প্রবন্ধঃ বাংলা ভাষার উৎপত্তি, নামকরণ ও বিলুপ্তি


প্রবন্ধের শিরোনাম পড়েই সবার চোখ ছানাবড়া নিশ্চিত। তাই দেরি না করে আলোচনাখানি শুরুই করি। দেখেন মহোদয়, ফেব্রুয়ারী মাস এলেই আমাদের মধ্যে একটা চেতনার জন্ম নেয়; সেটা আহ্লাদে হোক আর মনের গভীর থেকেই হোক। আমরা উপলব্দি করি জাতিগতভাবে শুধু আমরা বাঙ্গালী নই, আমরা ভাষাগত দিক থেকেও বাঙ্গালী। এই চেতনা থেকেই আমাদের মাঝে ভাষার প্রতি একটু আলাদা আহ্লাদ বা ভালবাসা জন্ম নেয় তখন।


আমাদের যাদের সে সময় জন্মই হয়নি তারা হয়ত সবাই ভাবি- কোন চেতনায় রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছিল। এই ভাবনাটা আর সবার মতো আমার নিজেরও হয়। পাশাপাশি ভাবি, যে প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাংলা ভাষার জন্য তাজা প্রাণগুলো উৎসর্গকৃত হয়েছে, আমরা কী জানি সেই ভাষার মৌলিক উৎপত্তিগত ইতিহাস। আমার মনে হয় খুব কম শিক্ষিত লোকই এর ইতিহাস জানেন। আবার এও ভাবতে হয় যে, আমাদের এই প্রাণের বিনিময়ে রক্ষিত ভাষাটা আর কতদিনই বা টিকে থাকবে পৃথিবীর বুকে।


আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা এর নামোৎপত্তি হয়েছে জাতিগত মূল থেকে। অর্থাৎ জাতি হিসাবে আমরা বাঙ্গালী আর এই ‘বাঙলা’ থেকেই আমাদের ভাষার নাম ‘বাংলা’ এর বিকাশ। আর একটু মূলে যদি ভাবি তাহলে প্রশ্ন হতে পারে ‘বাঙলা’ শব্দটির জন্ম নিয়ে। আমাদের বাঙ্গালী জাতীর উৎপত্তিগত ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছরের। সে ইতিহাস জনপদ, কাব্য আর গানের। সে ইতিহাস এখনও কেবল অনুমান করা যায়, নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।


বহুকাল আগে এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে জনপদ বা ঔপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। তখন ছিল না নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্র-মানচিত্র। এদের মধ্যে গৌড়, পুন্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল আর বঙ্গ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে বঙ্গ ছিল সবচেয়ে পুরানো জনপদ। আর সেই বঙ্গ থেকেই আজ আমরা বাঙ্গালী এবং আমাদের ভাষার নামকরণ। তাই আমাদের বাংলা ভাষার নামোৎপত্তিকে আমরা শুধু প্রাকৃতিক নয় একে আমরা অতিপ্রাকৃতিক একটি প্রক্রিয়া বলতে পারি। এতো গেল নামোৎপত্তি কিন্তু আমাদের ভাষার উৎপত্তি কিন্তু ভিন্ন।


ভাষা বিশেষজ্ঞগণেরা মনে করেন ভারতীয় আর্য ব্রাহ্মী লিপি হতে বাংলা বর্ণমালা উদ্ভুত। সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ধ্বনিগুলোকে প্রকাশ করবার জন্য ব্রাহ্মী লিপির সৃষ্টি হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মহারাজ অশোকের সময়ের শিলা থেকে এই লিপি পাওয়া যায়। এই ব্রাহ্মী লিপির প্রাচিন রূপই পরিবর্তিত হয়ে বাংলা, দেবনাগরি, বর্মি, শ্যামি, তিব্বতি প্রভৃতি বর্ণমালার উদ্ভব ঘটেছে।


ভাষার ইতিহাস প্রায় অসীম। মনের ভাব যথার্থভাবে প্রকাশের জন্য কালে কালে যুগে যুগে ভাষার রূপ পরিবর্তন হয়েছে। তাই ভাষার ইতিহাস জানার জন্য ভাষা শ্রেণীকরণের প্রধান পদ্ধতি হল ‘বংশগত শ্রেণীকরণ’ পদ্ধতি। অনেকের মতে এটাই একমাত্র পদ্ধতি যার সাহায্যে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীগণ ভাষার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেন। আর সেই আলোকেই বাংলা একটি মিশ্র শব্দের ব্যবহারিক ভাষা হওয়া সত্ত্বেও তার উৎপত্তি মাগধী অপভ্রংশ থেকে। বহুভাষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তা-ই মনে করেন। যদি একেবারে মূল থেকে বলি তাহলে বলতে হয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের শতম শাখা থেকে ইন্দো-ইরানীয়, ইন্দো-ইরানীয় থেকে ভারতীয়, ভারতীয় থেকে প্রাকৃত ও প্রাকৃত থেকে মাগধী; আর এই মাগধী থেকে বিহার, আসামী, উড়িয়া ও আমাদের বাংলা ভাষা।


উৎপত্তি আর নামকরণ যাই হোক না কেন আমাদের মনে রাখা উচিৎ, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি। আর এই ভাষার উৎপত্তি ও নামকরণ আমাদের জানতে হবে এই জন্য যে, ক্রমপরিবর্তনশীল বিশ্বভাষা শ্রেণীকরণে এই বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত হওয়া বা শ্রেণীকরণে পেছনে পড়া থেকে বাঁচিয়েছে আমাদের সেই ভাষা সৈনিকগণ। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই এই বাংলা ভাষার স্থায়ীত্ব ঘটেছে। কথাটা অনেকের কাছেই হয়ত খটকা লেগে গেল, তাই না? আচ্ছা, একটু পরিষ্কার করছি। কেলটীয়, জার্মানী, ইতালীয়, গ্রীক, আনাতোলীয়, তোখারীয়- এই সকল ভাষার ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায় যে, গত শতকে কতই না পরিবর্তন ঘটেছে এই সকল ভাষায়। কে জানে যে, হয়ত একসময় হারিয়ে যাবে না এই সকল ভাষার স্থায়ীত্ব। তবে কী বুঝা যায় না যে, বাংলা ভাষার স্থায়ীত্বে কতটা ভূমিকা রাখবে আমাদের ভাষা আন্দোলন? প্রতি ফেব্রুয়ারী মাসে আহ্লাদে হোক আর ভালবাসা থেকেই হোক আমরা যা করি বা করছি তা মোটেও মানেহীন নয়।