"মানুষের সুখ দেখে খুশি হত যে মানুষটা,
তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না-"


কোন সে মানুষটা ? পৃথিবীর মানুষটা, সমাজ সংসার দেশের মানুষটা । কোন মানুষের সুখ দেখে খুশি হতো ? পৃথিবীর মানুষের সুখ দেখে। মানুষটি এবং মানুষেরা আছে । তবু তারা হারিয়েছে তাদের মূল মানুষরূপ বৈশিষ্ট্য। হারিয়েছে তাকে দেয়া পবিত্র চরিত্র, আচরণ, মানবিক সদগুণ । নিঃস্বার্থ  মমতা, ভালোবাসা, পরোপকারিতা । তাই এই বর্তমান পৃথিবীতে, কবি সংহিতার চোখে, পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষটি নিঁখোজ আজ। আমি, তুমি, সে, ওরা সবাই নিঁখোজ। আমরা আর অপর মানুষকে ভালোবাসি না, তার সুখ দেখে সুখী হই না, খুশি হই না। আমরা নিজেদের ছাড়া আর কারো দিকে তাকাই না। কবিতাটিকে সহজেই সম্পর্কিত করা যায় পরিবার থেকে পৃথিবী, মানুষে মানুষে সুসম্পর্কের অবক্ষয়ের সাথে ।


কবি সংহিতা দুই পঙক্তিতেই দেখিয়ে দিলেন তার দুর্দান্ত কবি বা কবিত্ব দক্ষতা। তুলে ধরলেন মাত্র দু'লাইনে বিশ্ব মানবতার পরিস্থিতি, তার আজকের স্বরূপ। মানুষ আছে, কিন্তু একে অপরের প্রতি সে ভালোবাসা নির্বাপিত। মানুষ আর মানুষের পাশে দাঁড়ায় না। মানবতা মুখে আউরে চলে, মনে ধারণ আর করে না। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেরটা ভাবে, দরজা জানালা বন্ধ করে রাখে। সংকীর্ণ স্বার্থপর এক ভুবনে আমাদের পৃথিবী আজ পরিবর্তিত, নির্বাসিত।


ছোট প্রেক্ষাপটে বলি । ছোটবেলায় আমরা ধানমন্ডি-লালমাটিয়ায় থাকতাম। সে ছিল এক বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন যেনো। এক বাড়ি আরেক বাড়িকে চেনে না। রাত্রিবেলায় বিপদের ধ্বনি শুনলেও জানালায় কিছুটা উদ্বিগ্ন কান পেতে, যদি বুঝে ঐ বিপদ তার বাড়ির ওপর আছড়ে পড়বে না, ফের বিছানায় চলে যায়। দরজা খুলে প্রতিবেশীর সাহায্যে পাড়ার রাস্তায় বেরিয়ে আসে না। কী দরকার ঝামেলার মধ্যে যাবার, শুয়ে পড়ো! অথচ যখন আমার খালাতো ভাইদের মোহাম্মদপুরে যেতাম, অবাক হয়ে দেখতাম পুরো পাড়া যেনো একটি পরিবার। এ ওর বাড়িতে নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ছে, ও তার জন্য বাজারে দোকানে চলে যাচ্ছে, জানালা থেকে, বারান্দা থেকে দরজায় দাঁড়িয়ে, রাস্তায়, চলছে কুশল বিনিময় আলাপন আড্ডা। উষ্ণ সম্পর্কের এক মধুর পরিবেশ। এমন এলাকা আরো আছে। বিপদে পড়লে, সমস্যায় পড়লে বন্ধু ভাবাপন্ন প্রতিবেশী বন্ধুদের অভাব নেই যেখানে। এই পৃথিবীটা প্রতিবেশী দেশের পর দেশ নিয়ে একটি পৃথিবী, একটি দেশ হবার কথা ছিল। অন্তত যদি ঈশ্বর মানি, তাঁর গ্রন্থগুলোতে তো তাঁর সেই ইচ্ছার কথাই লেখা আছে। পৃথিবীতে মানুষ বসবাসের শুরুতে ছিল না কোনো দেশ বা কাঁটাতারের সীমানা। বড় প্রেক্ষাপটে বলতে পারি, একটি দেশের সুখে অন্য একটি দেশ বা দেশেরা খুশি হয় না। বরং ষড়যন্ত্র করে সুখী দেশটিকে অসুখী করে তুলবার জন্য।


