আজ আমি একটি ছোট্ট গল্প বলব,
একাত্তরের ২৫ মার্চের কথা
থাকবে সেখানে---
আমিও তখন এই গল্পের মতই
খুব ছোট, তরতর করে বেড়ে
উঠছি মাত্র...।
দেশজুড়ে চলছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে
অসহযোগ আন্দোলন...সবার
মধ্যেই বিরাজিত এক অজানা শঙ্কা,
ভয়--কী হয় ! কী হয়!!
কিন্তু,জীবন তো আর থেমে থাকে না,
এর মধ্যেই বয়ে চলেছে নিরবধি...
আমরাও তার ব্যতিক্রম নই।
সমাজের আর দশটা-পাঁচটা ঘর
গেরস্তালির মতো
আমার মায়েরও ছিল পশুপাখি পালবার
বেজায় শখ, সেইসঙ্গে আমারও।
সেদিন বৃহস্পতিবার,দুরন্ত সতীর্থদের
সঙ্গে বিকেলে নিয়মিত খেলাধূলায়
ব্যস্ত আমি মাঠে,
সন্ধ্যায় দিগন্তজুড়ে মোয়াজ্জিনের মধুর
আযান-ধ্বনি কানে আসতেই
অন্য সকল পাখপাখালির মতোই
আমাদেরও তখন ঘরেফেরা ছিল
রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত অভ্যাস।
ঘরে ফিরতেই মায়ের কী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা,
খুঁজে পাচ্ছে না একটি ছাগলছানা…!
আমার হৃদয়ের গভীরেও জেগে
উঠল অজানা এক মায়া হারানো
ছাগলছানাটির জন্য…!
বাড়ি আমাদের কমলাপুর রেল স্টেশনের
সামান্য দূরে…লোকোশেড সংলগ্ন,
সাধারনের প্রথম আবাসন। ঘর থেকে বেরুলেই
চোখে পড়তো বিস্তর এলাকা জুড়ে
ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য
রেলের পাত, নানান যন্ত্রাংশ,পরিত্যক্ত
সব বগি, আর এসবের ফাঁকে ফাঁকে
নিতান্ত অযত্নে স্বাধীনভাবে
গজিয়ে ওঠা সবুজ-শ্যামল দুর্বাঘাস।
দিনভর এসবই মজা করে চিবিয়ে
পেট পুরতো চড়ে বেড়ানো
সমস্ত গবাদি। পশু-ছানার প্রতি অজানা
টান সেদিন সম্ভবত উন্মাদ করে
তুলেছিল আমাকে…।
এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত গভীর,
মা আমার আরেক দুশ্চিন্তায়
মগ্ন…! এবার বাড়ির বড়রা খুঁজতে
নেমেছে আমাকে ! আমি তো বুঁদ হয়ে
ক্ষ্যাপার মতো খুঁজে ফিরছি আমার প্রিয়
সেই ছাগল ছানাটিকে।
খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছি গোপীবাগের
টিটিপাড়া বস্তির কাছাকাছি !
এরমধ্যেই আমাকে পেয়ে যায় আমার
জন্য মায়ের পাঠানো উদ্ধারকারী
হামযা-দল। কিসের ছাগল,
কিসের কী! আমাকে নিয়েই শুরু
হয়ে যায় হই-চই, হল্লা। তখন রাত সাড়ে
১১টা পার…। গা ধোয়া শেষে সবে
খাওয়া-দাওয়া সেরেছি ,আর অবিরাম
চলছে মায়ের বকুনি। আমি তো
কৃতকর্মের ভয়ে জড়সড় !
এরই মধ্যে হঠাৎ শুনতে পাচ্ছি…
ঠা- ঠা- ঠা, দ্রুম-দ্রুম আর ডাক-চিৎকার,
শোরগোল ! মুহূর্তের মধ্যে আমাদের
সারা সবুজবাগ মহল্লা অস্বাভাবিকভাবে
অগ্নিশিখার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল !
বিক্ষিপ্ত সবাই নিজেদের সামাল দেয়ার
চেষ্টায় ব্যস্ত। আমরা পাশেই বন্ধু রবিনদের
ছাদে উঠে দেখি… দাউ দাউ করে জ্বলছে
আগুন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে।
বুঝলাম সেখানে চলছে জোর
প্রতিরোধ যুদ্ধ…। সামান্য অস্ত্র নিয়েই
লড়াই করছে বীর পুলিশ সদস্যরা।
আর হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে
জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে
তখনকার দোচালা টিনের
পুলিশ ব্যারাকগুলো…। তারই
লেলিহান শিখায় আলোকিত হয়ে
গিয়েছিল আশপাশের গোটা
এলাকা। সেই সুবিধায় দেখে দেখে
হানাদারেরা হামলা করতে
লাগল আমাদের প্রতিরোধী বীর
পুলিশ সদস্যদের ওপর…!
বাসায় হাল্কা গুঞ্জন ঠাওর করতেই
এসে দেখি…আমার বাবা এবং পাড়ার
অন্য সবে মিলে ডান হাতে
গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত আহত এক বীর
পুলিশ যোদ্ধার শুশ্রুষা করছেন…।
আমাদের এলাকাটি তখন
নিরাপদ নয় বলে তাঁর বিক্ষত হাতে
কোনও রকমে ব্যান্ডেজ চেপে
তাঁরই ইচ্ছায় বাড়ির পেছনের অন্ধকার
ঝোঁপ দিয়ে অপেক্ষাকৃত সহজে
মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে গ্রামের
আলপথ দেখিয়ে দেন আমার
বাবা…। আর বাইরে তখন চলছিল
বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সমস্ত রাস্তাঘাট
বন্ধ করে দেবার পালা…। (সংক্ষেপিত)
২৫.০৩.১৭