সাহিত্যের কোনো জাত-ধর্ম নাই
সাইয়িদ রফিকুল হক


অনেকেরই সাহিত্যপাঠের কোনো যোগ্যতা নাই। কথাটি শুনে অনেকেই হয়তো চমকে উঠবেন। আর চমকে উঠাটাই খুব স্বাভাবিক। আমাদের সমাজে অনেকে মনে করে থাকে: যেকোনো একটি বই পড়লেই বুঝি সাহিত্যপাঠ হয়ে যায়! আসলে, এটি তাদের ভ্রান্তধারণা। অনেকেই সারাজীবনে সাহিত্যের মানেই জানে না। আর তারা যেকোনো একটি বইকে পুঁজি করে নিজেদের বাহাদুরীপ্রকাশ করতে চায় যে—সে খুব সাহিত্যপাঠ করেছে! আসলে, সে কিছুই পাঠ করেনি। আর সে তার এই ক্ষুদ্র-জীবনে দুই-চারিখানা পাঠ্যপুস্তকপাঠ করেছে মাত্র। এতেই সে বড়াই করছে—সে খুব সাহিত্যপাঠ করেছে!


যারা সাহিত্য বোঝে না, সাহিত্যপাঠের অযোগ্য, তারাই কোনো-কোনো কবি-লেখকের রচনাবলীপাঠের আগে-পরে প্রশ্ন তোলে: তিনি কোন ধর্মের কবি-লেখক? আর তিনি হিন্দু-না-মুসলমান? নাকি খ্রিস্টান? নাকি তিনি অন্যকোনো ধর্মাবলম্বী? আর এসব প্রশ্নের মধ্য দিয়েই তাদের মূর্খতা একেবারে ষোলোআনা প্রকাশ পায়। আরে মূর্খের দল, কবি-লেখকরা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাকি অন্যকিছু?—এর সন্ধান করতে গেলে আমাদের আর সাহিত্যপাঠ করা হবে না। আর আজ থেকে সবাইকে মনে রাখতে হবে: একজন কবি-লেখককে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি না ভেবে তাদের শুধু মানুষ ভাবতে হবে। আরও বুঝিয়ে বলতে হবে? বলছি: কবি হিন্দু না, মুসলমান না, বৌদ্ধ না, খ্রিস্টান না—কবি শুধু মানুষ। আর কবি ভিতরে-বাইরেও শুধু মানুষ। কবি হয়তো বাইরের রূপে ধর্মাবলম্বী হয়ে হতে পারেন একজন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—কিন্তু সেটি তার সামাজিক ধর্ম। আসলে, কবি-লেখকদের প্রকৃত-ধর্ম মনুষ্যত্ব। এই কথাটা যারা বেমালুম ভুলে কবি-লেখকদের ধর্ম নিয়ে অহেতুক তর্কসৃষ্টি করবে—তারা নিশ্চিতভাবে সাম্প্রদায়িক অমানুষ ও পশুশক্তি। আর এই পশুশক্তিই আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রকে এখনও গ্রাস করার কুপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতির বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে আমাদের সবসময় ভাবতে হবে: এই শ্রেণীটি দেশের আগাছা-পরগাছা মাত্র। আর একজন আদর্শ কৃষক কখনও তার ফসলের ক্ষেতে আগাছা-পরগাছা সযত্নে প্রতিপালন করে না। বরং কৃষক ফসলের স্বার্থে দ্রুত আগাছা উপড়ে ফেলে। আমাদের ফসলের প্রয়োজন—আগাছা-পরগাছা নয়।


