প্রতিমা
   ✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য


ভালোবেসে যারে রেখেছি ঘিরে আমার চেতনায়, আমার
যাতনায়, এবং ভাবনায়, তার হৃদয়ের দ্বার আমার জন্য
চিরকালই রুদ্ধ।
তাই প্রিয় হয়ে প্রাণে প্রবেশের সৌভাগ্য, আমার কোনদিন
হয়ে ওঠেনি।
প্রয়াস যেমনি হক ইচ্ছা-অপূর্ণতা মনের দারিদ্র্যতা সত্য,
আর সত্য প্রকাশ করা কোন অপরাধ নয়।
যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তবে পৃথিবীর সকলেই অপরাধী।


তোমার দৃষ্টিকোণ হতে যে সাজা ধার্য করেছো, তা জীবন ভর
বহন করে আত্মনিবেদনে এবং সমর্পণে যে পূজারী দিনরাত
প্রেমের পদচারণে ললাট ঠুকিয়ে রক্ত দান করে,
তার সম্মুখে রুদ্রাণী রূপে মুখ ঘুরিয়ে থাকাটা বোধহয়
বোধগম্য নয়।


তবুও তারে আমি শরৎ প্রাতে, মাধবী রাতে,এমন কি সর্বক্ষণে  
অশ্রুজলে বন্দনা করি।
পুষ্প সজ্জায় সাজিয়ে দেবী রূপে রূপান্তরিত করে, প্রদীপ
জ্বালিয়ে আরতি শেষে লিখি কলমের কালিতে কত কবিতা।
শুধু কি তাই? পাথর কে করেছি ক্ষত, শিল্পী নন্দিত ভাস্কর্যে
গড়েছি তার মূর্তি।


কিন্তু ওই যে, যে প্রেম যত গভীর প্রকাশ ও তত কম।
দুর্বলতা ও করুণা শূন্য হৃদয় কখনো প্রেমের সঠিক অনুভব
এবং উপলব্ধি করতেই পারে না।
যদিও প্রেম প্রকাশ করার বস্তু নয় তবুও কিঞ্চিত মোহ মনে
ধারণ করে ছুটে যাই, দর্শন হেতু মনের তৃপ্তার সন্ধানে।


আর এখানেও নত হয় মন, কম্পন জাগে সর্ব শরীর জুড়ে।
সারা রাত জেগে যত কল্পনা চোরা বালুচরে স্তূপ গড়ি,
নিমেষেই ভেঙে পড়ে আমার নত মস্তকের ভারে।
চোখে-চোখ রাখা, আর হাতে-হাত রাখা কি এতটাই সহজ?
আমি তো শুধু শিউলি তলে নত চিত্তে দুলে ভিক্ষা চাইতে
পারি, বৃক্ষ নাড়িয়ে শিউলি ঝরাতে নয়।
ফুল কবে ফুটবে, আর কবে করবে সুগন্ধ বিস্তার,
তা জানা শুধু ফুলের অধিকার, মোহবশে ফুল ছিঁড়তে যাওয়া
পূজারীর যে সভা দেয় না।


তাই ভালোবেসে চরণে শুধু নূপুর পরিয়ে দেওয়া যেতে পারে,
নূপুরধ্বনি শুনতে শুনতে অধিকার ফোলানোটা নয়!
তবে পূর্ণতা নূপুরের হয়, নূপুর পরানো কারির নয়।
সারাটি জীবন শিশির হয়ে তাই ঝরে পড়েছি সবুজ ঘাসে,
প্রভাতে পথ চলতে গিয়ে তোমার চরণ রাঙানোর প্রত্যাশায়।
কিন্তু তুমি কখনো খেয়াল করনি, ও-যে কেবল পুঞ্জীভূত  
জলীয়বাষ্প নয়, কারো প্রাণের প্রেম এবং বুকের রক্ত মিশ্রিত
অশ্রুধারা।


