আযান পরিছে দূরে,
আলস্য ছাড়ি উঠি বসিলাম, আঁধার তখনো ঘরে।
অনুমান করি, দু’এক পা হাঁটি দুয়ার দিলেম খুলে,
গতরে লাগিছে ভোরের হাওয়া মন পুলকে দোলে।
নিচু স্বরে কহি মানিকের মা’রে, ফজরের অক্ত যায়,
অজু করি লও নামায পড়ি, বেলা উঠি যাবে ঠায়।
মানিকেরে দাও উঠায়ে এখন, মক্তব হইবে শুরু,
আমি ততখনে গরুঘর হতে নামায়ে আসি গরু।
গরু বাঁধিলেম মাচার তলায় বাঁশের খুঁটির সাথে,
গামছা লইয়া এইবার হাঁটি শরমের কাজ সারিতে।
সোজা ঘাঁটে আসি অজু করা সারি, নামাজের অক্ত যায়,
গামছা গায়ে জায়নামাজে নামায করিলেম আদায়।
মানিকের মায় নামায পড়ি, উঠোন কুঁড়োতে গেছে,
মানিক তখনো ঘুমের মরায় পাটিতে লুটিয়া আছে।
মানিক! বাজান, উঠি পরো এখন মক্তব যাইতে হবে,
চুঙ্গার ফুঁকে হুজুর ডাকিছে, শিশুদের মক্তবে।
তন্দ্রা ভাঙ্গি মানিক উঠিল, আমি তুলিলাম পাটি,
মানিকেরে কহি, কুলি করি লও দুয়ার সামনে ঘটি।
মানিকের মা ঘরে আসিলো, দুটো ডিম হাতে করি,
উঠোনে দিলো হাঁস-মুরগীরে আধাসের ধান ছড়ি।
কহিলাম ডাকি মানিকের মা’রে, মানিকরে দাও সাঁজায়ে,
আগে যদি না বসিতেই পারে, কিছু বুঝিবে মক্তব যেয়ে?
তড়িগড়ি করি, পাঞ্জাবী টুপিতে মানিক সাঁজিলো বাবু,
কাগজে দুখান বাতাসা দিলেম, যেতে যেতে খাস বাপু।
আমি চলিলাম গোয়াল ঘরে, মানিক মক্তবের পথে,
গোবর চ্যানায় পানি ঢালিলাম, ঝাড়ু মারিলাম তাতে।
মানিকের মা’য়ে মরিচ পুরিছে, এতদূর আসে ঝাঁজ,
আজ পান্তা ছাড়াই মাঠে যাইবো, অনেক রহিছে কাজ।
ঘাঁটে আসি ফের হাত-পা ধুলেম, গতর নিলেম মুছি,
মানিকের মা’য়ে দড়ি দিয়ে যায়, আমারে দেখিতে খুঁজি ।
লাঙল-জোয়াল কাঁধে চাপিয়া, গরু ছাড়িলাম পরে,
গরু দুইটা’রে হাহা-ডা করি মাঠের এ পথ ধরে।
মানিকের মায় পিছু পিছু আয় পুকুর ঘাঁটের কাছে,
কহিলাম তারে, দুধের গরুটা বাইধো একটু ঘাসে।
কহিলাম আরো, পান্তা পাঠাইও মানিক আসিলে ফিরি,
আমি ততখনে পূর্বের মাঠে কালকের চাষ ধরি।
মাঠে আসি চাষ করিলাম শুরু, কালকের শেষ থেকে,
চলিতে চলিতে লাঙলের ফলা চাষের শেষের দিকে।
দূরে দেখা যায়, মানিকের মায় মাঠের এদিকেই আসে,
গামছায় বাঁধা পুঁটলির মত রহিছে তাহার কাছে।
গামছায় বাঁধি পান্তা আনিছে তখন বুঝিতে পারি,
মানিক বুঝি খেলিতে গেছে মক্তব হইতে ফিরি।
মানিকের মায় আসিয়া কহিলো, ‘খাইয়া লন দেখি আগে’
মানিক আসি খেলিতে গেছে গাঁয়ের পোলাগো লগে।
কাঁধের গামছা বিছায়ে দিলেম, ‘মানিকের মা তুমি বও’
ছোটমানুষ ও খেলিতে গেছে, করার কি আছে কও।
মুখ-হাত ধুলেম ঘটির জলে, কুলি করিলেম সাথে,
মানিকের মায়ে ভাত বাড়িছে ততখনে নিজ হাতে।
