একদিন বিকেল বেলায়-
বসেছিনু ঘাসের উপরেই মাঠের কোনের দ্বারে
হঠাৎ কে যেন এসে পেছন থেকে উপচে পড়ে ঘাড়ে।
ঘাবড়িয়ে দেখি ছেলেটি আমার দেখাচ্ছে ভয় মোরে
সেই খুশিতে নাচছে তেড়ে; আরো হাসছে জোরে নোড়ে।


ছেলেটি এখন শিখেছে হাঁটা কথাও বলতে পারে,
সুযোগ পেলে যখন-তখন আবদার ধরে ছাড়ে।
সেদিনও চেপেছে আবদার! শুনবে পূরনো কথা
অজুহাত খাটেনি ওর কাছে দিতে হবে উত্তর যথা।


মনে পড়তে চোখ বেয়ে পড়ে অশ্রু, হাজারো দিনের ব্যথা
স্মৃতির পাতায় আটকিয়ে রেখেছি না বলা অনেক কথা।
শোন হে বাঁচা! তবে তা শোন! বাল্যকালের না বলা বয়ান
ছিলেম মা-বাবার আদরের টুকরো কলিজার পরান।


ঘর হতে কোথা যেতো না দিতে, হয়ে ছিলাম কাজল রূপে
একটু চোখের আড়াল হলেই কেঁদে ভাসাতো বুক হুপে।
তবু ফিরতেম পথিকের ন্যায় সারা গাঁয়ের পথ বেয়ে
নদী নৌকাও ছিল খেলার সঙ্গী ছুটে যেতাম দূর চেয়ে।


সন্ধ্যা হলেই আলো জ্বালিয়ে বসতাম মায়ের ধারে
শেষে ভূতের গল্পে ভরে যেত ঘর, গাত্র হতো ভারে।
এদিকে অনেক খাটুনি করতো পিতা, দিতো না বুঝতে মোদের
যতই কষ্ট দিতো জোতদার, কখনো অভিসম্পাত দেয়নি ওদের।


অভাবে রাখেনি কখনো মোদের যা চেয়েছি দিয়েছে সাধ্যমতো
শুধু চেয়েছে ছেলে একদিন হবে বড়, দশের সমান ততো।
সুখের সংসারে কাটছিলো দিন হচ্ছিলাম যে বড়
পিতামাতার শেষ সম্বল আমি ভাবিনি হয়ে নর ।


নির্দয় ভাগ্যই কেড়েছে জনক, দিয়েছে এতিম করে
অগস্ত্য যাত্রায় পাড়ি জমিয়ে আছে, দেখছে কোন সুরে।
কতই না মায়ে করতো সেবা পিতা ফিরতো যখন ঘরে।
সেদিনও বসে ছিল মা রাখছে দরজা নয়ন নজরে।


পিতার আগমন যে চিন্ন হয়েছে মেদিনী মায়া হতে
বুঝেও মা না বোঝার ভান করে স্বান্তনা ছড়ায়ে সুতে।


ছা-পোষা পরিবারে জন্মেও হয়েছি ননীর পুতুল
ঘর সংসারে কিভাবে ধরিবো হাল খুঁজে পাইনা তো কূল।
জননীর কষ্ট লাগেনা ভালো সহ্য করছি বারোমাস,
এবার ভেবেছি দেবো মুক্তি তাকে; স্বজমি করবো চাষ।


একদিন মা বলিল, রাজা, পড়াশোনা মন নাহি বুঝি তোমার
এ দুঃখিনী জননীর কথা ভেবে ভেবে সময় করেছ অপার।
জনয়িতার কথা ভুলে গেছো কি? শেষে বলেছিলো কি তোমায়?
বংশের গৌরব রাখিবে, যতই মুচিবত আসুক ধরায়।


টনটন করে বেজে উঠিল চনমন সেই বাণী
পড়াশেষে স্বপ্ন দিলাম ঘুচিয়ে মায়ের শক্ত ঘানি।
এবার মায়ের মুখে হাসি ফুটিল, অশ্রু ঝরে চোখে
আজ পিতা থাকিলে বেচেঁ কত খুশি না হতো উন্মুখে।


বিশুষ্ক মলিন মুখে মায়ের উথল্ ধ্বনি উদীর্ণ
পারছিনা আর বয়সের বাড়ে নুয়ে হচ্ছি বিশীর্ণ।
টিপেটিপে গাঁয়ের কতই না দেখেছে মেয়ে করাবে বিয়ে এবার
মজলুম গ্রামের মুহিতের বড় মেয়ে হয়েছে পছন্দ সবার।


দিন-মাস-তারিখ ঠিক হলো সবই সম্মতিক্রমে
নির্ণীত সেই সময়ে পাত্রী ঘরে আসল অনুক্রমে।
সংশয়ে বেঁধেছে বাসা বছর খানেক পার হতে
কুলাভিমান কামিনী অহমিকা গড়ছে নিজ হাতে।


দূরভিসন্ধি আঁকছে ঘরে দুরাধর্ষ সে নারী
গৃহ হতে করবে বিচ্ছেদ মোর জননী কাড়ি।
দুশ্চেদ্য সাহস দেখে সচকিত হয় আমি
নীচ কুলোদ্ভবে জন্মে প্রমাণ করছে নামী।


তাই নিসর্গ আলো বাহিরে ছড়ালেও নিষ্প্রভ মোর মন
চারিদিকে বহিছে নিষাড়া শব্দ নেই স্বস্তির আস্ফালন।
ঢাকঢোল বাজিয়া সাজিল যে ঘর তাহাই হলো আজ ডোবা
ঠুকরে ঠুকরে কাঁদছে মোর জননী কে করিবে তাঁর সেবা।


যেদিন বুঝিতে পারিল এ ধরনীতে আপন আর কেহ নাই
সেদিন ডাকিয়া চুপটি করে বলে, এবার বিদায় নিতে চাই।


হায়! হায়! করে সারা গ্রাম বাড়ি জুড়ে কান্নার ছুটেছে রোল
লক্ষ্মী মা আমার ছেড়েছে, সবকিছু করেছে ভূবন অচল।
কি করে সহিব এমন মৃত্যু থাকিবো কেমন করে
মা ছাড়া যে আপন কেহ মোর নেইতো ধরনী তরে।


এতটুকু ব্যথা দেয়নি কখনো এই জগত জুড়িয়া
আজ কেমন করে নিলো যে ঈশ্বর মোর মাকে কাড়িয়া।
প্রতিফল নিতে চেয়েছিলাম ওই কালনাগিনী হত্যা করে
মা যে আমার করেছে নিষেধ আজো রয়েছি প্রতিজ্ঞেয় ভরে।


দু’মাস পরে হলো জন্ম,  ওরে সোনা মুখখান তোর!
গিয়েছে রে ফেলে পরকীয়ার জোরে নেমে এল গৃহে ঘোর।
জগদ্ধাত্রী রেখেছে ঘিরে দিয়েছে আলো আঁধারেই মাতৃত্ববোধ
চুপসে করে আজো কেঁদে মরি; তোর মায়ের হয়নি বুঝি বোধ!