বাংলা কবিতামাতৃক দেশ।বাংলার আকাশে বাতাসে কবিতা। ইলেকট্রনিক মাধ্যমের দৌলতে প্রতিদিন অসংখ্য কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে ফেসবুকে,ব্লগে,বিভিন্ন গ্রুপে ও কবিতা ক্লাব বা আসরে।কবিতা লিখে ১০০০ সংখ্যা পার করেছেন এমন কবির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবু বলতেই হয়, আমাদের সব কবিতা কি কবিতা হয়ে উঠছে? অস্বীকার করার উপায় নেই যে,খেরোর খাতা হিসেবে এসব কবিতার মূল্য থাকলেও খুব কম সংখ্যক কবিতা রসোত্তীর্ণ হতে পারছে। তা হলে কেন পারছে না ? তাই মনে হয়, কবি কি,নব্য কবিদের আগে জেনে নেওয়া দরকার।

Poet শব্দটি এসেছে গ্রিক poein থেকে, যার অর্থ সৃষ্টি করা।অর্থাৎ কবি একজন সৃষ্টিকর্তা।'কবির কন্ঠস্বর ঈশ্বরের উচ্চারণ মাত্র' বলেছেন পূর্ণেন্দু পত্রী।কবিকে তাই মুক্ত চিন্তার কথা,মানুষের কথা, ভালোবাসার কথা বলতে হবে।

কবিরা হলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এবং ভবিষ্যতের রূপকার।' Poets are.. the mirrors of the gigantic shadows which futurity casts upon the present'

রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায় 'কবি হওয়া একটি অবস্থা,পেশা নয়'। অর্থাৎ  যিনি কবি,কবি হওয়াই তার ভবিতব্য।আর মনে রাখতে হবে 'কবিতায় টাকা নেই,টাকাতেও কবিতা নেই' বলেছেন রবার্ট গ্রেভস।

তাহলে কি করে লিখব সে কবিতা? এ হেন মহান কর্ম কেবল গালে হাত দিয়ে কলম কামড়ে তো নির্গত হবার নয়। মালার্মে কবিতাকে বিশুদ্ধ শব্দ নির্মান বলেছেন।সেই শব্দ হবে  আধুনিক আর তার প্রয়োগ হবে ব্যঞ্জনাময়। এখানেই কবির মুন্সীয়ানা।শব্দবিন্যাসের কৌশলে তিনি প্রয়োগ করেন রূপক,উপমা,চিত্রকল্প।বলা বাহুল্য, যিনি যত ছন্দকে রপ্ত করবেন তিনি তত সুচারুভাবে এগুলির প্রয়োগে কবিতার উৎকর্ষকে ছুঁতে সমর্থ হবেন।কবিতা কিন্তু কোন ধাঁধা নয়,প্যাঁচ মারলেই কবিতা হল না।আবার কবিতা ছোটগল্প নয়,যে তার সাসপেন্স সবসময় কেবল শেষ লাইনেই থাকবে।অর্থাৎ, কবিতা অন্য মাধ্যম থেকে যে আলাদা, কবিতার কাব্যগুনই যেন তা বলে দেয়।
কি করে আয়ত্ত হবে সে ক্ষমতা ?

এলিয়ট তাঁর  Tradition and the individual talent-এ বলে গেছেন:
নতুন কোন কবিকে পূর্ববর্তী যত কবি আছেন তাদের কবিতা পড়তে হবে।তাদের সবার কবিতা পড়ার পর নব্য কবি তাঁর নিজস্ব মেধা দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করবেন,যা আগে কোন কবি করেন নি।যেমন,'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড' কবিতায় এলিয়ট বহুগামী প্রেমের কথা বললেন যা আগে কেউ লেখেন নি।পূর্বে অনেক কবি সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়েছেন।কিন্তু এলিয়ট বলেছেন,
'হলুদ রঙের তুষার সন্ধ্যে'।মানুষের মনের অশুদ্ধতায় প্রকৃতিও যে নোংরা হলদেটে হয়ে গেছে কি অসাধারন অভিনব ধরা গেল !

