গতকাল বিকেলে বিস্মৃত কিছু স্মৃতিকে- আমারই কুটিরে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে-  প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে বাইরে বেরুই; স্বপ্নে । সুকান্তের মত শীতের সূর্য আমাকে স্বাগত জানালো মহতী পদক্ষেপের প্রারম্ভে; স্বপ্নে । কবি আর কবিতার কত কাছাকাছি বসবাস । সেকথা ভাবতে ভাবতে হটাত দেখি পশ্চিমাকাশ কবিতার ঝংকারে হাত বাড়িয়ে আমাকে দিল ছেলেবেলার একটুকরো আকাশ । চাপা উল্লাস বুকে নিয়ে হাঁটতে থাকি গ্রামের রাস্তা ধরে, নির্জনতাকে সঙ্গী করে । অদূরে দূরে কতগুলো ছেলে প্রাণ খুলে গান গেয়ে চলে- বেসুরো সুরে । পরক্ষনে বুঝি অপার্থিব ছন্দের মোহময়তায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের তাল-লয়ে তলিয়ে যাচ্ছে একটি শিশু; যেভাবে সোনালি ধানের দোলায় সব ভুলে যায় ভূমিহীন চাষি; যেভাবে নৌকার মাঝি দোল খেতে খেতে বাকের ওপাড়ে হারিয়ে যায় রুপালি স্বপ্নে । অবশেষে সত্যেন্দ্রনাথ ভুলে যাওয়া কিছু বাতাসের স্বাদ, আর বর্ণে গন্ধে বিভোর বাংলা বইয়ের বুকে ছন্দ তুলে বিদেয় নিলেন দূরে- পরিচিত এক আল ধরে, স্বপ্নে । নির্জনতার হাত ধরে খানিক ঘুরে ফিরে ধানক্ষেতে চেয়ে দেখি এক বিষণ্ণ শালিক একা একা হেঁটে চলে সন্ধ্যা আঁধারে- জীবনানন্দের মত করে । তাই দেখে কোন অচিন পাখি গান গেয়ে উঠে আর্তস্বরে । নির্জনতার চোখের আড়ালে বুকের পাজরে-গভীরে-অতলে বেঁচে থাকার স্বাদ কারে বলে – সে’কথা ধু ধু প্রান্তরে অবেলায় এসে জীবনানন্দ কবিতার ভাষায় অনর্গল বলে গেলেন বিষণ্ণ কণ্ঠে, চুপিসারে । যেন শ্মশানের ঘাটে মৃত স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে কোন এক কিশোরের সারারাত কাটে অন্ধকারে, তবু জেগে উঠে ভোরে । অবাক চোখে দেখি জীবনানন্দ বোধের বোতলে ভরে আমার হাতে আধার রাতের প্রাণ দিয়ে যান, জীবনকে ভালোবেসে – আনন্দাশ্রুর অর্থ বুঝিয়ে মুচকি হেসে-; স্বপ্নে । চেয়ে দেখি দূরে গোধূলি আলো ঝলমল করে, বিপরীতে থেকেও চাঁদ সূর্যের প্রণয়-মিলনে । সন্ধ্যার খানিক পরে নির্জনতার নতুন কিছু বন্ধুর সাথে পরিচিত হলাম আধারের ঐশ্বর্যে । রবি নেই তবু হটাত দেখি রবিঠাকুর চাঁদের কাঁধে চড়ে স্নিগ্ধ আলো জ্বালিয়ে বিস্মৃতি খুঁজে খুঁজে আমার দিকে এগিয়ে এলেন । জোছনার বুকে যত সুখ ব্যাথা থাকে সব কবিতা হয়ে আছড়ে পড়ে- আবেগে বোধে আমারই দুচোখে । যেন প্রেমের জোনাক জ্বেলে কোন তরুণ ছেলে মহাকালের পথে পথে স্বপ্ন খুঁজে ফিরে । আমার চিন্তাকে রবি ঠাকুর সুনিপুণ হাতে শিল্প বানিয়ে মহাকালে উড়ে উড়ে ঘুরে দেখতে বলে তিনিও ঘুরতে গেলেন । আমি আধারি আলোকে স্নিগ্ধ দুচোখে কিশোর প্রেমের সেই সত্তাকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে বুকের বাম পকেটে তুলে রাখি । আমি সেই মোহে হাঁটতে থাকি, বিস্মৃত ধুলো মাখতে থাকি । হটাত দেখি শীতের রাতের হিমহিম ঝড়ে – মেঘের চাদরে পাঞ্জাবি পড়ে কবি নজরুল কালবোশেখি ঝড়ের বেগে আমার বুকের ভিতরে মুক্তির স্রোত ঢুকিয়ে দিলেন । রবি ঠাকুরকে পেছনে রেখে আমি তখন বেশ সম্মুখে । কবি নজরুল এগিয়ে এসে নির্জনতার কাছ থেকে আমাকে কেড়ে মানুষের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন । শীতের ঝরা পাতার মতই নির্জনতা আর তার বন্ধুরা ঝরে পড়ছিল একে একে; আমি মানুষের ঝাঁকে দেখি একঝাক কবিতা বিপ্লবী সুরে জীবনের কথা বলে । যেন কোন এক কালে কোন এক ছেলে মৃত্যুকে পদতলে রেখে সব ভুলে হারায় মুক্তির মিছিলে । নজরুল তার ছেলেবেলার কথা বলার ফাকে সেই ছেলেকে আমার সত্ত্বার সাথে জুরে দিলেন । কালবোশেখি ঝড়ে, মহা প্লাবনে, মৃত্যুর সম্মুখে মুক্তির বাসনা এঁকে নেয়া চোখে- মানুষের ভিড়ে হারিয়ে ফেলি কবিকে । দেখি আমি নির্জনতাকে বুকে রেখে বিস্মৃত স্মৃতি কুড়াই অগণিত মানুষের চোখে; স্বপ্নে ।
          তখনি হটাত ঘুম থেকে জাগি; ভাবতে থাকি বিস্মৃতির জন্ম প্রাপ্তিতে ফিরে যাব না কভু প্রথাগত ঘরে । আকাশ-পাতালের মত বিশালতার   সম্মুখে না’জানি কত শত স্মৃতি ডুকরে কাঁদে । তারই শশ্রুশা আমাকেই তো এখন করতে হবে; বাস্তবে ।