লাল থেকে হলুদ থেকে সবুজ। সবুজ থেকে হলুদ থেকে লাল। চারমাথা জুড়ে ট্রাফিকের চাদর মুড়ে রেখেছেন স্বয়ং মহাকাল। কয়েকশো গাড়ি থমকে আছে। আরও কয়েকশো বাড়ি দমকে দমকে অল্পবিস্তর ধমকে এখনও বাঁচে। কাল অবধি অন্তত তাই ছিল। আজ সকাল থেকেই কোনও আওয়াজ আসছেনা। প্রেশার কুকারের সিটির আওয়াজ, তাড়াহুড়োর আওয়াজ, অসাবধানে পড়ে গিয়ে অযথা কেটে-ছড়ে যাওয়ার আওয়াজ, সুতো বেঁধে নেওয়ার পরে ভারী বুট ঠুকে উঠে দাঁড়ানোর আওয়াজ, দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকটা শূন্যতার আওয়াজ। কোনও কিছুই আসছেনা।


নিথর রাজপথ অলিগলি একের পর এক শাটার তোলা দোকানঘর। খুচরো ও পাইকারি মিলিয়ে মিশিয়ে অভিন্নপ্রজাতি, ভিনগ্রহী শবর। পসরা ঝুলছে স্বচ্ছ ও রঙীন তরলে ঈষদুষ্ণ ধোঁয়ায় নানান আকৃতি ও প্রকৃতির জিনিসে যা একটু হার্ড (hard)। জেরক্স মেশিন তামার তার নাটবল্টু স্প্রিং রিস্টওয়াচ এক্কেবারে নতুন সিমকার্ড। গন্ধ ভাসছে জিরে ধনে হলুদগুঁড়ো। মশলাপাতির ভারে জমজমাট বাজারে সাজানো বিয়ে অন্নপ্রাশন ফেয়ারওয়েল অথবা শ্রাদ্ধ রান্নাঘর থেকে ছিটকে আসা কেতাবি ধড়াচূড়ো। খাবার ঝুলছে দোকানে মানুষ নেই। নেই-মানুষের দোকানে খাবার ঝুলছে। দোকানে মানুষ ঝুলছে খাবার নেই। দু-চামচ ভাত বেড়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। কেড়ে নেওয়ার মতো কেউ নেই। চেটে চুষে চিবিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ছিবড়েটুকু ফেলে রাখার মতোও কেউ নেই। ম-ম গন্ধে ভরপুর পোলাও কোর্মা বিরিয়ানি সাজানো থালা আছে। গ্লাস আছে। পাশাপাশি চপ মুড়ি শালপাতার ঠোঙা আর অ্যাসিডিটির জ্বালা, তাও আছে। খাওয়ার মতো কেউ নেই। ক্ষিদের সাতকাহন লেখার কেউ নেই । স্টেশনারি জুড়ে বই খাতা পেন দিস্তে কাগজের মেলা আছে। ওলটানো হিসেবের দলিলে দুমুখো মগজের খেলা আছে। খেলোয়াড় নেই। রেফারী নেই। হাওয়া দিচ্ছে। সদ্য পাম্প দেওয়া ফুটবলেরা এদিক ওদিক সরে যাচ্ছে। লুকিয়ে পড়ছে নিভাঁজ কাপড়ের খাঁজে। নতুন জামা-প্যান্ট নতুন শাড়ি সালোয়ারে মোড়া পুতুলগুলো বসে অথবা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে নেওয়ার কেউ নেই। হাত বুলিয়ে দরদাম বুঝে নেওয়ার কেউ নেই। “যা নেবেন এক দাম, যা নেবেন এক দাম”-এর মতো এক-এক্কে-এক দুই-দুগুনে-চার নামতাওয়ালারা আজ নেই। কোথায় গেল  তারা, ক্লাসরুমে, সেও তো খালি। হলঘর বারান্দা দোলনা সিঁড়ি অফিস আসবাব সব দাঁড়িয়ে দেওয়াল ধরে, যেন নেহাতই দেওয়ালি। সার দিয়ে চেয়ার টেবিল রকমারি ঘড়ি কাগজ কলম ফুলদানি। ক্যালেন্ডারের পাতায় খোয়াব-ভর্তি বাড়ি-গাড়ি আর ব্ল্যাকবোর্ডবোঝাই বিয়োগ-যোগ আমদানি রপ্তানি। সেখানে আইসক্রিম ও ঠেলাগাড়ি আছে। নিখুঁত লেন্সে ধরে রাখা ফুটপাথজুড়ে সাজানো হকারি ও খবরদারি আছে। বাদামওয়ালার ঝুড়ি আছে। ডালমুটওয়ালার টুং-টাং ঘন্টা আছে। যেন সবকিছু ফেলে রেখে এইমাত্র কারা উঠে গেছে। উঠোনজুড়ে একান্নবর্তী জলচৌকিতে তৃপ্তি নয়, উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। সব যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটিই রয়েছে, শুধু মানুষ নেই। দুহাত উপুড় করে দেওয়ার মানুষ নেই। হিসেব বুঝে নেওয়ার মানুষ নেই। তর্জনীর উপর ব্যঙ্গ ঝুলিয়ে জীবন চিনিয়ে দেওয়ার মানুষ নেই। টিভি চলছে। রেডিও চলছে। শব্দ ও প্রেত-ধ্বনির মিছিলে সময় জব্দ হচ্ছে। কারও কানে পৌঁছচ্ছেনা। কেউ কান পেতে রাখছেনা, কান পেতে থাকছেনা।


গাছেরা থাকছে। গাছেরা লাইন দিয়ে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছে। তারা অজস্র শাখা প্রশাখা মেলে দিয়ে অনেকটা হাঁ করে থাকার মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সূর্যের সাথে সালোকসংশ্লেষীয় বোঝাপড়ায় নিজেদের  কূটনৈতিক বক্তব্য পেশ করছে। তারপর বিকেলের ঝোড়ো হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে হ্যাঁ অথবা না জবাব সাজিয়ে গোটা চাঁদ অথবা আধ-খাওয়া চাঁদ অথবা অন্ধকার থালা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ছে। স্বপ্নে দেখছে মানুষ। সমান্তরাল রেললাইনের মাঝে বেপরোয়া পা রেখে দু-হাত তুলে জবাব চাইতে আসা একা, এক বিলুপ্তপ্রায় মানুষ।


আগাছা ও পরগাছাদের প্রদেশে শিশির জমছে ঘাসের ফাঁকে। ভোর হচ্ছে লাল সূর্যে হলুদ ঘাসে সবুজ পাতায়। লাল থেকে হলুদ থেকে সবুজ। সবুজ থেকে হলুদ থেকে লাল। বিশ্ব-চরাচরের চারমাথা জুড়ে অদ্ভূত ট্রাফিকের চাদর মুড়ে রাখছেন স্বয়ং মহাকাল।


পৃথিবী আরও একবার শুধুমাত্র গাছেদের জন্য নিজেকে তৈরী করে নিচ্ছে।