বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বইয়েও অনেক ভাবে খুঁজেছি। কবিতার উপত্যকা। সেখানে নানা কাল, দর্শন, গুণীজনের কথা এসেছে। কিন্তু কোথায় কবিতার বাস, কোথায় কবিতার দল সেই চিন্তারা বেদনা দেয়। মনে হয় স্বপ্নের মতো আমি বসে আছি উঁচু চূড়ায়। হয় তো বা কেউ নেই। হয় তো সব ধূসর বা বরফ। কিন্তু সে অবস্থার অবস্থান তো আমার একার। একান্ত পরিব্রাজক মনের কিন্তু কবিতার তাতে কী? পূর্বের ভাগগুলিতে কবিতার সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক বলেছি। বিস্তারিত বলিনি বলে পাঠক প্রশ্নও করেছে। ভাববাদ দিয়ে দেখছি আমি....আসলে আমি তো কঠিন বিষয়কে সরল ভাবে বলছি। বা বলার চেষ্টায় পথ হাঁটছি। আসলে এই বাংলা কবিতার প্রাচীন গ্রন্থ চর্যাপদ। আর সেই চর্যাপদ নানা বৌদ্ধ ধর্মের পথ ধরেই এসেছে। তাই পুরাণ কথার সাথে আমি বিজ্ঞানের মিলিত মতাদর্শ আপনাদের সামনে রেখেছি। ঐ যে বললাম ভাষা বা ইতিহাস চর্চা আপনাদের বোঝানো ইচ্ছে ছিল কিন্তু পাঠকের সেই প্রকার তাগিদ না থাকায় আমি অন্য পথ ধরেই হাঁটব। তবে কবিতার উপত্যকায় পৌঁছাবই।
.
কবিতাই শেখায় জীবন, জীবিকা, সমাজের কথা বলতে, আবার এই কবিতাই বলে এসবের উর্দ্ধে কিছু একটা আছে, সেই জগতের খোঁজ করে কবিতাই। কবিতা যেন ভাবের বিষয়। খুব মনে পরে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা নিয়ে লিখেছিলেন –
ভাষার আশ্চর্য রহস্য চিন্তা করে বিস্মিত হই। আজ যে বাংলা ভাষা বহুলক্ষ মানুষের মন-চলাচলের হাজার হাজার রাস্তায় গলিতে আলো ফেলে সহজ করেছে পরস্পরের প্রতি মুহূর্তের বোঝাপড়া, আলাপ-পরিচয়, এর দীপ্তির পত্ররেখা অনুসরণ করে চললে কালের কোন্ দুরদর্গম দিগন্তে গিয়ে পৌঁছব।  তারা কোন্ যাযাবর  মানুষ, যারা অজানা অভিজ্ঞতার তীর্থযাত্রায় দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ের পথিক ছিল, যারা এই ভাষার প্রথম কম্পমান অস্পষ্ট শিখার প্রদীপ হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল অখ্যাত জন্মভূমি থেকে সুদীর্ঘ বন্ধুর বাধাজটিল পথে। সেই আদিম দীপালোক এক যুগের থেকে আর এক যুগের বাতির মুখে জ্বলতে জ্বলতে আজ আমার এই কলমের আগায় আত্মীয়তার পরিচয় নিয়ে এল।
.
ইতিহাসের যে বিপুল পরিবর্তনের শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে আদিযাত্রীরা চলে এসেছে তারই প্রভাবে সেই শ্বেতকায় পিঙ্গলকেশ বিপুলশক্তি আরণ্যকদের সঙ্গে এই শ্যামলবর্ণ ক্ষীণ আয়ু শহরবাসী ইংরেজ রাজত্বের প্রজার সাদৃশ্য ধূসর হয়েছে কালের ধূলিক্ষেপে। কেবল মিল চলে এসেছে একটি নিরবচ্ছিন্ন ভাষার প্রাচীন সূত্রে। সে ভাষায় মাঝে মাঝে নতুন সূত্রের জোড় লেগেছে, কোথাও কোথাও ছিন্ন হয়ে তাতে বেঁধেছে পরবর্তী কালের গ্রন্থি, কোথাও কোথাও অনার্য হাতের ব্যবহারে তার সাদা রঙ মলিন হয়েছে কিন্তু তার ধারায় ছেদ পড়েনি। এই ভাষা আজও আপন অঙ্গুলি নির্দেশ করছে বহুদূর পশ্চিমের সেই এক আদি জন্মভূমির দিকে যার নিশ্চিত ঠিকানা কেউ জানে না। ( রবীন্দ্রনাথ : বাংলাভাষা পরিচয়)
.
প্রায় ৮০,০০০ বর্গমাইল বিস্তৃত নদীবিধৌত পলি দ্বারা গঠিত এক বিশাল সমভূমি এই বাংলা। এর পূর্বে ত্রিপুরা, গারো ও লুসাই পর্বতমালা; উত্তরে শিলং মালভূমি ও নেপাল তরাই অঞ্চল; পশ্চিমে রাজমহল ও ছোটনাগপুর পর্বতরাজির উচ্চভূমি এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই বিস্তৃত সমভূমির দক্ষিণ দিক সাগরাভিমুখে ঢালু এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার জলরাশি দ্বারা বয়ে আনা বিপুল পরিমাণ পলি সাগরে উত্সারিত হচ্ছে। সমুদ্রোপকূলবর্তী নিম্নভূমি জঙ্গলাকীর্ণ; এর পেছনেই প্রায় পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল  সমতলভূমি, যার গঠনে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা প্রবাহের অবদান রয়েছে।  (আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খন্ডর অন্তর্গত)


তাই ভাষা ঠিকানার খোঁজ আমার অসাধ্য কিন্তু আমি কবিতার উপত্যকার কাছাকাছি পৌঁছাবো...তবে ইতিহাস নির্ভর লেখা তো বাংলা ইতিহাসের ইতিবৃত্তিতে পাবেন, আমি তো জীবনের খোঁজ করছি কবিতার জীবন। কবিতার উপত্যকা। আর সেই উপত্যকার মানুষের দর্শন বোধ ও চেতনা। এ এক সুবিশাল কাহিনী উপত্যকা। সেখানে আমার একার পক্ষে যাতায়াতের পথে ইতিহাসের পৃষ্ঠা স্পর্শ করতেই হবে। তবে আপনারাও পাশে থাকবেন। দেখা হবে হয়তো আপনার বাড়ির দরজায় পৌঁছে যাব কোনওদিন এভাবেই... হয়তো পাগল ভাষাশ্রমিককে দেখেই বন্ধ করে দেবেন দরজা, তবু যাবই আমি।  
.