আচ্ছা,৩৯ নম্বর শঙ্কর ঘোষ লেন থেকে ৪৮এ /৪৮বি কৈলাস বসু ষ্ট্রীটের দূরত্ব কতটা ? পায়ে হেঁটে বড়জোড় দশ মিনিট l কিন্তু বিশ্বাস করুন একশো ত্রিশ বছরেও পৌঁছনো গেল না l যেমন বোদ্ধা পাঠক এবং লেখকের মধ্যকার এক প্রশ্নের দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হোলো না l ট্রায়াল শেষ l যেহেতু আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই,তাই শেষ ইচ্ছের মতো করেই বিদ্যাসাগরের দ্বি শতবর্ষে অধমের প্রকাশিত  "মিথ" ( অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত) প্রসঙ্গে লিখছি শুধুমাত্র দায়বদ্ধতার খাতিরে,যাতে সমগ্র দৃষ্টিকোণ সবার কাছে পৌঁছয় l
এরপর ? পাঠক মূল্যায়ন শিরোধার্য l এটি ঠিক কবিতা নয়,ভাষ্য l রচনাকাল ২৭ /০৯ /২০১৯ l

          
"মিথ


- সৌমেন চক্রবর্ত্তী


কালেজষ্ট্রীটের সন্নিকটস্থ আবক্ষ মূর্তির মস্তকে রাজনীতির কাঠালখানি যেদিন ভাঙ্গিল,
মূর্তির মালিকের আফসোসের সীমা রহিল না l
ভাবিয়া দেখুন,
বর্নপরিচয়ের পথ পাড়ি দিয়া সমুদয় বঙ্গ বীর
সিংহের ন্যায় ক্ষেপিয়াছে "বিদ্দেসাগরের অপমান আমাদের অপমান,উনি আমাদের ভগবানতুল্য"...
এ ফ্যান ফলোইং চর্মচক্ষে দেখিবার সাধ কার না জাগে l
অবিশ্যি মূর্তির মালিক অবগত,ইহাদিগের ভিতরই কেহ কাঠালখানি ভাঙ্গিয়াছে,কেহ তাহার ফসল কাটিবে l


আক্ষেপ রহিল অন্যত্র l


বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় এই বীর সিংহ বাহিনী তাঁহার শুধু যে বিরোধিতা করিয়াছে তাহাই নহে,রীতিমতো প্রান সংশয় করিয়া তুলিয়াছিল l বিধবা বিবাহের গনস্বাক্ষর সংগ্রহে তাঁহাকে সমর্থন করিয়াছিলেন নয়শত সাতাশি জন,আর প্রতিবাদে গনস্বাক্ষর পড়িয়াছে ছত্রিশ হাজার সাত শত তেষট্টি l
আজ যাহারা পূজা করিতেছে,সেই দিন ইহাদিগের পূর্বপুরুষেরাই অগ্রাহ্য করিয়াছিলেন l
ইহারা সেই দিনও অন্ধ ছিল,আজও অন্ধই রহিয়া গিয়াছে l"


