গ্রন্থের নামঃ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ, সম্পাদনায়ঃ সুজাত মনসুর


বইটি হাতে নিতেই দৃষ্টি যাবে প্রচ্ছদের দিকে, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রের ঝাপসা পাতার এলোপাতাড়ি অবস্থান আর নীচের কালো অংশে সংযোজিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিচ্ছবি।  মলাট উল্টে ভেতরে যাবার সময় বাম পাশে চোখে পড়বে সম্পাদকের পরিচিতি, যা শেষ হয়েছে শেষ মলাটের ভেতরের পাতায়।  এখানে বিবৃত হয়েছে সম্পাদকের ব্যক্তিগত পরিচয় থেকে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। রয়েছে সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সুজাত মনসুরের লেখক ও সাংবাদিক জীবনের কিঞ্চিৎ পরিচিতি।  বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে তার বাবা-মা ও শ্বশুর-শাশুড়িকে যৌথভাবে; যারা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অন্তরে ধারণ করেছেন শর্তহীনভাবে।


‘সম্পাদকের কথা’ অংশে সম্পাদক তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা, প্রেরণা, গ্রন্থ প্রকাশনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাঠককে সম্যক ধারণা দিয়েছেন।  সম্পাদকের কথা’র উপরে সম্পাদকের নিজের ছবির পাশাপাশি সংযোজিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদের ছবি।  বঙ্গবন্ধু, সামাদ আজাদ, আওয়ামীলীগে সম্পাদকের সক্রিয়তা ইত্যাদি পাঠককে ভুল বার্তা দেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সম্পাদকের বক্তব্য থেকে এসবের সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।  কেননা, তিনি মনে করেন ‘মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু’ সমার্থক।  বক্তব্যের শেষাংশে সম্পাদক এ গ্রন্থ প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।


গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন তাঁরই প্রিয় শিক্ষক বাংলা সাহিত্যের নামী অধ্যাপক ডঃ সফিউদ্দিন আহমদ, যার সম্মোহনী শক্তিতে আবদ্ধ এ সম্পাদকসহ ছাত্রছাত্রী অনেকেই। ডঃ আহমদ তাঁর ভূমিকায় এ গ্রন্থ সম্পাদনার প্রেক্ষিতসহ সুজাত মনসুরের ধী, শ্রী ও অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞানের প্রশংসা করেছেন এবং অভিনন্দন জানিয়েছেন সেইসব কবিদের যাদের লেখা নিয়া সংকলিত এ গ্রন্থ।  


বইটির নাম ও সম্পাদকের কথা থেকে জানা যায় যে, গ্রন্থটি লেখকের কোনো মৌলিক রচনা নয় বরং দেশ ও প্রবাসের বিশজন কবির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতার নির্বাচিত সংকলন; সূচীপত্র তা-ই নিশ্চিত করে। তবে সম্পাদক প্রবাসী কবিদের কবিতাকে যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তা সুস্পষ্ট। কেননা, বিশজনের বারোজন কবিই হচ্ছেন বিলেত অভিবাসী স্বনামধন্য কবি।  সুখের বিষয় এরই মাঝে চারজন মহিলা কবিও রয়েছেন। প্রত্যেক কবির দু’টি বা তিনটি করে কবিতা তিনি বেছে নিয়েছেন।  প্রত্যেক কবির কবিতার পূর্বে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরতে তিনি ভুল করেননি। ফলে বর্তমানকালের বিশজন কবির সঙ্গে পাঠকের পরিচিতি ঘটার এটি একটি মোক্ষম সুযোগও বলা যেতে পারে।    