তৃপ্ত মনে পূর্ণ জীবন ধরে যে ফুল অমৃত সুগন্ধ বিস্তার শেষে
ঝরে পড়ে পথে, তাকেও কারো না কারো চরণে দলিত হতে
হয়।
এখানে না আছে পথচারীর ফুলের উপর অবহেলা,
আর না আছে ফুলের মূর্খতা, এখানেই আছে শুধু মূল্যহীন
অযোগ্যদের দলিত হওয়ার আক্ষেপ।


তাই নিজেকে অযোগ্য জীর্ণ ফুল ভেবে ঝরে পড়েছিলুম পথে,
কোনদিন যদি মনের ভুলে সে এই পথে আসতো,
তবে সেদিন তার পদচারণ পেয়ে বলতাম আমি ধন্য হলাম,  
আমি ধন্য হলাম।


জনম আমার আনন্দ ঘন হয়ে উঠিনি কখনো,
কঠিন থেকে কঠিনতর আঘাত আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে
কয়লা করে দিয়েছে।
একদিকে অনাহার সম সংসারে দারিদ্রতা, অন্যদিকে তুমি।
তবু হৃদয়ে প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বলিয়ে, আমি এক ক্ষত রক্তাক্ত
যোদ্ধা নিজের পরাজয়কে আপস করে নিয়েছি।


তুমি একে জীবন বলো? লক্ষ মানুষের প্রাণ নিষ্কাশন যার
সম্মুখে দিনে রাতে হয়, নীরব হয়ে থাকাটা নিশ্চয় জীবিত
মানুষের কাজ নয়।
তবুও আমি তোমাকেই আপন করে, তোমার দুয়ারে মাথা
ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে  নিজেকে শাস্তি দেবার মাঝে আনন্দ খুঁজি।


ব্রহ্মা বিদ্যা প্রাপ্তি শেষে যুদ্ধ যদিও করে থাকি, তবে আজ
প্রেমের জ্ঞান প্রাপ্তিতে আমি বাল্মীকি অংশে কম নয়।
আজ জেনেছি জীবনকে চিনতে শেখায় প্রেম,
প্রেমে না আছে অহংকার, না আছে জীবনের প্রতি মোহ।
ক্ষমা-মুক্তি জীবন দানে প্রেম পদ্মফুল ফুটিয়ে  ঝিলের জলে
ভাসিয়ে রাখে পুরাতন সব স্মৃতি।


ওগো তুমি কিছু-কিছু শব্দকে ঘিরে বেঁচে থাকার প্রেরণা প্রদান
করছো বলে, এখনও আপন মনে হেসে কেঁদে অশ্রু ঝরিয়ে
শৃঙ্গির শিখরে দাঁড়িয়ে তোমায় নাম ধরে ডাকতে পারি।
বলতে পারি, আমি পেয়েছি তোমায় আমার কবিতায়,
এবং বুকের রক্তে ও অশ্রুজলে তুমি থাকবে চিরকাল।


যদিও এখনো রাতে ঘুম আসে না, চাঁদ দেখি আর ফুলের
বনে পায়চারি করি হারানো সেই সু-গন্ধের খোঁজে।
যদিও পরিচিত মুখ, তবুও সে নিদ্রায় নিমজ্জিত হয়ে লুকিয়ে
পড়ে সমাধির অন্তরালে।
তাই ছুটে যাই প্রতিক্ষণে স্মৃতিবিজড়িত প্রাণে, সম্মুখ হবার খুব
ইচ্ছা।
কনিষ্ঠা ধরে বলতে চাই হৃদয় উজাড় করে জমানো সব কথা।
কিন্তু সে তো নিষ্প্রাণ প্রতিমা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজ
আনন্দলোকে, তাই গড়ছি নিজ সমাধি প্রভাত আলোকে।


✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য
রচনাকাল ইং-৫ অক্টোবর ২০১৯ সাল
বাংলা- ২০ আশ্বিন ১৪২৬ বঙ্গাব্দ.. (শনিবার)
দাকোপ খুলনা, বাংলাদেশ।