেকেই তাকে দেখেছে, কিন্তু কেউ তার রহস্য ভেদ করতে পারেনি।"

আমার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। "আপনি কি কখনও দেখেছেন?" আমি কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করলাম।

"হ্যাঁ, আমি দেখেছি। সেই মেয়েটি আমার মেয়ে ছিল। আজও আমি তার অপেক্ষায় থাকি।" বৃদ্ধার চোখে জল দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তিনি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। বাড়িতে পৌঁছানোর পরও আমি সেই ঘটনার কথা ভুলতে পারলাম না। বৃদ্ধা কি সত্যি ছিলেন, না কি আমি কল্পনা করেছিলাম? সেই প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পেলাম না।

কিন্তু সেই রাতের পর থেকে আমি জানলাম, আমাদের চারপাশে এমন অনেক রহস্য আছে, যা আমরা জানি না। অন্ধকারের ছায়ায় লুকিয়ে থাকে অজানা কাহিনী, যা আমাদের কল্পনার বাইরে। সেই রাতে আমি বুঝলাম, জীবনের অনেক রহস্য হয়তো কখনোই উন্মোচিত হবে না।

সেই রাতের অভিজ্ঞতা আমাকে নতুন কিছু শিখিয়েছিল। জীবনের অনেক ঘটনাই আছে, যেগুলো আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না, আর এইসব ঘটনাগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে প্রকৃত রহস্য।

পরদিন সকালে আমি গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের সামনে কয়েকজন বৃদ্ধ বসে ছিলেন। তাদের কাছে রাতের ঘটনা বললাম। শুনে তারা গভীর চিন্তায় পড়লেন।

একজন বৃদ্ধ বললেন, "তুমি যে বৃদ্ধার কথা বললে, তিনি হয়তো মেঘলা মাসি। বহু বছর আগে তার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল এই রাস্তায়। তার পর থেকে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। এখন হয়তো তার আত্মা এই রাস্তায় ঘোরাফেরা করে।"

আমি অবাক হয়ে শুনলাম। বৃদ্ধা সত্যি ছিলেন? তাদের কথায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। গ্রামের অনেকেই মেঘলা মাসির কথা জানতেন, আর তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা শোনেনি এমন কেউ নেই।

বিকেলে আমি বাড়ির পুরোনো আলমারি খুলে দেখলাম, সেখানে কিছু পুরোনো ছবির অ্যালবাম আছে। একটি অ্যালবামে মেঘলা মাসির ছবি পেলাম, সঙ্গে তার মেয়ের ছবিও। ছবির মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, যেন তাকে কোথাও দেখেছি। হঠাৎ মনে পড়ল, সেই ছায়ামূর্তি! ছবির মেয়েটির মুখ হুবহু মিলে যাচ্ছে।

মনে হলো, এই রহস্যের পিছনে আরও কিছু আছে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মেঘলা মাসির মেয়ের খোঁজে আরও কিছুদিন অনুসন্ধান করবো। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো? গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

পরের দিন সকালে আমি গ্রামের প্রধানের বাড়ি গেলাম। প্রধান কাকু আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তিনি বললেন, "মেঘলা মাসির মেয়ের হারানোর পর অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছিল। কেউ জানে না সে কোথায় গেল। কিন্তু অনেকের মতে, সে হয়তো জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল।"

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "কেউ কি তাকে দেখেছে?"

প্রধান কাকু বললেন, "অনেকেই বলেছে, তারা মেয়েটির ছায়ামূর্তি দেখেছে। কিন্তু কেউই নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেনি।"

আমি ভাবলাম, জঙ্গলেই হয়তো মেয়েটির রহস্য লুকিয়ে আছে। একদিন সাহস করে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক পুরোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। বাড়ির ভাঙা দরজার সামনে দাঁড়ালাম, মনে হলো এই বাড়ির মধ্যেই হয়তো মেয়েটির রহস্য লুকিয়ে আছে।

বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখলাম, ভাঙাচোরা দেয়ালে কিছু পুরোনো ছবি টাঙানো আছে। ছবিগুলির মধ্যে একটি ছবিতে মেঘলা মাসির মেয়ের ছবি পেলাম। ছবি দেখে আমার মনে হলো, এখানেই সে ছিল।

বাড়ির এক কোণে একটি পুরোনো বাক্স পেলাম। বাক্সের মধ্যে কিছু পুরোনো চিঠি ছিল। চিঠিগুলি পড়তে গিয়ে জানলাম, মেয়েটি আসলে একটি গোপন প্রেমের সম্পর্কে ছিল। সেই সম্পর্কের কারণে সে পালিয়ে এসেছিল এখানে। কিন্তু তার প্রেমিক তাকে প্রতারণা করেছিল, যার ফলে সে দুঃখে এই জঙ্গলের বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিল।

চিঠিগুলি পড়ে আমি শিউরে উঠলাম। মেঘলা মাসির মেয়ের এই করুণ পরিণতির গল্প শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সে কেন এমন করেছিল? কেন তার প্রেমিক তাকে এমনভাবে প্রতারণা করেছিল?

আমি চিঠিগুলি নিয়ে ফিরে এলাম গ্রামে। প্রধান কাকুকে চিঠিগুলি দেখালাম। তিনি চিঠিগুলি পড়ে বললেন, "এতদিন ধরে আমরা জানতাম না, আসলে কী ঘটেছিল। এই চিঠিগুলি আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিলো।"

গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়লো। সবাই মেঘলা মাসির মেয়ের গল্প শুনে দুঃখিত হলেন। আমি গ্রামের মানুষদের বললাম, "আমরা মেঘলা মাসির মেয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি স্মৃতিফলক তৈরি করবো। তার আত্মা যেন শান্তি পায়।"

গ্রামের মানুষরা সম্মত হলেন। আমরা মেঘলা মাসির মেয়ের স্মৃতিতে একটি সুন্দর স্মৃতিফলক তৈরি করলাম। সেখানে তার নাম এবং তার কাহিনী লিখে রাখলাম।

এরপর থেকে সেই রাস্তায় অন্ধকারে আর ভয়ের ছায়া পড়ে না। মনে হয়, মেঘলা মাসির মেয়ের আত্মা শান্তি পেয়েছে। গ্রামের মানুষরাও তার কাহিনী জানার পর থেকে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করলেন।

এভাবেই একটি রহস্যের অবসান ঘটলো। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই লুকিয়ে থাকে কিছু না কিছু রহস্য। সেই রহস্যগুলো কখনো আমাদের ভীত করে, কখনো আমাদের নতুন কিছু শেখায়। আর সেই রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য।