কবিতাগুলো মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রচিত হলেও যে যে বিষয় এগুলোতে স্থান পেয়েছে তাহলোঃ জাতীয় বীর ও বীরাঙ্গনাদের অমর গাঁথা, যুদ্ধদিনের গল্প, যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা, দেশের তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রেম, রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা, সবুজের বুকে লাল সূর্য আঁকা স্বদেশভূমি ও তার নানা প্রাকৃতিক দৃশ্যপট, কোনো তরুণের যুদ্ধে যাবার গল্প, পেছনে ফেলে আসা প্রেমিকা কিংবা বৃদ্ধ বাবা-মা’র স্মৃতি, মুক্তিযোদ্ধার সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিজীবি হত্যা করে দেশকে বুদ্ধিহীন করার প্রচেষ্টায় ক্ষোভ, ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি, যুদ্ধ পরবর্তী দেনা-পাওনার হিসাব, অপ্রাপ্তির বেদনায় আর্তনাদ, স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির উত্থানে ক্ষোভ, নারীর সম্ভ্রমহানীর করুণকাহিনী, শোক গাঁথা, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ গাঁথা, ২৫শে মার্চের কালোরাত্রির ঘটনাবলী, বিজয় গাঁথা ইত্যাদি।  


অধিকাংশ কবিতাই আধুনিক ঘরানার। দু’একটি ছাড়া বেশীরভাগই ছন্দহীন কবিতা।  যারা ছন্দের পূজারী কিংবা যারা কবিতার প্রচলিতধারায় অভ্যস্ত তাদের কাছে এসব কবিতা অস্বস্থিকর কিংবা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তবে যারা কবিতা চর্চা করেন কিংবা যারা কবিতানুরাগী তাঁদের কাছে এসবের ভাবার্থ ও মর্মার্থ উদ্ধার করা খুব একটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না। আর আধুনিকধারার কবিতা যাদের আকৃষ্ট করে তারা এর মাঝে খুঁজে পাবেন পরম প্রশান্তি।  


স্থান, কাল ও পাত্রভেদে কবিতার মাঠ যে ভিন্ন আঙ্গিকে কর্ষিত হয়েছে এর ছোঁয়া পাওয়া যায় কবিতাগুলো পাঠে। পরিবেশ, প্রেক্ষিত ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে পরিবর্তন এসেছে মানুষের চিন্তাধারায় এবং কবিমানসের ঘটেছে বিবর্তন – এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে তা স্পষ্টতই দৃশ্যমান।


যুক্তরাজ্যে আরো অনেক কবি রয়েছেন যাদের কবিতা পাঠ করতে পাঠককূল স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন অথচ এমন অনেক কবির কবিতাই এখানে স্থান পায়নি। ফলে সুজাত মনসুর কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই বিশজন কবির কবিতা নির্বাচন করলেন তা স্পষ্ট নয়। তবে এমনও হতে পারে তিনি অন্যান্য কবিদের কাছ থেকে সাড়া পাননি কিংবা গ্রন্থটির কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে সীমায়িত রয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথায় এ বিষয়টি একেবারেই উঠে আসেনি। সমালোচনা যা-ই থাক্ না কেন, বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে এ বইটির গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো জো নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মদেরকে স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি সম্যক ধারণায় সমৃদ্ধ করতে এ গ্রন্থের ভূমিকা অনস্বীকার্য।  


কাব্যগ্রন্থের ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো সাধারণতঃ সাদা-কালো দেখেই আমরা অভ্যস্ত কিন্তু সম্পাদক এখানে একটি ভিন্নমাত্রা সৃষ্টি করেছেন প্রতিটি পৃষ্ঠা রঙিন অলংকরণে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে।  আর এসব ছবি মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গেরই সাক্ষ্য বহন করছে।  তাছাড়া ছবিগুলো যে কবিতার কথাগুলোই বলে দিচ্ছে। সাদা-কালোযুগের পাঠকদের কাছে এর আবেদন তেমন নাও হতে পারে, তবে আধুনিক রঙিন জগতের তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের কাছে বইটি সমাদৃত হবে সন্দেহ নেই। একটি বইয়ের মাধ্যমে বিশজন কবি ও তাঁদের কবিতাকে জানার সুযোগ রয়েছে বলে বইটি সংগ্রহে রাখার মতো বলেও মনে করি।


বইটি প্রকাশিত হয়েছে উৎস প্রকাশনী ঢাকা থেকে, যার মূল্য রাখা হয়েছে ১৬০ টাকা।  বইটির অনলাইন পরিবেশক হচ্ছেঃ www.rokomari.com, www.porua.com.bd, www.boimela.com .


আমি বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।  


লেখক: কবি ও অধ্যাপক।