“আমায় কেউ ভুল বুঝবেন না ভাই, ছোট্ট পরিসরে দুটি কথা বলতে চাই। কবি নয়, কথা হবু কবিদের নিয়ে, লেখা শুরু তাই ক্ষমা-ভিক্ষা চেয়ে…।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজকাল অসংখ্য নব্য কবি ও ছড়াকারের উপস্থিতি দৃষ্টিকটূভাবে লক্ষ্যণীয়। বলা যায়, ভাইরাল আকারে ছড়িয়ে পড়েছেন এঁরা ! কেউ কেউ অবশ্য কবি ও কাব্যের এই বিক্ষিপ্ত অবস্থাকে ঠিক ভালভাবে নিতে পারছেন না। তাই তাঁরা রিঅ্যাক্ট করছেন এবং নিজের মতো করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করছেন একই মাধ্যমে।…আবার, “কেউ কেউ বোঝেন না কাব্যের আগা-মাথা,বেহুদা বলছেন বেশি বেশি কথা !”
সম্ভবত এর থেকে পরিত্রাণ পেতে ইদানীং ক্ষেপে উঠেছেন একশ্রেণীর শ্রদ্ধাষ্পদ কবিকূল…। সাহিত্যের প্রতি তাঁদের হৃদয়ের অফুরান টান আমি বুঝি, শ্রদ্ধাও করি তাঁদের সাহিত্য-জ্ঞান ও প্রতিভাকে। কিন্তু গুরুকূল শ্রদ্ধাষ্পদ কবিদেরই তো অমীয় বাণী, “শত ফুল ফুটতে দাও…”। তাহলে এ কথামালা কি বেমালুম ভুলে গেছেন তাঁরা ? যদি অংকুরেই বাধা আসে তাহলে ফুলগুলো ফুটবে কোথায় ? আকাশে ? নিশ্চয়ই না, এ জন্য জমিন দরকার। আর তাই আমি মনে করি, আজকের জমানায় নব্য কবিদের জন্য এই জমিনটাই হচ্ছে ফেসবুকের ওয়াল। এখানে প্রতি মুহূর্তে অবাধে কাব্য-চাষ হচ্ছে, এবং হবেও অবিরাম। কারওই এতে বাদ সাধবার সাধ্য নেই, উচিতও নয়। কারও সৃষ্টি আপনি ভাল মনে করলে পড়বেন এবং লাইক, শেয়ার, কমেন্ট-যা খুশি দেবেন। আর যার ভাল লাগবে না, তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাবেন,ব্যস। অপশন তো আপনার কাছে আছেই। আপনাকে তো জোর করে কেউ বাধ্য করছে না যে “আমার কবিতাখানি পড়িতেই হইবে”! ফেসবুকীয় কাব্য-চর্চার বিষয়টিকে এভাবে নিলেই কিন্তু সমস্ত ল্যাঠা চুকে যায় ! কিন্তু না ,“মুই কি হনু রে…” ভাবের দু’চারজন কবি আছেন,যাঁরা নিজে নিজে “গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল” সেজে পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া বাঁধাবার মতন করে তাঁদের নিজেদের ফেসবুকের ওয়ালে প্রায়ই উটকো মন্তব্য করে যাচ্ছেন ! অথচ একজনের সৃষ্টি বা চিন্তার ফসল, সেটা ভাল-মন্দ যে মানেরই হোক তা নিয়ে অন্য কারও আগ বাড়িয়ে বিরূপ মন্তব্য করা একেবারেই অনুচিত। অশোভনও বটে।
আসলে আকাশের মতো উদার আর অবারিত মাঠ পেয়ে যে যার মতো করে যেভাবে খুশি সেভাবে বল মারছেন,গোল হলে হোক, না হলে না - মানে তাঁরা কিবোর্ডে আঙ্গুল চালাচ্ছেন সমানে। আগেকার দিনে যাঁরা সাদা খাতায় কলম চালাতে কষ্ট পেতেন,তারাও এখন বোধকরি ছড়া বা কবিতা লেখার এ কাজটিতে তেমন ক্লান্তি বোধ করেন না। তাই বাধাহীনভাবে চলছে বাঙালীর অবিরাম কাব্যচর্চা। যেমন-“...চালারে কাদিরা,সোয়া সের পাঁচসিকা। “ কাঁচা বাজারে এভাবে হাঁক দিয়ে সাধারনত শেষ সময়ে সস্তা দরে সবজি-আনাজ বেচে থাকেন ছোট ছোট ছুটা বিক্রেতারা। কবিতার বাজারও যেন এমনি সস্তা আনাজ হয়ে গেছে আজকাল…! অস্বীকার করব না যে এটা অবশ্যই অত্যন্ত দু:খ ও পরিতাপের বিষয় ! তারপরও বলব এরমধ্যেও কোথাও যেন অমূল্য সাহিত্য সৃষ্টির একটি সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে নিতান্তই সংগোপনে। যেমন বলা যায়,“…যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন”।