কবিকে আগের যুগ সম্বন্ধে জানতে হবে এবং আগের যুগের সাথে বর্তমানে কতটুকু পার্থক্য সেই সমসাময়িকতা ফুটিয়ে তুলতে হবে।

কবিকে নিজের আমিত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সার্বজনীন হতে হবে।কবির নির্দিষ্ট কোন ধর্ম থাকে না।তবু তাকে যাপিত ধর্মের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।কবির কোন লিঙ্গান্তর হয় না।তবু সে শরীরকে অস্বীকার করতে পারে না।শরীরের মধ্য দিয়ে গিয়ে তাকে শরীরকে অতিক্রম করতে হয় ।নিজের সঙ্গে নিজের এই যুদ্ধে নিজস্ব আবেগের উর্দ্ধে উঠে তাকে ভাবতে হয়।

তার লেখার বিষয়বস্তু হতে হবে আকর্ষনীয়। কোন বিষয়বস্তুতে আপনি জোর দেবেন ? মনে রাখবেন,একজন খারাপ কবির লক্ষন হল, তিনি সেই বিষয়ে বেশি জোর দেন যেখানে দেবার কথা নয়।আর সেটাতে জোর দেন না,যেটিতে দেবার কথা।

কবির কল্পনাশক্তি হতে হবে প্রখর।যেমন কীটস তাঁর 'নাইটিঙ্গেল' কবিতায় এমন বর্ণনা দিয়েছেন যা সত্যিকার অর্থে পাখিটির নেই।মিলটন 'দ্য প্যারাডাইস লস্ট' এ নরকের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন।তিনি তো কখনো নরক দেখেন নি।জীবনানন্দ কখনো বাংলার বাইরে না গিয়েও দারুচিনি দ্বীপের ছবি এঁকেছেন।

আমরা জানি,কবির মসি যোদ্ধার অসির চাইতে শক্তিশালী। একজন কবি কবিতা লিখে রাতারাতি হয়তো যুদ্ধ থামাতে পারেন না,একথালা ভাত তুলে ধরতে পারেন না নিরন্নকে,কিন্তু জনমত তৈরী করতে পারেন।সে জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম।সে জনমত যুদ্ধ থেকে মানুষকে বিরত করে,অনাহারের যন্ত্রণায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাধ্য করে শাসককে। রাজনীতিক এবং কবি উভয়ের স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে মানুষকে প্রণোদিত এবং প্রভাবিত করার।কবিরা একটু এগিয়ে।সে শাসকের ভিত নাড়িয়ে দেয়।আর তাই উভয়ের দ্বন্দ্ব যুগে,যুগে দেশে দেশে। চিলিতে নেরুদার মতো কবিকে কতদূর ভয় পেলে অত্যাচারী  শাসক তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাধা দিতে কারফিউ জারি করে আর মানুষ সেই বাধা অগ্রাহ্য করে ভিড় জমায় কবির শেষযাত্রায়?কবির কলমের সামনে কতটা বিপন্ন হলে স্পেনে লোরকার মত 'জনগনের কবি'কে খুন করে শাসক মৃতদেহ গুম করে। শ্রীজাতর একটি লাইন ' তুমিও মানুষ আমিও মানুষ/ তফাৎ শুধু শিঁড়দাঁড়ায়' এই সেদিনও একটি সফল ছাত্র আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল । আর শঙ্খ ঘোষের 'রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন' মুহূর্তে সারা দেশে কি অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলছিল !

তাই,একজন সৎ কবি নিঃসন্দেহে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী।একজন কবি ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য।একজন কবি নির্ভয়। শব্দ তাঁর অস্ত্র।শব্দই ব্রহ্ম।শব্দকে খুঁজুন।অধ্যবসায় নিয়ে তার প্রয়োগ কৌশলকে রপ্ত করুন।মানুষকে ভালোবেসে কবিতায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান।মনে রাখবেন আপনি কবি।এই আপনার সারা জীবনের সাধনা। আপনার কবিতা কটা পত্রিকায় প্রথম হোল,কটা কবিতার বই হোল এর পিছনে ছুটবেন না।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোন কবিতা কোন বড় পত্রিকায় বের হয়নি।অথচ মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে:

'রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়...
দিন বদলায় না'

সেই দিন বদলের রূপকার হয়তো বা আপনি
এবং আপনিই।



ঋণ:
কবি ও কবিতা:রিয়েল আবদুল্লাহ
কবির ধর্ম: ঋত্ত্বিক দাশ।