তালের ডগার ছায়া পরিছে গামছার ছোট ঘরে,
পিয়াজে, মরিচে পান্তা মাখিলেম অভুক্ত ক্ষুধা ধরে।
ডিমের ভাজি আনিছে সাথে আরেক বাটির তলে,
অমৃত স্বাদ মুখে তুলিলাম শান্তি পেলাম গলে।
মানিকের মারে এক লোকমা, মুখেতে দিলেম তুলি,
আর খাবোনা! খাবোনা ভান ধরি সে, পেছনে রহিলো ঘুরি।
তবু জোর করি, এদিকে ফিরায়ি লোকমা করিলেম ভাগ,
তুমি মোর অনেক লক্ষ্মী বউ আছো, কহিলাম ধরে হাত।
মানিকের মায় লাজে মরি যায়, ঘোমটা টানিয়া লয়,
হাত ছাড়ি দ্যান মাইনষে দেখিলে অপবাদ দিবে ঠায়।
মাইনষের বউয়ের হাত কি ধরেছি ? আমার বউয়ের হাত,
মাইনষের বুঝি বহিয়াই গেছে, আমারে দিতে অপবাদ।
অনেক হইছে এখন ছাড়েন ফিরতে হইবে বাড়ি,
দুপুরের চুলায় আগুন না দিলে, কি খাইবেন আসি ফিরি।
ঘটি-বাটি গুলি গামছায় বাঁধি, মানিকের মা ফিরে গাঁয়,
পরাণ জিরান অনেক হইলো কামে মন দিতে যাই।
দক্ষিণের মাঠে করিলাম শুরু চালাতে লাঙল ফলা,
চাষে চাষে যায় সবল-সময় মধ্য আকাশে বেলা।
প্রখর রৌদ্রে তেষ্টা লাগিছে বুক ছাতি ফাটি যায়,
লাঙল ছাড়ি গলা ভিজালেম বসিয়া একটু ছায়।
দূর মিনারে আযান পরিছে সুর ভেসে আসে তারই,
এতটুকু জমি চাষের বাকী, শেষ করেই ফিরি বাড়ি।
এ জমির চাষ শেষ হইলো আজ লাঙল ফলার তলে,
গরু দুইটা’রে ছাড়িয়া দিলেম ঘাস দেখি নদী কূলে।
বর্গা জমিতে চাষ ধরিবো, নাওয়া খাওয়া আসি সারি,
ঘটির জলেতে মুখটা ধুয়ে, আসিলাম বাড়ি ফিরি।
পুকুরের ঘাঁটে নাওয়া শেষ করি, উঠিলাম গিয়ে ঘরে,
মানিক এখনো ঘরে আসেনি সেই যে সকাল ধরে।
মানিকের মায় ভাত বাড়ি কয়, ‘আপনে খাইয়া যান আগে’
মানিকেরে আমি খুঁজি আনিতেছি, দেহি গেছে কাগো লগে।
কতখন পরে মানিকের মায়ে, মানিকরে লয়ে আসে,
নাওয়ায়ে ধোয়ায়ে, তেল-পানি গায়ে দিয়ে যায় আমার কাছে।
মায়ের সাথে ভাত খাবি সে, এখন খাবেনা কিছু,
জোর না করি, আমি শেষ করি বসে থাকা হবে মিছু।
মানিকের মায় ঘরে আসিলো তার কিছুখন বাদে,
তামাক জ্বালায়ে, আমি হাঁটিলাম আবার মাঠের দিকে।
গরুর কাঁধে জোয়াল দিলেম চষিতে বর্গা জমি,
সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে, আসরের আযান শুনি।
গামছা বিছায়ে মাঠের বুকে নামায নিলেম পড়ে,
পরাণ জুড়ি যায়, দখিনা হাওয়ায় মাঠের পুরোটা জুড়ে।
ফের গরু চলিছে, লাঙল চলিছে, আমি চলিছি পিছে,
আস্তে আস্তে সূর্য ঢলিছে ঘন সবুজের কাছে।
পাখিদের দল ছুটেছে সকল, আপন নীড়ের খোঁজে,
অস্ত সূর্য দিচ্ছে জানান সন্ধ্যা তাহার ভাঁজে।
অতদূর ধরি সুর ভাসি আসে, আযান পরিছে দূরে,
লাঙলের চাষ থামাতে হইবে আজিকার মত করে।