‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ বইতে বাংলা শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে বলা হয়েছে, কালে কালে বাংলা ভাষা নানা ভাষার সংস্পর্শে এসেছে। যে-সব ভাষার শব্দকে গ্রহণ করে এ ভাষা ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়েছে। এর শব্দভাণ্ডারও বেড়েছে। এদেশে মুসলিম শাসনামলে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। পরে ইংরেজ শাসনামলে এ ভাষায় গৃহীত হয়েছে অনেক ইংরেজি শব্দ। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার কিছু কিছু শব্দ স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। বাংলা কবিতায় অনুবাদের সূত্রে সংস্কৃতের ঋণ প্রথম থেকেই বিপুল ছিল, পরে উনিশ শতকের গদ্যে তা আরও প্রবল হয়। এছাড়া নানা ভাষা থেকে নানা সূত্রে কিছু কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশাধিকার পেয়েছে। বর্তমানে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার সূত্রে এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে অনেক নতুন নতুন শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে। এর ফলে ভাব প্রকাশের ক্ষমতা ক্রমেই বাড়ছে এবং তা অধিকতর সমৃদ্ধ হচ্ছে।


অর্থপূর্ণ ধ্বনি সমষ্টিই হলো শব্দ। ভাষার ক্ষুদ্রতম অংশ হলো ধ্বনি যা মুখের মাধ্যমে প্রকাশিত অর্থবহ আওয়াজ। এই অর্থবহ আওয়াজের লিখিতরূপ হলো বর্ণ। আর এই বর্ণ পর পর সাজিয়ে অর্থবহ করে শব্দের লিখিত রূপ দেয়া হয়। সুতরাং, এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থপূর্ণ মিলনই শব্দ।


শব্দ আমাদের অতীতের কথা শোনায়। একদিন যা ছিল মানুষের মনে তা মুখে উচ্চারিত হয়ে শব্দরূপে ধরা দেয়। এক একটি নির্দিষ্ট সমাজ বলতে পারে কোন শব্দের কী মানে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন অভিজ্ঞতালব্ধ মৌলিক শব্দ, প্রত্যয়, উপসর্গ যোগে এবং সমাসের সাহায্যে নতুন নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরি করে যাচ্ছে। এক সময় যে শব্দ ছিল সবচেয় জনপ্রিয় কালের বিবর্তনে সে শব্দ হয়তো চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। আবার নতুন শব্দ কবি, সাহিত্যিক, গবেষকদের কল্যাণে নবরূপ লাভ করেছে। এভাবেই গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেদিয়ে লক্ষাধিক শব্দ বাংলা ভাষার অভিধানে স্থান করে নিয়েছে। শব্দই ভাষাকে গতিময় করে।


যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত উন্নত সেই ভাষা তত সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার অভিধানে সঞ্চিত শব্দই শব্দভাণ্ডার বা শব্দসম্ভার, এসব শব্দ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে, মুখে ব্যবহার করে বা লিখে মনের ভাব প্রকাশ করে। বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে আমাদের উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া শব্দ। যেগুলো অনেকটা পুরোনো শব্দ। ঋণকরা শব্দ এবং বিভিন্ন নিয়মের মাধ্যমে তৈরিকৃত শব্দ।


সাহিত্যিক বা কবিরা তাদের নিজস্ব ভাষাশৈলীতে বর্তমানকে ইতিহাস করেন আর অতীতকে বর্তমানের মানসপটে আঁকেন। সময়ের পূর্বাপর সম্পর্ককে উপস্থাপন করেন পাঠকের হৃদয়ে। ইতিহাস থেকে ছেঁকে নেন রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতিবোধ, নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস আর নিমগ্ন থাকেন মানুষের সন্ধানে। ভৌগোলিক সীমারেখা ধরে বর্তমান সময়কে শিল্পতুল্য করে তোলেন সাহিত্যে। এভাবেই কবি বা সাহিত্যিকেরা কবিতা বা সাহিত্যে জীবন ও প্রকৃতির শৈল্পিক শব্দসম্ভার ছড়িয়ে দেন, তৈরি করেন কাব্যময়তা বা শিল্পতুল্য সাহিত্য।


অনেকে বলে থাকেন ভাষা বা সাহিত্য বা কবিতা শেখার ক্ষেত্রে ধর্ম ও নৈতিকতা কোন অনুষঙ্গই না। কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ, ভাষা ও ধর্ম পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। মানুষের বিশ্বাস ও ধর্মচিন্তা ভাষার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়। ফলে ধর্ম বিশ্বাস প্রকাশ ও চর্চা করার মধ্য দিয়েও ভাষার বিকাশ ঘটেছে এবং ঘটে থাকে। কাজেই ভাষার গতরে ধর্মের নিদর্শন থাকে এবং তাকে চিহ্নিত করা ও বর্তমান কালে তার তাৎপর্য উদঘাটন করা নৃতত্ত্ব, দর্শন, ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূরণ একটি ক্ষেত্র।


আমরা যখন রবীন্দ্রনাথ পড়তে যাই, দেখতে পাই
“আমার এই দেহ খানি তুলে ধরো
তোমার ঐ দেবালয়ের প্রদীপ করো”
এক্ষেত্রে ‘দেবালয়’ ধর্মীয় শব্দ নাকি নয় সেই তর্ক অনর্থক। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য ঔপনিবেশিক যুগে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হাতে বিকশিত হয়েছে ফলে সেই ভাষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিন্দুর ধর্মীয় অনুষঙ্গ, প্রতীক, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা গলাগলি করে জড়িয়ে রয়েছে। এখন কেউ যদি বাংলা সাহিত্য পড়াতে গিয়ে বলে এটা ধর্মীয় কিছু না, নিছকই সাহিত্য তার যেমন কোন যুক্তি নেই, তেমনি কোন বাঙালি ধর্মসূত্রে মুসলমান বলে হিন্দু সাহিত্যিকের লেখা পড়া বাদ দেবে বা তার সাহিত্যগুণের প্রসাদ নেবে না, তাও যুক্তিগ্রাহ্য নয়।


