কবির সাধনা ও কবির প্রেম


সুধীর দাস


মাঝে মাঝে চিঠি লিখতে ইচ্ছা করতো খুব। মাঝে মাঝে তোমাকে খুব মনে পড়তো। মাঝে মাঝে তোমাকে নিয়ে খুব গল্প করতাম মনে মনে। তারপর কোন এক সময় মেসেঞ্জারে গিয়ে দেখতাম তোমার কোন শুভেচ্ছা বার্তা আছে কিনা।
দেখতাম। ভালো লাগতো। আনন্দিত হতাম। খুশি হতাম মনে মনে।


কিন্তু তোমার লেখার উত্তর দিতে আমার সময় হতো না। একদিন দুইদিন তিনদিন পেরিয়ে যেত তারপর হয়তো হঠাৎ করে তোমাকে ফোন করতাম।
তুমি আল্লাদিতো হতে। আমি কিছু বকবক করে তারপর হয়তো ফোনটাকে দপ করে কেটে দিতাম।
তোমার পরিপাটি জীবন। বিলাসী প্রাণ। অঢেল সময় থাকতো। আমার সময় থাকতো না।


জীবনের দুঃসময় পেরোতে পেরোতে এখন একটু বেঁচে থাকার হাল ধরেছি। কষ্ট পেতে পেতে কষ্টি পাথর হয়ে আজ বুঝে গেছি বাঁচতে গেলে আরো বেশি করে লড়াই করতে হবে। সেই লড়াইটার জন্য তোমাকে আমি সময় দিতে পারতাম না।


এটাই তোমার খেদ। আর সেই খেদ থেকে অভিমান। অভিমানটা আমি বুঝতে পারতুম। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। বিশ্বাস করো বেঁচে থাকার সংগ্রামে একটু সময় পেতাম না কে রাগ করেছে,কে অভিমান করেছে, কে খেদ করেছে।


সবাই যখন রাত্রিবেলা খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে যায়। আমার তখন রান্না করা শুরু। তুমি তখন সব কিছু পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়ে আমাকে ফোন করতে। আমি ফোন তুলতে পারতাম না।
রান্না শেষ হতে হতে তারপর খেতে খেতে রাত্রি অনেক গভীর। তখন হয়তো সময় পেয়ে একটু তোমাকে ফোন করতাম। যদি কোনদিন ফোন ধরতে পারতে হয়তো দুই একটা কথা বলতাম, এইটুকুই। সেই সব কথার মধ্যে ছিল আমার আবেগ,আমার স্বপ্ন, আমার শোক,আমার ব্যর্থতা, আমার কষ্টের প্রতিপাদ্য।


তুমি হয়তো একটু বিরক্ত হতে যখন বুঝতে পারতুম তখন ফোন কেটে দিতাম। কেননা তুমি যখন ঘুমের পরী। আমি তখনও কাজের সাঁতারু।


সারাদিন ক্লান্তির পর রাত্রিবেলা রাত জেগে আমার অনেক কাজ করতে হয় সেটা তোমাকে কোনদিন বোঝাতে পারিনি। তাই তুমি ভুল বুঝলে। এবং দূরে সরে গেলে।
আমিও তোমাকে একদিন রাগ করে দূর করতে বাধ্য হলুম। কেননা ভালোবাসা পেয়ে যখন মানুষ ভালোবাসাকে ধরে রাখতে পারেনা তার চেয়ে কষ্ট পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তার চেয়ে অক্ষমতা পৃথিবীতে কিছু নেই। সেই যন্ত্রণা থেকে চিরতরে দূরে যাওয়াই শ্রেয়।


পৃথিবীর সকল মানুষ ভালোবাসার কাঙ্গাল। আর সেই কাঙ্গাল মনে ভালোবাসা পেয়ে কেউ যদি ধরে রাখতে না পারে সেই বিড়ম্বনা থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়া ভালো। নিলাম তাই। দূর থেকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু কাছে গিয়ে পাশাপাশি বসে হাত ধরা যায় না। ছায়া হয়ে কাছে বসে চোখাচোখি করা যায় না।  


আমার মত অবাঞ্ছিত জীবনে কখনো ভালোবাসা মানায় না। কেউ আমাকে ভালোবেসে কিছু গোলাপের পাপড়ি আমার হাতে তুলে দেবে সেরকম নিষ্কলুষ পবিত্র হাত আমার নেই।
এই হাত কাটা ছেঁড়া, এই হাত রক্তাক্ত।


