“মহাবিশ্বলোকের ইসারা থেকে উৎসারিত সময়-চেতনা, consciousness of time as universal, তা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো”.....জীবনানন্দ দাশ এভাবেই সময়কে ব্যাখ্যা করেছিলেন। জীবনে বিসর্গ-চন্দ্রবিন্দুর পরেও প্রসারিত এক অনন্ত সময় পথ থাকে। মানবজীবী সময় সে পথ পেরিয়ে যায় নদীর স্রোতে ভাঙনে বর্ষার ম তো। ‘চরৈবেতি চরৈবেতি ---’ ধাবমান সময় জীবিতের কাছে মূল্যবান। যদিও জীবন সীমাবদ্ধ নয়। চরম ট্র্যাজেডি  অন্তহীন সময় মানুষ জীবিতদশায় পায় না। কবি সুইনবার্ণ বলেছেন – ‘His life is a vision or a watch between a sleep and a sleep’ দুই প্রান্তেই ঘুম, ঘুমের মতো অচেতন অন্ধকার। মাঝে ফিনিক্সের মতো প্রেয়সীর সুন্দর চোখে অনুভূত জীবন। কবি বলছেন ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর।’ বুঝতেই পারছি সময় অনন্ত কিন্তু জীবন অতি সামান্য ভগ্নাংশ, জন্ম-মৃত্যুর মাঝে তোমার ঠোঁটের ভাজ লিপস্টিক না দিলেও যেন যৌবন ফিরিয়ে দেয়।  চলমানতাকেই মূল্যবান সম্পদ করে যোনি পেরিয়ে, সদা-চঞ্চল মন সব কিছু কিনতে পারে, পারবে আদর করার সেই মুহূর্তগুলো কিনে দিতে। না ক্রয় ইচ্ছা সময়কে কিনতে পারবে না। সময়ের যথার্থ মূল্যবোধই জীবনে সাফল্য অর্জনের একমাত্র সোপান। তাই তো সময়ের কাজ সময়ে না করতে পারায় তুমি আমার ভালবাসা বুঝতে পারলে না, না পারলাম আমি। অথবা পেরেছি। সময়কে অমর্যাদা করলে পরাজয়ে ভাগ্যলিপি বহন করতে হয়। আমনের সময় আউশ বা বোরো ধান ছড়িয়ে দাও একদিনের জন্য সেলফির বন্ধু পাবে, কিন্তু চিরজীবন সে থাকবে না।
আলস্য ভরা খিঁচুড়ি দিনে বিরিয়ানি লাগে না, আবার দুর্গাপুজোতে সময় যে কিভাবে চলে যায় ম্যাডাক্সে-বাগবাজারে নিজেও জানি না। রোদ থাকতে ধান শুকিয়ে নিতে হবে। জীবন-সায়াহ্নের তাহলে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না। কালহরণ না করে ঠিক ঠাক কবিতা তাই লিখে ফেলতে হয় ভালবাসার ঠোঁটে –তোমায় ভালবাসি...বলেই ফেলুন। আমরা আছি। সৃষ্টির প্রারম্ভের বহুপূর্বে সময়ের সূত্রপাত। কালক্রমে পৃথিবীর জন্ম হয় মহাসময়ের শুভক্ষণে। তারপর বিয়ে। তারপর মহাভারতের সেই রথের চাকা ঘুরতে থাকে হালফ্যাশনের লেড ঘড়ির মতো। দিনরাত্রির মালা ফুলসজ্জায় মেদবর্জিত এক সিক্সপ্যাক দিতে পারে তবে সময়ের সাথে উৎশৃঙ্খলতা দেবে শুধু ডিভোর্স। তাই নখ বড় হলে নখ কাটব আঙুল না, ঠিক সম্পর্কের কালাপাহাড়ে ডিভোর্স না, কেবল ভুল বোঝাবুঝিকে ট্রিম করে দিতে হবে। বর্ষা ঋতু শরতের দুগ্গা পেরিয়ে শীতের আমেজ ছুঁতেই লিটিল ম্যাগাজিন মেলার ধুম। নবান্নের আলপনা দিতে দিতে মেলা শেষে তোমার চোখেই দেখতে চাই আমার সর্বনাশ। চৈত্র শেষেই তো ফুলের ডালি নিয়ে হাজির বর্ষবরণ আবার রবীন্দ্রজয়ন্তী।
কর্মব্যস্ত ডাব্লুপি, ফেবু অ্যাডমিন সামলাতে সামলাতে ‘কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই নাই।’ তাই দেখি আজকাল প্রেমগুলো তিন মাসের রিসেন্ট গানের মতো সত্য। ‘জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই ভুবনের ঘাটে ঘাটে-এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে।’ বেহুলা এভাবেই সৃষ্টিকর্মের সাফল্যের জীবনের যথার্থ পরিপূর্ণতা খুঁজে পায় শঙ্খচিলের ডাকে। দেশভাগের কাটাতার পেরিয়ে এড়িয়ে আমরা ভেসে চলি ধ্রুবতারার রাতে। যাবে আমার সাথে ঐ চল্লিশ তলা উঁচু ছাদে! উফ সুইসাইড না, একটু দেখব জ্যোৎস্নারাতে শহরের সৌন্দর্য আর তোমার চোখের মণি।
সময়ের এই চলা অকারণ নিরর্থক নয়। কল্যাণময় সুন্দর পরিণাম আসবে এই নটোরাজের ছন্দে। নব-নব সৃষ্টিতে কত না-বিলয়। সৃষ্টির নব নব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে পবিত্র শাড়ি সাজে ভেজা এলো চুলের শারদাঞ্জলি অনন্য এক মুহূর্ত। বস ডিএসএলআর চাই। ‘যদি তুমি মুহূর্তের তরে ক্লান্তভরে দাড়াও থমকি, তখনি চমকি উচ্ছ্রিয়া উঠিবে বিশ্ব পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুর পর্বতে।’ অন্তহীন চেতনার অনুরণনে সময় তাই চলমান, প্রাণহীন মৃত্যু-পরিকীর্ণতা পেরিয়ে ‘আসব যাব চিরকালের এই আমি।’ আবার কেউ বলেন ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই’ বঙ্গ বা বাংলা-য়। বাস্তববাদী বলেন ‘I shall not pass this way again’ তা বটে একই প্রেম এখন বারংবার কেউ চায় না। সময়ের দরবারে স্মরণীতার দাবি রাখতে হবে। স্বামীজি বলেছেন ‘যখন মানুষ হয়ে জন্মেছিস, তখন একটা দাগ রেখে যা।’ এই দাগ কিন্তু ধর্ষণের নয় চাই চেতনার স্বর্ণতিলক, গ্রুপফির গ্রুপ মিট। তবে নির্মাল্যরা যখন কম বয়সে চলে যায় কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত বলে তখন আশার বাণী না দিতে পারলেও সময়ের কাছে বলে যাই ‘জীবনের মূল্য আয়ুতে নয়, কল্যাণপূত কর্মে।’ মুশকিল হল এই সময় বিসর্গের কথা সাধারণ সিরিয়ালজীবীদের শোনাতে গেলে বলবেঃ ‘নাই, নাই, নাই যে সময়।’ তাই বাঙালিদের রবি ঠাকুরের কথা বলে যাই টাইটান অরবিটে ফেরত যাওয়ার আগে – ‘বিশ্বের একটা বাইরের দিক আছে, সেইদিকে সে মস্ত একটা কল। সেদিকে তারা বাঁধা নিয়মে একচুল এদিক ওদিক হবার জো নেই।’