আবার আশ্চর্য হয়ে বলি, মাত্র দুই লাইন ! একটি পরিবার থেকে পুরো বিশ্বের মানুষে মানুষে সম্পর্ক কী অনন্য অভিঘাতে চিত্রিত । এটাই কবিতার মূল মুগ্ধকর শক্তি। কবিতাটি পড়ে প্রথম কয়েক সেকেন্ড ভালো লাগা, সুন্দর মুগ্ধতা শুধু কিন্তু তারপরই প্রবল ধাক্কা খেলো আমার পাঠ মনন, প্রচন্ড ঝাঁপিয়ে পড়লো কবিতার নিগুঢ় ভাব অর্থ আমার পাঠক অস্তিত্বে ! কবি কী লিখেছেন ! এত ঐশ্বর্যময় ! মাত্র দুটি সাধারণ পঙক্তিতে এত বিশালকে ধারণ করেছেন। ভাবলাম দারুণ পাঠ তৃপ্তির সুখে, এই হলো কবিতা জগতের অসামান্য ঐশ্বর্য। কবিরা মানবতা মানবতা বলে কত কবিতা লিখে চলেছেন, বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের । অবশ্যই ভালো হয় অনেক কবিতা, নিঁখুত সৃষ্টি করতে পারেন মানবতাবাদী বোধের, মানবতার হরণে যন্ত্রণার কবিতা। কিন্তু সচরাচর এত স্বল্পে এরকম কবি কলম দক্ষতার, অনন্যতার চমক দেখা যায় না। কোনো কোনো কবির কাছে আসে, কারো কাছে আসেই না। মাত্র দুটি লাইনে এমন সমৃদ্ধ শৈল্পিক কবিতা সৃষ্টি করা। চিন্তা করলাম, কিভাবে এই দুটি অনন্য পঙক্তি কবির মাথায় এলো ? কী করছিলেন তিনি তখন। টিভিতে মানবতাকে খুন করার কোনো সংবাদ দেখছিলেন, বা পত্রিকায় পড়ছিলেন, সে সময়ই কবির মন-প্রান্তরে পাখা মেলে দিলো দুটি বাক্য, নাকি কবির অবচেতনে ক্রিয়া করে চলছিল বেশ কিছুদিন, মানবতার করুণ পরিস্থিতি, মানুষে মানুষে নির্বিকার সম্পর্কের, দূরত্বের হাহাকার, আর এর মাঝেই হঠাৎ খুঁজে পেলেন যোগ্য সমৃদ্ধ সম্পূর্ণ এক রূপকল্প মাত্র দু'লাইনে । কবি বলতে পারবেন। তবে বলতে হয় কবির এই খুব পরিমিত বাক্যে কবিতা লেখার চর্চা বহুকাল ধরেই চলছে। আগেও চমৎকৃত হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি। সুতরাং তার কবিতার অনুভব তিনি এই পরিমিত আকারেই প্রকাশ করতে চাইবেন, যারা তার কবিতার সাথে পরিচিত, তারা জানেন।  


হ্যাঁ, পৃথিবীর জন্য যোগ্য সত্যিকারের মানুষ আজ নিখোঁজ । কিন্তু কবি সংহিতার মতো সমৃদ্ধ কবিরা বর্তমান। তারা ফিরিয়ে আনবে নিখোঁজ মানুষটিকে, ভরাবে নির্মল সুখ খুশিতে পৃথিবীকে, আমাদের মানব জীবনকে, একের পর এক অনন্য কবিতা লিখে। কবিকে অভিনন্দন। সবাইকে ধন্যবাদ।


(১৩.০৯.২০২২)