             দিনটা ২৬/০৯/২০১৯ l অন্যান্য বারের তুলনায় ঈশ্বর বরনের প্রস্তুতি চোখে পড়ার মতো l মারকাটারি প্রতিযোগিতা এপাড় বাংলায়,কে কত আপন করে নিতে পারে তাঁকে l শিক্ষানুরাগী যাঁরা ওঁনাকে তিনশো পয়ষট্টি দিন স্মরণ করেন প্রতি বছর ,সমস্ত কিছু ছাপিয়ে গেল গতবারের আড়ম্বর l ঈশ্বর চন্দ্র বেঁচে থাকলে চর্মচক্ষু সার্থক করতে পারতেন l কিন্তু তিনি হয়তো ভুলে যাননি হাতে গোনা ক'দিন আগেকার কথা l দিনটি ২০১৯ এরই ১৪ মে l ৩৯ নম্বর শঙ্কর ঘোষ লেনে কাঁচের বাক্স ভেঙ্গে প্লাষ্টার প্যারিসের তৈরী মূর্তি মাটিতে গুড়িয়ে গিয়েছে ছাত্র সংঘর্ষে l এটি সেই ঠিকানা,যেখানে তিনিই ১৮৭২ সালে প্রেসিডেন্সির সাহেব-সুবো মেধাকে দেশীয় মেধাবলে জবাব দেবার জন্য তৈরী করেন মেট্রোপলিটন ইনষ্টিটিউট l যা ১৯১৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে l প্রাক্তনীদের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে স্বামী বিবেকানন্দ,কেশবচন্দ্র সেন(সমাজ সংস্কারক),প্রফুল্ল রায় (বিজ্ঞানী),যতীন্দ্রমোহন দাস (স্বাধীনতা সংগ্রামী),রাম মনোহর লোহিয়া (স্বাধীনতা সংগ্রামী),গনেশ মান সিং (নেপালী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ),শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়,মান্না দে প্রমুখের নাম l ফ্যালফেলিয়ে এই ভাঙ্গা গড়ার খেলা দেখলো গোটা সমাজ,আরএই জনসমাগমপূর্ন শিক্ষাঙ্গন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ভগ্নপ্রায় ব্রাত্য আর একটি ঠিকানা, ৪৮ এ/৪৮বি কৈলাস বসু ষ্ট্রীট l এখানেই ১৮৫৬ সালের ৭ ই ডিসেম্বর রামধন তর্কবাগীশের পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন আর ব্রক্ষানন্দ মুখোপাধ্যায় ও লক্ষ্মীমনি দেবীর দশ বছরের বাল্যবিধবা কালীমতির প্রথম বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হয় l উদ্যোক্তা স্বয়ং তিনি l কিন্তু এ বাড়ী তো হেরিটেজ নয় ? তাই বোধহয় বিদ্যাসাগরের সাফল্যের সঙ্গে শেল্ফি তোলার হিড়িক পড়ে গেলেও তাঁর পদাঙ্কের সঙ্গে শেল্ফি তোলার লোক পাওয়া গেলো না l বিদ্যাসাগর কলেজে নতুন মূর্তি বসলো কিন্তু তদন্ত আজও অসমাপ্ত থেকে গেলো কোনো এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে l


             আমাদের মতো দেশে অন্ধ ভিড়কে সুকৌশলে ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজ l কখনো ধর্মের নামে,কখনো দেশপ্রেমের নামে l বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যখন আসমুদ্র হিমাচল স্বদেশী আন্দোলনে উত্তাল রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে
গোটা একটি জাতির একবুক আবেগের বিপক্ষে মতপোষণ করেছিলেন দূরদর্শিতার ভিত্তিতে l রবীন্দ্রনাথ যখন কালান্তর পত্রিকায় লিখলেন-"বস্তুতঃ যখন সমগ্রভাবে দেশের বুদ্ধিশক্তি,কর্মশক্তি উদ্যত থাকে তখন অন্যদেশ থেকে কাপড় কিনে পড়লেও স্বরাজের মূলে আঘাত লাগে না l গাছের গোড়ায় বিদেশী সার দিলে গাছ বিদেশী হয় না l "-তখন তাঁকে "শাসকের চামচা",একথাও শুনতে হয়েছিল l আজকে হলে হয়তো তিনি দেশদ্রোহী উপাধি পেয়ে যেতেন l আজন্ম লালিত সংস্কারে ইট মারবেন,আর পাটকেলটি খাবেন না,তা কি হয়? আপাদমস্তক নাস্তিক ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে পরাশর সংহিতার দু-লাইনের শ্লোক অস্ত্র করেছিলেনঃ "নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে;ক্লীবে চ পতিতে পতৌ "l ১৮৫৫ জানুয়ারী,বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে লেখা প্রথম সংস্করনের তিন হাজার কপি মূহুর্তে  শেষ হয়ে যাওয়ায় উৎসাহিত বিদ্যাসাগর আরও তিন হাজার কপি ছেপেছিলেন স্রেফ গনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য l কিন্তু ১৮৫৫ অক্টোবরে যখন তিনি ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত বিধবা বিবাহের দাবি পেশ করলেন,রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে  প্রতিবাদে স্বাক্ষর পড়েছিল ৩৬৭৬৩ l দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠলো l তৎকালীন সংবাদপত্রগুলি আড়াআড়ি দুভাগ ভাগ হয়ে গিয়েছিল l নামে বেনামে আজকের ঈশ্বরকে ব্যক্তিগত আক্রমন করে প্রকাশিত হয়েছিল বহু চিঠি l ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মত প্রভাবশালী কবি সরাসরি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে "সমাচার সুধাবর্ষণ" পত্রিকায় লিখেছিলেন-
      "...সাজো গো বিধবাগন ফুটিয়াছে ফুল
           তোমাদের সৌভাগ্য ঈশ্বর অনুকুল l"
সুতরাং দাড়িপাল্লায় ঝুঁকে পড়া ভিড় অতীতেও সবসময় সত্যের পরিচায়ক হয়নি l


