সাহিত্য সকল মানুষের জন্য
সাইয়িদ রফিকুল হক


সাহিত্যের আবার ধর্ম কী? সাহিত্য হিন্দু না, মুসলমান না, বৌদ্ধ না, খ্রিস্টান না। তাহলে, সাহিত্যের ধর্ম কী? আসলে, সাহিত্যের নির্দিষ্ট কোনো পোশাকি-ধর্ম নাই। তাই, সাহিত্যের একমাত্র ধর্ম মানবতা আর সার্বজনীন মনুষ্যত্বের জাগরণ। আর কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের একমাত্র ধর্ম হলো মানবধর্ম। আর এই মানবধর্মেরই জয়গানে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে সারাটি জীবন শব্দের মালা গাঁথেন কবি, লেখক ও সাহিত্যিকগণ। সাহিত্য শুধু মানুষের—আর কবি, লেখক ও সাহিত্যিকরাও মানুষের বন্ধু। তাঁরা জীবনব্যাপী মানুষের জন্য সৃষ্টিধর্মী-চিন্তাভাবনায় ডুবে থাকেন।


অনেকে মূর্খতাবশতঃ প্রায়ই বলে থাকে: অমুকে হিন্দু-কবি, তমুকে মুসলিম-কবি, অমুকে বিধর্মী লেখক, তমুকে ইসলামধর্মের লেখক বা অমুকে মুসলমান-লেখক! আর এগুলোর সবই হচ্ছে তাদের  অযাচিত-মূর্খতা। আর একশ্রেণীর সমাজবিরোধী-মানুষের নাশকতাসৃষ্টির অপপ্রয়াস মাত্র। বিশ্বভূমে সর্বকালের ও সর্বদেশের কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের কোনো জাত-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র দেখতে নেই। এঁরা শুধু মানুষ ও মানবতার সৈনিক। আর এঁরা সদাসর্বদা মানবধর্মে দীক্ষিত। আরে, কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের আবার ধর্ম কী? তাঁদের একমাত্র ধর্ম হলো: মানুষ আর মানবতা। তাঁরা এরই লক্ষ্যে তাঁদের সৃষ্টিশীল-কাজেকর্মে নিয়োজিত রয়েছেন। তাই, তাঁদের ধর্মবিচার না করে আজ-এক্ষুনি শুধু তাঁদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এরপরও কি আরও বুঝিয়ে বলার দরকার আছে?


কবির ধর্ম নিয়ে যদি কারও মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়—তাহলে, তিনি আর সত্যপথের পথিক হতে পারবেন না। তিনি সাম্প্রদায়িক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন সত্য, কিন্তু তার মানবাত্মার মুক্তি কখনও ঘটবে না। তিনি দিনে-দিনে আরও গোঁড়া-সাম্প্রদায়িক ও অমানবিক হয়ে উঠবেন। কবি-লেখকদের ধর্ম জিজ্ঞাসা করতে নেই। তাঁদের লেখা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কবি-লেখকদের লেখা সবসময় অসাম্প্রদায়িক। আর কেউ যদি সাম্প্রদায়িক কবি-লেখক হয়েও থাকেন—তাহলে, তিনি অচিরেই নির্বাসিত হবেন। কবি-লেখক হবেন সর্বকালের, সর্বমানুষের আর সর্বদেশের। তাঁদের একমাত্র ধর্ম হলো মানবাত্মার জয়গান গেয়ে যাওয়া। আমাদের বাংলা সহিত্যের কবি-লেখক-সাহিত্যিকগণ সুদীর্ঘকাল যাবৎ সেই মহৎ-কাজটিই চালিয়ে যাচ্ছেন।


সাহিত্য শুধু মানুষের জন্য। আর পশুদের জন্য আজ পর্যন্ত কোথাও-কোনো সাহিত্য রচিত হয়নি। যারা মানবধর্মে বিশ্বাসী, যারা মানুষ আর মানবতাকে সবসময় ভালোবাসেন, আর একে ক্রোড়ে নিয়ে শান্তিসুখে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে চান—তাদের জন্যই সমকালীন সাহিত্য। পৃথিবীর যেকোনো সাহিত্যিকই আমাদের বন্ধু। আর আমরা তাঁদের লেখা পড়ে মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই, শিহরিত হই, চমকিত হই আর আনন্দলাভে দিশেহারা হয়ে পড়ি। এর কারণ কী? এর কারণ হলো: আমি মানুষ আর যিনি সাহিত্যরচনা করেছেন তিনিও একজন মানুষ। আর এজন্যই একজন মানুষের লেখা আমাদের হৃদয়ে এতোটা অনুভূতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। কাজেকাজেই, একজন কবি, লেখক ও সাহিত্যিককে শুধু মানুষ ভাবতে হবে। তাঁর ধর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করলে আমরা সাহিত্যের রসাস্বাদন করতে পারবো না। আর আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের ধর্ম নিয়ে আলোচনা নয়—আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো: কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের অমর সৃষ্টিসমূহের পুরাপুরি স্বাদ-আস্বাদন করা। তবে কেন আমরা নিতান্ত মূর্খতাবশতঃ কবির ধর্ম নিয়ে ছলচাতুরি করে সময়ের অপচয় করছি? আমাদের এই অজ্ঞতা আজ-এক্ষুনি দূর করা প্রয়োজন। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সবার উপরে একমাত্র মানবধর্মকে প্রাধান্য দিতে হবে।


