। বাঁধন।


ব্যাস ভারী ঢেকে চেপে বর্ণনা দেন ।চোখের আলোকে কাড়া এই  বস্ত্র,
স্বামীর সোহাগে ডগমগ প্রেমঅভিজ্ঞান নয়, ওটা ভয়ানক অস্ত্র,
যুদ্ধ করার মতো অনুগত সেনা নেই, সাথী নেই কষ্টকে ভাগ করবার,
সুখের ছদ্মবেশে এই অভিসম্পাতে আর  তো আয়ুধ কিছু নেই লড়বার,
চোখের এই বাঁধনেই জমা রাগ ক্ষোভ ঘৃণা দ্বেষ প্রতিশোধ-ইচ্ছারা সব,
আশাকে বাঁচিয়ে রাখা একদিন এ বাঁধন ধ্বংস জাগাবে, বলি হবে যাবতীয় কুরু পাণ্ডব,
বিনষ্ট হবে স্বামীশ্বশুরকুলে সব পুরুষেরা , যারা বেঁচে যাবে,জীবন্ত শব হবে ভেতরে ভেতরে,
তোমরা দেখেছো শুধু বস্ত্রাবৃত চোখ, বোঝোনি প্রলয় বেঁধে রেখেছি কোচড়ে।


শুরু থেকে দেখো। মহাপরাক্রমী রাজ্য হস্তিনাপুর, তাঁরা কিনা বেছে নেন ক্ষুদ্র গান্ধার,
প্রার্থী স্বয়ং ভীষ্ম,  তাঁকে না করবার সাহস বা ক্ষমতা যে ছিলো না পিতার,
বলাই বাহুল্য। নেপথ্যে ছিলো শুধু  এক বহুশ্রুত রটনা , একশো সন্তানের বর পাওয়া নাকি আমি,
রূপ নয় , গুণ নয়,  স্বপ্ন বা ইচ্ছার মর্যাদাদান নয়, কুরুর গর্বের কাছে গর্ভটি দামী,
ব্যাসবীজ একবার রক্ষা করেছে বটে, তবু তাতে উৎপন্ন পুত্রেরা  অসম্পূর্ণ , জানে সকলেই,
পরবর্তী প্রজন্মে বহু পুত্র হলে , সিংহাসনের আর সেরকম বিপদের সম্ভাবনা নেই,
সেই পুত্রেষ্টি চাহিদার বলি হলো গান্ধাররাজার দুহিতা, শুধু তার জরায়ু শতসন্তানক্ষম বলে,
আমি তাই বেঁধে নিই আমার দুচোখ। দর্পণহীন মন যদি সেই শরীরের অপমান ভোলে।


ভোলেনি। ভোলেনি মন একখানা দিনও, ভোলাবার মতো প্রেম দিলেন কখন সেই জন্মান্ধ পতি,
তাঁর শুধু একটাই লক্ষ্য তখন, পাণ্ডুর আগে যেন পিতা হন তিনি।
প্রেমহীন সঙ্গম বিনা সম্মতি,
তোমাদের কলিকালে বিবাহে ঘটে না বুঝি? মুক্তির উপায় শুধু দ্রুত হয়ে পড়া গর্ভিণী,
এখানেও ব্যত্যয় নেই । পরবর্তী সিংহাসন নিশ্চিত ভেবে, বৈশ্য দাসী সম্ভোগে মন দেন তিনি।
তারপরে সুসংবাদ এলো, কুন্তীর কোল আলো করেছে যুধিষ্ঠির। স্বামীটি নিতান্ত হতাশ,
সে সুযোগ নিয়ে আমি উদরে আঘাত করি। গর্ভপাত হলে হতো আমার স্বামীর বংশ মূলেই বিনাশ,
সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি যদিও। মহামুনি ব্যাসের কৃপায় সেই মাংসখণ্ডের থেকে হলো কৌরব,
কুরুর প্রাসাদ জুড়ে সে কি উৎসব সেইদিন! জন্মদাত্রী শুধু গরবিনী
নয় , বরঞ্চ বুকে দাউ জ্বলে রৌরব।


ব্যাসের পাঠককুল এতই ব্যস্ত থাকে বীরকাহিনীতে, নারীদের প্রতিবাদ এড়ায় সহজে,
এই গান্ধারী কেন স্নেহ বুকে পিষে পুত্রদের মুখ দেখতে বাঁধন খোলেনি, কে কারণ খোঁজে,
ধরে নেওয়া হয় এই পতিব্রতাটি  করে গেছে কর্তব্যপালন তার দৃঢ় শপথে,
বোঝাননি মহাভারতকার, দেখতে চাইনি আমি কুরুঔরসজাত কোনো পুরুষের মুখ কোনোমতে,
যে বংশ আমার জীবন জুড়ে নামিয়েছে চির-অন্ধকার। ব্যাস যেটা লেখেননি এইখানে ঠিক হবে বলা,
দেখেছি অবশ্য আমি একজনকে, চুপিচুপি বাঁধন সরিয়ে।আহা ভারী রূপবতী আমার দুঃশলা,
জননীর যত প্রেম সবটাই তার। বাকি গর্ভজাতরা বৈরী আমার,
বরং দিয়েছি ঠেলে স্নেহহীন ধ্বংসের দিকে,
কেন জানিনা  কেউ প্রশ্ন করেনি দুই সহস্র বছরে , দুর্যোধনের এত কাছাকাছি এনে দিলো কে শকুনিকে।


আজকে যু্দ্ধ শেষে কানে আসে শুধু কুরুনারীর বিলাপ। স্বামীর পুত্র সেই দাসীগর্ভজাত যদিও জীবিত,
সে কখনো বসবে না ওই সিংহাসনে। উত্তরার গর্ভস্থ সন্তান কবে হবে,
সেই অনাগততেই এ রাষ্ট্র ধৃত।


কাজ শেষ হয়েছে আমার। বেঁচে থাকা  সন্তানহারা কুরুবৃদ্ধটি আজ  চাইছেন যেতে উপায়হীন বাণপ্রস্থে,
আমিও সঙ্গী হবো , ওই শোক প্রতিশোধ কোনো এক কিশোরীর, যার স্বপ্নরা প্রভাতেই গিয়েছিলো অস্তে।


চোখের বাঁধনটাকে কাব্যিক প্রেম ভেবো না। কুরুর বিনাশ শুরু ওই এতটুকু প্রতিবাদী বস্ত্রে।


আর্যতীর্থ