আযান পড়িছে দূরে
লাঙলের চাষ থামাতে হইবে আজিকার মত করে।
গরু দুইটা’রে ছাড়িয়া বাঁধিলাম লতা-পাতা, ঘাস দেখি,
আমি ততখনে নদীর কূলে গতর ধুইতে লাগি।
ফেরত আসি, ঘটি বাটিগুলি গামছায় লই বেঁধে,
গরু বাছুর ছাড়ি, হাহা-ডা করি গাঁয়ের পথের দিকে।
অতদূর ধরি জোরে ডাক পারি ‘মানিকের মা কি বাড়ি ?’
গরু দুইটা’রে উঠানে বাঁধো তো গোয়াল ঘরে দড়ি।
সারা গায়ে মোর বিষের ব্যাদনা বসিলাম পুকুর পাড়ে,
কালির মাজন দিয়ে যাইও দেখি, গরু বাঁধা হইলে পরে।
কুপি হাতে করি মানিকের মায় আসিলো মাজন নিয়া,
সুধালো মোরে ‘কহন যাইবেন হাঁটের দিকে? রাইত তো যাচ্ছে বইয়া।’
তড়িঘড়ি করি কুলিকরা সারি কহিলাম চলো ঘরে,
বাজার সদায় লাগিবে যখন আগে বলিবা না মোরে!
তেল-পানি লয়ে সমস্ত গায়ে মাখিলাম ঘরে বসি,
‘মানিকের মা দিয়ে যাও দেখি পাঞ্জাবীখানা আসি।’
পাঞ্জাবীখানা গতরে জড়ায়ে তেলের শিশি হাতে,
খড়ম জোড়া দুপায়ে পরি রওনা দিলেম হাঁটে।
চাঁদনী রাতের আঁকা বাঁকা পথ স্বর্গ পথের মত,
জোনাকি তাহার দুপাশে দাঁড়ায়ে জ্বলে নেভে অবিরত।
হাঁটিতে হাঁটিতে পৌঁছে যখন শত কুপি জ্বলা হাঁটে,
সবার আগে তামাক নিলেম জ্বলায়ে আঙ্গুল ফাঁকে।
পান-সুপারি জর্দা নিলেম, পুঁইয়ের ডাটার সবজি নিলেম, শিশিতে নিলেম তেল
মাছের বাজার বন্ধ হওয়ায় ডাল নিলেম আধাসের।
আসিবার কালে মানিকের মায় কহিছিলো নিচু স্বরে,
দুই পয়সার বাতাসা যেন লইয়া যাই মনে করে।
শেষ মুড়োতে বসিছে জিলিপি, বাতাসার দোকানিরা!
ব্যাগ লয়ে হাতে, হাঁটিছি সেদিকে পায়ে নেই কোন তাড়া।
চার পয়সার বাতাসা নিলেম, গরম জিলিপি সাথে,
রাত্রি অনেক হইলো বুঝি, ফিরি যাই গাঁয়ের দিকে।
কোলাহল ছাড়ি, দু এক পাঁ করি নিজ্জুম মেঠো পথে,
রোদ্রের মত ছায়া হাঁটিছে আমার সাথে সাথে।
ধানক্ষেত গুলি সিক্ত শিশিরে, দূর কুয়াশায় ঢাকা,
শিয়ালের ডাকে, ভয় একটু লাগে এ যাত্রায় আমি যে একা।
হাঁটিতে হাঁটিতে বাড়ির উঠোন আমার পায়ের তলে,
মানিক! মানিক! ডাক শুনিয়া কে যেন দরজা খোলে।
মানিকের মা উঠোনে আসিলো কুপি বাতি লয়ে হাতে,
বাজার-সদায় তার হাতে পুরি, আমি চলিলাম ঘাটে।
হাত পাঁ ধুলেম ঠাণ্ডা জলে পুকুরের ঘাটে আসি,
পেছনে দেখি মানিক বাজান গামছা লইয়া বসি।
সারাদিন তুই কনে ছিলি বাপ? সন্ধায় দেখিনি যে ঘরে!
বাতাসা খাবি? আয় কোলে আয় বাতাসা দিমুনে তোরে।
বাজানরে মোর কাঁধে চড়াইয়া আসিলাম ঘরে ফিরি,
কহিলাম ডাকি বাতাসা-জিলিপি দ্যাও দিখি তাড়াতাড়ি।
মানিকের মায়ে, ততখনে গিয়াছে চুলার পিঠের কাছে,
ডাকিয়া কহিলো, বাতাসা-জিলিপি সিকের ডালায় আছে।
নামায়ে দিলেম বাতাসা-জিলিপি মানিকের দুই হাতে,
দুইখান তোমার মায়েরেও দিও, খুশি হইবো মা তাতে।
কহিলাম ডাকি, ভাত উতলতি আর কত হইবে দেরী?
পেটের খিদে যে, বুকে উঠি আসে গ্যাসের ব্যদনা ধরি।
কহিলো আমায়, বেশী দেরী নয় ভাত তো হইয়াছে আগে,
চুলায় রহিছে পুঁইয়ের ডাটা, সিদ্ধ হওয়াতো লাগে।
মানিকের ডাকে তন্দ্রা ছুটিলো,‘বাজান খাইতে আও’
ভাত বাড়ি মায়ে বসিয়া রহিছে, খাওয়া শেষ করি যাও।
দুই পাঁ হাঁটি, জলের ঘটি, হাতে নিয়া কুলি করি,
আসমান দেখি তখনো রহিছে চাঁদের আলোয় ভরি।
কাঁসার থালায় ভাত বাড়ি দিছে, একপাশে পুঁই ঝোল!
রাজ্যের খিদে শেষ করিলাম লোকমায় অনর্গল।
একই থালায় ভাত মাখিছে মা আর ছেলে মিলি,
দু’এক লোকমা আমিও দিলেম মানিকের গালে তুলি।
খাওয়া শেষ করি, শুকরিয়া খোদা অনেক খাওয়াইলা আজ,
দয়া-মায়া করি কত ভালো রাখো;তবু তোমার করিনে কাজ।
মানিকের মা, বিছানা দিয়াছে মাটিতে বিছায়ে পাটি,
তিনজন মিলে শুয়ে পরিলাম, অনেক হইয়াছে রাতি।
ফুঁ’য়ে নিভে যায় কুপির বাতি, নিজ্জুম অনেক রাত,
চালের ফাঁকে তখনো হাসিছে দূর আসমানের চাঁদ।
ঠাণ্ডা প্রাণে নিঃশ্বাস টানি, ঘুম চলি আসে ঠায়,
গভীর ঘুমে যাচ্ছি চলি প্রভাতের কামনায়।