আমাদের আরও শুদ্ধ হতে হবে। আমাদের আগে মানবধর্ম বুঝতে হবে। আর আমাদের চিন্তাশক্তির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাতে হবে। মানুষের রক্ত এক—মানুষের চিন্তাভাবনাও প্রায় একই। তাই, বিশ্বভূমে মানিবজাতির এতোবড় সংসার গড়ে উঠেছে। কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্রস্বার্থের অমানুষদের জন্যই আজ আমাদের এই সুন্দর-পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। আর সত্যি কথা বলতে কি আধুনিককালে সমাজ-রাষ্ট্রবিধ্বংসী এই সাম্প্রদায়িক-পশুদের নির্বাসনে পাঠাতে পারলে ভালো হতো। যারা সাহিত্যপাঠকালে কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের ধর্ম নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা সুস্থমস্তিষ্কের মানুষ নয়। অবিলম্বে এদের সুচিকিৎসা প্রয়োজন।
সাহিত্যপাঠকালে দেখতে হবে একজন লেখকের চিন্তাশক্তি, সমকালীন জীবনভাবনা, তাঁর রচিত গল্প বা প্রবন্ধসমূহের বাস্তবতা, যৌক্তিকতা, আর ভাবতে হবে এঁদের সৃষ্ট চরিত্রসমূহ নিয়ে। কেউ যদি সাহিত্য বাদ দিয়ে সাহিত্যিকের ধর্ম নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দেন—তাহলে, তিনি সাহিত্যপাঠের যোগ্যতা হারাবেন। আর সাহিত্যের এই সুবিশাল-সাম্রাজ্যে বিচরণ করার অধিকারও তিনি হারাবেন। এইজাতীয় সাম্প্রদায়িক-পাঠকের বিশ্বসাহিত্যে কোনো প্রয়োজন নাই।


আমাদের বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী কবি, লেখক, সাহিত্যিকগণ তাঁদের অমর সৃষ্টিসমূহ সর্বধর্মের ও সর্বকালের মানুষের জন্য রেখে গেছেন। সামাজিক মানুষ হিসাবে তাঁরা প্রত্যেকে নিজস্ব একটি ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এখনও যাঁরা জীবিত—তাঁরাও স্ব-স্ব-ধর্মে দীক্ষিত রয়েছেন। আর এটি কালের ও জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম। কিন্তু এর বাইরেও একজন কবি, লেখক ও সাহিত্যিকের নিজস্ব একটা ধর্ম থাকে—আর এই ধর্মদর্শনের নাম মানবধর্ম। তাই, তাঁদের কারও সামাজিক-ধর্ম যেন আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে না দাঁড়ায়—আমরা কারও সামাজিক-ধর্মদর্শন নিয়ে যেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে না পড়ি—আমরা যেন তাঁদের মানবধর্মে সর্বাবস্থায় শ্রদ্ধা রাখি—আর তাঁদের রচিত সৃষ্টিশীল-গ্রন্থসমূহ নিয়ে আনন্দে মেতে উঠি। এই হোক আজকের দিনের সর্বাপেক্ষা আধুনিক-মানুষের জীবনভাবনা আর জীবনদর্শন। আর আমাদের চিরদিন ভাবতে হবে: পৃথিবীর কোনো সত্যিকারের কবি, লেখক ও সাহিত্যিক ধর্মপ্রচারের জন্য তাঁর লেখনিশক্তিধারণ করেননি। এটি প্রাচীনযুগে ও মধ্যযুগে হয়তো পাওয়া যেতো। কিন্তু আধুনিককালের একজন কবি, লেখক ও সাহিত্যিক শুধুই  মানুষের—আর তাঁরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য।


আজ থেকে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যে, আমরা সকল ধর্মের মানুষের লেখা পড়বো। আর সকল ধর্মের কবি, লেখক ও সাহিত্যিককে সম্মানের চোখে দেখবো। সাহিত্যপাঠকালে কখনও কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করবো না। আর আজ থেকে কাউকে হিন্দু-লেখক কিংবা ইসলামী-লেখক বা মুসলিম-লেখক বলে তাঁকে সংকীর্ণরূপে গণ্ডিবদ্ধ করবো না।


সাহিত্য সকল মানুষের পাঠযোগ্য-গ্রন্থসমূহ। আর এটি সীমাহীন আনন্দের এক ভুবন। আর কোনো ধর্ম দিয়ে সাহিত্যবিচার করা চলে না। সাহিত্য এসবকিছুর উর্ধ্বে। সাহিত্যে আছে শুধু মানুষ আর মানুষ—মানবতা আর মানবতা। আর তাই, জীবনের প্রয়োজনে সাহিত্য আজ সকল মানুষের জন্য।


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০৩/০৬/২০১৬