এ কারণে একান্ত না বলে পারছি না বলেই বলছি যে… ফেসবুকের ওয়ালে এইসব নব্য ছড়াকার ও কবির ছড়া-কবিতা এবং এদের রোজকার উপস্থিতি দেখে আমাদের সিনিয়র কিছু কবি রীতিমত ভড়কে গেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। তা না হলে বিশেষ কয়েকজন সিনিয়র কবিকে প্রায়ই তাদের ওয়ালে নবীনদের (কবি-ছড়াকার) সম্পর্কে অশালীন ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য করতে দেখা যায় কেন, যা কোনওভাবেই তাঁদের কাছে কাম্য নয় ! আবার কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন,যারা আদতে কবিতা বোঝেন কি-না সন্দেহ, তারাও যেহেতু, অমুক ভাইয়ের স্ট্যাটাস-ব্যস্ ভাল-মন্দ না বুঝেই একটি লাইক বা কমেন্ট লিখে দেন… ঐ বিশেষ ভাইকে খুশি করবার জন্য। এতে ঐ ভীত,কথিত কবি ভাইয়ের হিপের মাংস আরও ফুলে-ফেঁপে ওঠে, এমনটাও আদতে ঠিক কাজ নয়। আসলে প্রত্যেককে যার যার মতো করে স্বাধীনভাবে সাহিত্য চর্চা করতে দেয়া উচিত। এখানে প্রকৃতদের ভয়ের তো কিছু নেই। সময়ই সব ঠিক করে দেবে। কালের ভেলায় অসার মাল সব ঠিকই ভেসে যাবে একদিন।
আজ বলতে দ্বিধা নেই , এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কেন? এর জন্য দায়ী কে বা কারা ? তাই সংশ্লিষ্টদের এটা মানতে হবে যে আমাদের সংবাদপত্র বা দৈনিক কাগজগুলো ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া নতুনদের লেখা ছাপিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে না বললেই চলে। বলা যায়, চান্সই দেন না। ফলে সহজে নতুনরা হালের পানি পায় না মগজে তাদের শত প্রতিভা থাকলেও। আসলে এদেশে একশ্রেণীর ‘মেধাবী বুড়ো’ আছেন,যাঁরা মানতেই চান না নতুনদের সৃষ্টি এবং প্রতিভাকে। অথচ নব্যদের মধ্যকার বিরাজমান প্রতিভাকে অস্বীকার করবার কোনও জো নেই । তাই তাঁরা ফেসবুকের খোলা মাঠ পেয়ে হুমরি খেয়ে পড়েছে,পড়ছে এবং সামনে আরও পড়বে। আমি নিশ্চিত যে বড়রা-বুড়োরা যতই বাদ সাধুন না কেন, বুড়োদের চিন্তাপ্রসূত এই অনাকাঙ্খিতদের মধ্য থেকেই দু’চারজন সত্যিকারের কবি-প্রতিভা একদিন বের হয়ে আসবেই। বাংলা সাহিত্যকে নানা ঢংয়ে রাঙ্গিয়ে তুলতে যুগে যুগে দু’চার জনের বেশি কবির কি আদৌ প্রয়োজন আছে ? বড় বলে আজ যাঁদের এত বেশি আস্ফালন,তাঁদের মনে রাখা উচিত….বিশাল প্রাণী ডাইনোসর পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে আরও বহু আগে। অথচ, অতি ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়া আজও টিকে আছে বহাল তবিয়তে।
আমি বিশ্বাস করি, সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি কবিসত্ত্বা বিরাজিত। বলা যায়, কবিসত্ত্বা অনেকটা সুপ্ত এবং অদৃশ্যভাবে আরোপিত একটি বিষয়। সাহিত্যের বিশাল ভুবনে, বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে পুঁথিগত বিশেষ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের বিষয়টি আদতে গৌণ। চাইলেই লেখক বা কবি হওয়া যায় না, বা ইচ্ছে করলেই কবিতা লেখা সম্ভব নয়। বোধকরি, কোনও এক অদৃশ্য শক্তি একজন কবি-মানুষ দ্বারা গল্প-কবিতা লিখিয়ে নেন। সেইসব কবিতা থেকেই কখনও কারও একটি বা একাধিক কবিতা পাঠকপ্রিয় অথবা জনপ্রিয়, এমনকি সময়ে কালজয়ী হয়ে ওঠে।
আগেই বলেছি, কবিতা লেখা বা কবি হয়ে ওঠা শ্রেফ প্রশিক্ষণ অথবা অনুশীলনের বিষয় নয়। এর বাইরেও কবিতা বা ছড়া লেখা এবং ক্রমে কবি হয়ে ওঠার মধ্যে কিছু একটা বিষয় আছে। এই কিছু একটা বিষয়কেই আমি অন্যভাবে বলব আধ্যাত্মিক বা আসমানী-যা সচরাচর সব মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না, অথবা হতে দেখা যায় না। ধরুন, চলনে-বলনে সাধারণ, স্বল্প-শিক্ষিত, হালকা-পাতলা গড়ন, হা-ভাতে টাইপের কোনও এক তরুণ নিমীষে হর হর করে প্রায় প্রতিদিন শ্রুতিমধুর অসাধারণ কবিতা বা ছড়া লিখে ফেলছে ! পক্ষান্তরে, উচ্চ ডিগ্রীধারী ,হৃষ্ট-পুষ্ট ছ’ফুটি ঢাউস ব্যক্তিও ছন্দবদ্ধভাবে মিনিংফুল দুটি লাইন মেলাতে পারছেন না বহু চেষ্টা করেও। তাঁর ঘাম ঝরে যাচ্ছে। কেন ? এই দু’জনের মধ্যে শারিরীক-মানসিক যে তফাত বিরাজমান, একে আপনি কোন্ অভিধায় আখ্যায়িত করবেন ? একান্ত সাটামাটা ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় প্রথম জনের মধ্যে যে বিষয়টি বিদ্যমান-সেটিই একজনের মধ্যে বিরাজিত কাব্য-প্রতিভা !