এইহাতে ভালোবাসার ফুল শোভা পায় না। যেহেতু জেনে গেছি জীবনে আর কিছুই পাবোনা। তাহলে মিছেমিছি কাউকে আশা দিয়ে বুকের ভেতর স্বপ্ন দেখা ভুল। সেই স্বপ্ন একদিন বুকের ভেতর কাঁটা হয়ে চিরকাল আরো রক্ত ঝরাবে সেটা আমি চাইনা।
সেই সহ্য করার ক্ষমতা আজ আমার নেই। কখনো কখনো ভালোবাসা মানুষের জীবনে ফুল না হয়ে ভুল হয়ে আসে। সেই ভুলের ভুলে জীবন তখন যন্ত্রনাদগ্ধ হয়ে ওঠে। সেই যন্ত্রণা মানুষ পোড়া যন্ত্রণা। সে যন্ত্রনা জলন্ত আগ্নেয়গিরির যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা থেকে আমি তোমার দুয়ার থেকে চিরদিনের মত হারিয়ে গেলাম।


তাই বলতে হয়,
এইতো জীবন
পাওয়া আর হারানো
তবুও হাত বাড়ানো
মিছে আশা দুরাশা
জীবনের দাবদাহ।


তুমি ভালো থেকো কবিতা। তুমি কবির কবিতা হয়ে থেকো। পৃথিবীতে কত ফুল ফোটে। সব ফুল কি দেবতার পূজায় লাগে?
আমি তো ঝরা বকুলের মালা। যে মালা কাউকে গলায় পরিয়ে পূজার জন্য প্রার্থনা করা যায় না। ভালোবাসার ফুল তুলসী জলে তাকে আরাধনা করা যায় না। হাতের পুতুলের মত তাকে দুই হাতে নিয়ে আদর করা যায় না।


এখানে এই কবির ব্যর্থতা। কবির ভালোবাসা কবিতাকে নিয়ে। সেই কবিতা অনন্ত নক্ষত্রলোকের বাসিন্দা। যাকে ধরা যায় না, যাকে স্পর্শ করা যায় না। তবুও সে কবিতাকে ভালোবাসে।
আর এই ভালোবাসা সত্যিকার কবির ভালোবাসা।


কবি জানে কবিতা পরকীয়া নারী। তবুও পৃথিবীর সব কবি কবিতাকে ভালোবাসে। সে নারী কবিকেও ছলনা করে। লক্ষ কোটি পুরুষ কবির সাথেও পরকীয়া করে।


আমি আসলে কবিতার পরকীয়ায় আজ মদির মাতাল। আমি মাতাল হয়ে সেই পরম মানসী কবিতাকেই চিরদিন ভালোবেসে যাবো। তার ছায়া শরীর আমাকে নক্ষত্র ফুলের কাছাকাছি নিয়ে যায়। তার মায়াবী আত্মা আমাকে আত্মসম্মানে অভিভুত করে, প্রাণোদিত করে প্রাণের আলোতে।


নরমাংসের মাটির পৃথিবীর কবিতাকে কবি কখনো অন্তর আত্মা দিয়ে মনে হয় আপন করে ভালবাসতে পারে না। তাই কবির ভালোবাসা কবিতার সাথে।
মানবী প্রাণ আত্মার সাথে নয়। নিরাকার সাধনায় কবির দুই হাত তুলে প্রার্থনা করে কবিতার জন্য।


কবি তখন সত্যিকারের কবি হয়ে ওঠে কবিতার প্রেমের আকুলতায়। আর কবির শব্দের ক্রোমোজোমে কবিতা গর্ভবতী হয়ে ওঠে। তারপর কবির সন্তান জন্ম হয় কবির কবিতা।


তাই একজন কবির চিরন্তন প্রেম কোন মানব মানবীর সাথে নয় কবিতাময়ী ঈশ্বরের সাথে তার প্রেম। তার অন্তরাত্মা নিরাকার সাধনায় কবি হয়ে ওঠে সত্যিকারের কবি। নিরাকার সে সাধনা। অনন্ত আকাশের পথে নক্ষত্র ছায়ালোকে তার চিরন্তন আবাস।
🙏♥️🙏
কলকাতা রাত ১০.৪৫ - ১৪ মার্চ ২০২৪