ছেদ ও যতি চিহ্নের ব্যবহার
ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
গত ০৮/০৯/২০১৬ তারিখে আলোচনা বিভাগে আমি “বাংলা বানান এবং ছেদ যতি প্রসঙ্গে” একটা লেখা দিই। লেখাটি আদৃত হয়। এই লেখায় অনেক প্রিয় কবি মন্তব্য দেন। সেখানে কবি সৌমেন চৌধুরি এবং মিমি ছেদ যতি চিহ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করতে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বলি, এই বিষয়ের উপর আমাদের আসরের কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল একাধিক লেখা দিয়েছেন। তার ০৯/১০/২০১৪ তারিখে লেখা “বানান বিভ্রম ও সঠিক যতি চিহ্নের ব্যবহার”, ০৬/১১/২০১৫ তারিখের “কবিতা লেখার নিয়ম-কানুন” এবং ১৪/০৫/২০১৬ তারিখের “কবিতায় বানান ও যতিচিহ্নের গুরুত্ব” সকল পাঠকের পড়ে নেওয়া প্রয়োজন। আমার লেখায় শ্রদ্ধেয় কবি ও প্রাবন্ধিক অনিরুদ্ধ বুলবুল একটি স্থানে বলেছেন - "সর্বোপরি একটি লেখা কী অর্থ বহন করছে সে দিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। অনেকেই বেশ কবিতা লেখেন, অথচ  দু-ছত্র বক্তব্য বা আলোচনা মন্তব্য কিছু লিখতে গেলেই বিপত্তি - তড়বড়  করে কী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেলেন তা আর পিছন ফিরে দেখেন না। অনেকেই পূর্ণ বাক্যটি পর্যন্ত প্রকাশ করতে না পেরে কতক 'ডটস' দিয়েই খালাস। নিন এবার, যা বোঝার বুঝে নিন। কেউবা যা লেখেন মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝার উপায় নেই”। আবার অন্যত্র বলেছেন- “কবির অবগতির জন্য বলছি - যতি চিহ্নের ব্যবহারের কোনো বাঁধাধরা শাশ্বত নিয়ম নেই যে তা অঙ্কের ফর্মুলার মতো মিলিয়েই বসাতে পারবেন। এটা একান্তই লেখকের বোধ ও প্রকাশের সাবলীলতা মাত্র - যা আর্টের পর্যায়ে পড়ে। শিক্ষিত রুচিশীলের কাছ থেকে সবাই যেমন মার্জিত ও পরিশীলিত আচরণ  আশা করে তেমনই একজন লেখকের কাছ থেকেও পাঠক একটা পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত লেখনী আশা করে। এর জন্যে পত্র পত্রিকা সহ ভাল লেখকের লেখা বিশেষ মনোযোগে পড়ার চর্চা প্রয়োজন”।অনিরুদ্ধ বুলবুল কে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি এ বিষয়ে সহমত পোষন করে উপরের সব দিকে খেয়াল রেখে  ছেদ যতি বা বিরাম চিহ্ন নিয়ে একটু আ্লোচনা করছি।
গদ্য- পদ্য উভয় রীতিতেই বিরাম চিহ্নের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, বাংলায় ছেদ চিহ্ন যথাযোগ্য ভাবে রক্ষিত নাহলে বাক্যের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। যেমনঃ “তোমার সেখানে যাওয়া উচিত, না গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে”। আবার “তোমার সেখানে যাওয়া উচিত না, গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে”। বাক্যটিতে কমা (,) চিহ্নের স্থান পরিবর্তনে অর্থের বিপর্যয় ঘটে গেল। বস্তুত ছন্দ শাস্ত্রে ছেদ ও যতি সমার্থক নয়। ছেদের প্রয়োজন অর্থ প্রকাশের জন্য, আর যতির প্রয়োজন জিহ্বার বিশ্রামের জন্য।