কথায় আছে,বাঙালি মাত্রই কবি। শুনেছি,বয়েস চৌদ্দ পেরোলেই নাকি দু-চার লাইন কবিতা-ছড়া লেখেনি অথবা লিখতে চেষ্টা করেনি, এমন কিশোর –কিশোরীর সংখ্যা এ দেশে হাতে গোণা সম্ভব।
আসলে হৃদয়ের সুকুমার ভাব আর শব্দের মধ্যে সুন্দর মিতালি গড়ে তোলা এবং ভাব ও শব্দের মিশেলের অপরূপ খেলায় যিনি যত বেশি পারদর্শী, কবিতার প্রথাগত ছন্দ আর প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে থেকে কাব্যচিন্তা এবং শব্দের নাচন, গাঁথুনি বা মেলবন্ধনে যিনি যতটা দক্ষ,ক্রমে একটা সময় আসে যখন তিনিই লিখতে লিখতে হয়ে ওঠেন কবি।
জোর করে যেমন কবি হওয়া যায় না,তেমনি কারও মধ্যে সত্যিকারের প্রতিভা বা কবিত্ব থাকলে, ফেসবুকে অশালীন কিছু কথা লিখে বা অপপ্রচার চালিয়ে তৃতীয় পক্ষ যতই অনাকাঙ্খিত শব্দ চয়ন করে তাঁর কাব্য-জ্ঞানের ভান্ডার উন্মোচিত করুন না কেন, কোনও শক্তিই একজন হবু কবির প্রতিভাকে কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। এ আমি নিশ্চিত। আর এও নিশ্চিত যে ফেসবুকের পাতাকে আকাশের মতো উদার, উন্মুক্ত উর্বরভূমি হিসেবে পেয়ে হয়ত কাব্য-সাহিত্য সম্পর্কে অবুঝ-অর্বাচীনেরা সেখানে যতই দৌড়-ঝাঁপ করুন না কেন, তাঁদের ভেতরে বাস্তবিক কাব্য-প্রতিভা না থাকলে একদিন ক্লান্ত হয়ে তারা নিজেরাই পা পিছলে পড়বেন। তাই প্রকৃত এবং স্বীকৃত কবিদের এসবে ভয়ের কিছু নেই- যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ,আমাদের মধ্যকার সম্মানীয় কেউ কেউ কিছুটা ভড়কে গেছেন। তাই নিজেদের অজান্তেই ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁরা নব্য বা হবু কবিদের পিছু নিয়েছেন। আমি তাঁদের অভয় দিয়ে এটুকু বলতে পারি...“দাঁড়াও পথিক বর, তিষ্ঠ ক্ষণকাল”। হা হা হা ....। তাই ভয়ের কিছু নেই, সাহিত্যাঙ্গনে হঠাৎ বেড়ে ওঠা বাড়তি সব মেদ মহাকালের ব্যবধানে একদিন এমনিতেই ঝরে পড়বে। জানি, কবি হওয়া অত সহজ নয়, যতো সহজ যেনতেন প্রকারেণ দু’চার লাইন লিখে ফেলা ! একজন কবিরই সগৌরব উচ্চারণ… “সবাই কবি নন,কেউ কেউ কবি…।” তাই যারা প্রকৃতই কবি, তারা কালের বিচারে টিকে যাবেন ঠিকই-আর যারা তা নন, এমনিতেই ঝরে যাবেন...এজন্য কাউকে অযথা কিছু বলতে বা কষ্ট করে ঘাম ঝরাতে হবে না।নিতান্তই শখের বশে ইদানীংকালে অনেকেই দু-চার লাইন লিখতে চেষ্টা করছেন বটে,কিন্তু আমি তো তাতে ক্ষতির কিছু দেখছি না ! আর এতে প্রকৃত কবিদের রুষ্ট হওয়ারই বা কী আছে ,তাও ভেবে পাই না… ?
পরিশেষে বাংলা ভাষা ও কাব্য-সাহিত্যের কীর্তিমান এবং প্রাত:স্মরণীয় সমস্ত কবিকুলের প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা রেখে ফের বলছি, আমার বক্তব্য যদি কারও কাছে ধৃষ্টতা মনে হয় তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দু:খিত…!