         সাধুভাষা প্রয়োগের পিছনে অন্যতম অনুপ্রেরনা তৎকালীন এক দিকপাল সাহিত্যিকের প্রস্তাবের বিপরীতে অবস্থান l ১২৭৯ বঙ্গাব্দে "বঙ্গদর্শন" পত্রিকায় "বিষবৃক্ষ" ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় l সেখানে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র সূর্যমুখীর একটি চিঠিতে আমরা তাঁর মনোভাব পাই l সূর্যমুখী লিখছে "ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পন্ডিত আছেন,তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন l যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয়,সে যদি পন্ডিত,তবে মূর্খ কে?"
গৌরহরি সেনের "স্যার গুরুদাসের জীবনস্মৃতি"তে ধারাবাহিক আক্রমনের ধারা বজায় রেখে বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন "তিনি খানকতক ছেলেদের বই লিখেছেন বই তো নয় l"তিনি অবিসংবাদিত সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় l বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয় ২৯ শে জুলাই ১৮৯১,৭০ বছর বয়সে l জীবনানন্দ দাশ (জন্ম ১৮৯৯) তখন কোথায় l


           আলোচনার উপসংহার টানবো এই উপমহাদেশের ক্ষেত্রে আজও ভয়ানকভাবে প্রাসঙ্গিক সাদাত হোসেন মান্টোর কথা দিয়ে l বছর সাতেক আগে যাঁর জন্ম শতবর্ষ গেল নিঃশব্দে l মান্টোর "খোল দো " গল্পে দাঙ্গায় স্ত্রী হারানো সিরাজুদ্দিন পরমা সুন্দরী কন্যা সাকিনাকে উদ্ধার করতে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করেন l কিছুদিন পর স্ট্রেচারে শোয়া অচেতন মেয়েকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে দেখে ফিরে পাওয়ার আনন্দে সিরাজুদ্দিনও পিছু পিছু চেম্বারে ঢোকেন l ডাক্তার তাকে ঘরে আলো আসার জানালা দেখিয়ে বলেন "খুলে দাও" l অর্ধচেতন সাকিনা তৎক্ষনাৎ নিজের সালোয়ারের দড়ি আলগা করে নামিয়ে দু'পা ফাঁক করে দেয় l এত অসংখ্য বার সে বিধর্মী হিন্দু ও স্বধর্মী মুসলিমদের দ্বারা ধর্ষিত,যে "খুলে দাও" উচ্চারনের সাথে সাথেই যান্ত্রিকভাবে তার হাত সালোয়ারের দড়িতে চলে যায় l সাহিত্য বা কবিতা যাই বলি,তাঁর জানালা খুললে সবসময় আলো আসে না l যেহেতু এই সমাজ থেকেই তার জন্ম,তাই আলোর সাথে অন্ধকার দিকটিও বেআব্রু হয়ে পড়ে l


তথ্যসুত্রঃ সমসাময়িক বিভিন্ন পত্র পত্রিকা
           বিদ্যাসাগর কলেজ উইকিপিডিয়া l