বর্তমানে যে সকল বিরাম চিহ্ন ব্যবহৃত হয় সে গুলি নিম্নরূপঃ
ক) দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ (।)
বাক্যের অর্থ যেখানে সম্পূর্ণতা লাভ করে সেখানে এই চিহ্ন বসে। এই চিহ্নের পর নতুন বাক্য শুরু হয়।
খ) অর্ধচ্ছেদ বা সেমিকোলন (;)
একটি বড়ো বাক্যের মধ্যে একাধিক ছোটো বাক্য থাকলে, সেই ক্ষেত্রে ছোটো বাক্যের শেষে এই চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। অর্ধচ্ছেদের বিরামকাল পূর্ণচ্ছেদের চেয়ে কম।
গ) পাদচ্ছেদ বা কমা (,)
সংক্ষিপ্ত বিরাম বোঝানোর জন্য এই চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। অপূর্ণ বাক্যাংশের শেষে,একাধিক পদের উল্লেখে, সম্বোধন করতে, সাল- তারিখ- ঠিকানা- উপাধি উল্লেখ করতে,উদ্ধৃতি চিহ্ন প্রয়োগের আগে এই চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। পাদচ্ছেদের বিরামকাল অর্ধচ্ছেদের চেয়ে কম।
ঘ) জিজ্ঞাসা চিহ্ন (?)
প্রশ্ন করা বোঝাতে গেলে বাক্যের শেষে প্রশ্ন – চিহ্ন দিতে হয়। এই চিহ্নে ও পূর্ণচ্ছেদের মতো থামতে হয়।
ঙ) বিস্ময়সূচক চিহ্ন (!)
মনের আনন্দ, ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা, বিস্ময়, বিষাদ, বিরক্তি প্রভৃতি অনুভুতি প্রকাশে বাক্যের সমাপ্তিতে এই চিহ্ন ব্যবহার করতে হয়। এই চিহ্নের বিরামকাল পূর্ণচ্ছেদের মতো।
চ) উদ্ধৃতি চিহ্ন (“......”)
কোনো উদ্ধৃতি, কোনো মত, কোনো মন্তব্য, কারও মুখের উচ্চারিত কথা বর্ণনা করতে গেলে উদ্ধৃতি চিহ্নের ব্যবহার প্রয়োজন হয়।
ছ) ড্যাশ বা রেখা চিহ্ন (---)
কোনো বিষয়ে দৃষ্টান্ত দেবার পূর্বে, কোনো বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে এই চিহ্ন ব্যবহার করতে হয়।
জ) হাইফেন বা পদসংযোগ চিহ্ন (-)
একাধিক পদ যখন সমাসবদ্ধ বা সন্ধিবদ্ধ পদ হিসাবে ব্যবহৃত হয় তখন পদ দুটির মধ্যে হাইফেন ব্যবহার করা হয়।
ঝ) কোলন চিহ্ন (:)
কোনো বিষয়ের তালিকা দিতে গিয়ে এই চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
ঞ) বন্ধনী চিহ্ন
বাক্যের মধ্যে ব্যাখ্যামূলক কোনো অংশ যুক্ত করতে, কোনো সূত্র নির্দেশ করতে বন্ধনী চিহ্নের প্রয়োজন হয়।
পুনশ্চঃ (১) -- অনেক কবিকে দেখি তারা এই চিহ্ন গুলি ছাড়া আরও অনেক চিহ্ন ব্যবহার করেন। যেমন- ~, @,#,৳,*,!!!!!!, ????,+,=,/,\,| ইত্যাদি। কবিতায় কখনও এই সব চিহ্ন ব্যবহার হবেনা। এবিষয়ে  সবাইকে সচেতন থাকা দরকার।
পুনশ্চঃ (২)--ছেদ যতি মেনে ভালো লেখার জন্য পত্র পত্রিকা সহ নামি লেখকের লেখা বিশেষ মনোযোগ সহ পড়া প্রয়োজন”। ভালো সাহিত্য চর্চা করলে সহজেই নিজের ভুল ভ্রান্তি শুধরে নেওয়া যায়।