‘অঞ্জলী’ শব্দটির কথাই ধরুণ, এর অর্থ হচ্ছে দুই হাত জোড় করে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা ফুল, অর্থাৎ, সোজা কথায় পূজা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গীত’ দিয়ে সেই পূজা করতে চান বলে তাঁর গানের বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘গীতাঞ্জলী’, অর্থাৎ গানের অর্ঘ্য নিবেদন বা গান দিয়ে দেবতার পূজা। এখানে পূজার অনুষঙ্গ আছে বলে কি বাঙালি মুসলমান এই বই পড়বে না? এই গান গাইবে না? অবশ্যই পড়তে হবে, গাইতে হবে। তেমনি, ‘কবিতা আমার সাধনা’, এই সাধনা বোঝাতে কোন বাঙালি মুসলমান কবি যদি লেখেন ‘কবিতা আমার এবাদত’, কিংবা ‘দিক’ বা ‘লক্ষ্য’ বোঝাতে যদি লেখেন ‘কেবলা’ তখন ‘এবাদত’ বা ‘কেবলা’ মুসলমানের শব্দ হলেও সেটা বাংলা ভাষার শব্দ, সকল বাঙালির শব্দ। তাহলে ধর্ম ও সাহিত্য পরস্পর থেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন - এই অনুমানের কি কোন ভিত্তি থাকে?


যদি বলা হয় বাংলা সাহিত্য বা কবিতা লিখতে বা পড়তে বা পড়াতে গিয়ে ‘এবাদত’ বা ‘কেবলা’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, তাহলেতো সমস্যা বাড়তেই থাকবে। কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপলব্ধি, ভাষা ও চর্চাকে সাহিত্যে স্থান না দেবার চেষ্টা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার যদি কেউ বলেন ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় ধর্ম থাকবে না সেটা আজগবি ও অবাস্তব শুধু নয়, সেটা নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে বাংলা ভাষাকে বন্ধ্যা করার কৌশল ও প্রয়াস হিসাবে বিবেচিত হবে।


বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে যদি বলা হয় ‘আল্লাহ’ আরবি শব্দ, এটা বাংলা ভাষায় চলবে না, ‘আল্লাহ’ শব্দটিকে ‘ঈশ্বর’ বলেই পড়তে ও শিখতে হবে। তখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? ভাষা সংশ্লিষ্ট জনগন বা জনগোষ্ঠী বা গণমানুষের ধর্মীয় ও আত্মিক উপলব্ধি, ধর্ম চর্চায় নিত্যদিনের শব্দ প্রত্যক্ষভাবে কিংবা উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক ও প্রত্যয় হিসাবে ভাষাতে আসবেই। এক্ষেত্রে ধর্ম, ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে নিগূঢ় ও অঙ্গাঅঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে।


যেমন ধরুণ, বাংলাভাষায় সংস্কৃত থেকে আসা ‘ঈশ্বর’ একটি ধর্মীয় শব্দ। একে বাংলা ভাষা থেকে বাদ দিবেন কিভাবে? কিংবা ‘ভজন’ বা ‘আরাধনা’ শব্দদ্বয় প্রার্থনা অর্থে ব্যবহৃত হয় একেওবা বাদ দিবেন কিভাবে? কারণ এটা এখন বাঙালি হিসাবে বাংলাভাষী সকলের ভাষা, এতে বাংলাভাষী সকলের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাভাষাভাষীর সকল ধরণের শব্দই, সেটা যে কোন ধর্মীয় শব্দ হোক বা অন্য কোন শব্দই হোক, তা আধুনিক বাংলা ভাষার সম্পদ ও সম্পত্তি। এ শব্দসম্ভারের মধ্যে বিপুল ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও সেটা বাঙালির শব্দ। সুতরাং, ভাষা ও সাহিত্য বা কবিতার সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই, এটা এক ধরণের আহাম্মকি ও রাজনৈতিক দাবি। ঐতিহাসিক কারণ ও বিভিন্ন বাস্তব প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বা কবিতায় ধর্মের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ এসেছে। এই অনিবার্যতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ধর্মের সম্মন্ধ ও অনুষঙ্গ দোষের কিছু নয়, এটা অতিক্রম করে যাওয়া ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির কাজ। আমরা যদি একে অপরকে শ্রদ্ধা করি এবং বাংলা ভাষায় সকলের উপস্থিতির অনিবার্যতা মানি ও তা রক্ষা করি তাহলে সেটা বাংলা ভাষার জন্য সম্মৃদ্ধি বয়ে আনবে এবং তা ভাষাকে অধিক উন্নততর করতে সহায়ক হবে।


তাই আসুন আমরা এই প্রচেষ্টা শুরু করি যাতে, ভাষা শিক্ষা বলেন আর কবিতা বা সাহিত্যের অন্যান্য ধারার চর্চার কথাই বলেন সকল ক্ষেত্রেই মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, সাঁওতাল, মনিপুরিসহ সকল ধর্ম জাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে যেন একটি উপলব্ধি ও চেতনা সুদৃঢ় হয় যে আমরা সকলেই একই সমাজ ও একই ইতিহাসের অন্তর্গত। সেই ইতিহাসের ভালমন্দ দ্বন্দ্বসঙ্ঘাত আছে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র আছে, সেটা যেন অনৈক্য ও বিরোধের ক্ষেত্র হয়ে না ওঠে।