সমাজে-রাষ্ট্রে আগাছা-পরগাছা জন্মাবে, আর এগুলো শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলারও ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই কাজটি করবে দেশের আধুনিক-সরকার। দেশ, জাতি ও মানুষের স্বার্থে এই সাম্প্রদায়িক অমানুষ ও পশুগোষ্ঠী নামক আগাছা-পরগাছাশ্রেণীটিকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে তা চিরতরে নির্মূল করার সুবন্দোবস্ত করবে দেশের সরকার। এটি সরকারের প্রধান দায়িত্ব, কর্তব্য ও কাজ। আর এর চেয়ে বড় কাজ রাষ্ট্রের আর নাই। সাম্প্রদায়িক অমানুষ ও পশুগোষ্ঠী হচ্ছে বিষাক্ত—বিষতুল্য-আবর্জনা মাত্র। আর কোনো রাষ্ট্রই তার রাষ্ট্রে নাগরিকদের জীবনসংহারের জন্য এই বিষাক্ত-বর্জ্য রেখে দিতে চাইবে না। এই বিষাক্ত-বর্জ্যগুলো চিরতরে অপসারণ না করলে দেশের সাধারণ ও অবিবেচক নাগরিকগণ যেকোনো সময় এদের কুসংস্পর্শে বিভ্রান্ত হতে পারে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার স্বার্থেই সমাজ-রাষ্ট্র থেকে সাম্প্রদায়িক অমানুষ ও পশুগোষ্ঠী নামক বিষাক্ত-বর্জ্য অপসারণের গুরুদায়িত্বপালন করবে—আর এটি পালন করতে রাষ্ট্র বাধ্য। আধুনিক-রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে মহৎকাজ পৃথিবীতে আর নাই।


সাহিত্য আলোকবর্তিকা। জাতির পথনির্দেশক বিধিব্যবস্থা। যারা অন্ধকারে হাতড়ে ফেরে তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কাজটি করতে পারে সাহিত্য। যেকোনো দেশের কবি-লেখক ও সাহিত্যিকগণ তাদের চিন্তা, মেধা ও মননের দ্বারা স্বজাতির মঙ্গলের জন্য কাজ করে যান। এঁরা একেকজন দেশ, জাতি ও মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মাত্র। আর এঁদের মতো ভালোমানুষকে যারা ধর্ম দিয়ে বিচারের অপচেষ্টা চালায় তারা কতটা পশু—তা একজন বিবেকবান মানুষই বলতে পারেন।
মানুষের সমাজে পশু রাখাটাও আপদবিপদের বিষয়। তাই, সর্বদিক বিবেচনা করে পশুদের মানবসমাজ থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক-রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পশু ও প্রধান আবর্জনা হচ্ছে এই সাম্প্রদায়িক অমানুষ ও পশুগোষ্ঠী। রাষ্ট্রের অবনতির মূলেও এদের আগ্রাসন। এদের কুচিন্তা সমাজদেহে ‘এইডস-ভাইরাসে’র মতো ধীরে-ধীরে কাজ করে। আর তা কোনো-কোনো ক্ষেত্রে দ্রুতও কাজ করতে পারে। আর সেক্ষেত্রে এসব থেকে রাষ্ট্রের নিরাময়ের একমাত্র ব্যবস্থা হলো: মানবজাতির প্রধান শত্রু সাম্প্রদায়িক পশুগোষ্ঠীকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।


সাহিত্য সুন্দর মনের মানুষের জন্য। আর সুচিন্তিত মানুষের আনন্দের খোরাক হচ্ছে এই সাহিত্য। আমাদের দেখার বিষয় নয় যে, এটি কে রচনা করেছেন—আমাদের সবসময় দেখবার বিষয় হলো তিনি কী বলেছেন। এখানে, কবি-লেখকদের সুচিন্তা ও মানবতার পক্ষে প্রচারিত বক্তব্যই একমাত্র প্রাধান্য পাবে। আর আমাদের চিরদিন মনে রাখতে হবে: সাহিত্যের কোনো জাত-ধর্ম বলে কিছু নাই। সাহিত্য সকল কালের, সকল মানুষের, আর সকল ধর্মের জন্য।


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০৯/০৬/২০১৬