বাংলা সাহিত্যে প্রথম দিককার  রহস্যগল্পের লেখকরা রহস্যের কুয়াশার মতই হারিয়ে যেতে বসেছেন। আজকের প্রজন্ম শুধু ফেলুদার লেখক সত্যজিত রায় আর বড়জোর ব্যোমকেশের আর কিরীটীর  নাম জানেন। কিন্তু ব্যোমকেশের বা কিরীটীর  লেখক কে আমার মনে হয় অনেকেই জানেন না। প্রথম দিককার কিছু রহস্যগল্প আমি পড়েছি । কিন্তু বর্ণনার ঘনঘটায় কিছুটা বিরক্তিরই উদ্রেক হয়েছে।আমার কাছে  ঠিক জমে উঠেনি গল্পগুলো । বেশীরভাগই আবার পশ্চিম থেকে ধার করা মনে হয়েছে। কিন্তু একজনের লেখা পড়তে গিয়ে খুব সাবলীল মনে হয়েছে। যদিও শারলক হোমসের নাম তার রহস্যগল্পতে আছে  কিন্তু কোন কাহিনিই নকল মনে হয়নি। অত্যন্ত সুন্দরভাবে লিখেছেন। একবার পড়তে শুরু করলে না শেষ করে উঠা যায়না ।উঠতেও পারিনি আমি।  সত্যজিত রায় তাঁকে খুবই উঁচুমানের লেখক মনে করতেন। তার রহস্যগল্প “ চিড়িয়াখানা” নিয়ে সিনেমাও বানিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়। প্রতিভাবান  অঞ্জন দত্ত সেই একই কাহিনী নিয়ে কিছুদিন আগে সিনেমা বানিয়েছেন। যথারীতি হিটও হয়েছে। আমার মনে হয়  বাংলা  গোয়েন্দাসাহিত্যকে হাঁটতে শিখিয়েছেন শরদিন্দু আর দৌড়াতে শিখিয়েছেন সত্যজিত রায়।


শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৯ সালে উত্তর প্রদেশে তার মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন উকিল। শরদিন্দুও উকালতি পাশ করে বাবার সাথে কাজ শুরু করেন। কিন্তু রক্তে যার লেখার নেশা সে কিভাবে উকালতি করবে? একসময় উকালতি ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। নামও করেছিলেন তিনি। বেশ কিছু পুরষ্কারও পেয়েছেন শরদিন্দু। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা তার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারিনি। তাঁর থেকে অনেক নিম্নমানের লেখক   অনেক  বেশী পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর কারণ কি আমি জানিনা। যারা তাঁকে মূল্যায়ন করেননি তারা ভাল বলতে পারবেন!


ছাত্র থাকা অবস্থাতেই শরদিন্দু লেখা শুরু করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই প্রথম বই বের হয়। সেটি ছিল ২২ টি কবিতার সংকলন । নাম যৌবন স্মৃতি । পড়াশোনা আর লেখালেখি একসাথে চলতে থাকে। ছাত্র অবস্থায় বেশী লিখতেন কবিতা আর ছোটগল্প । ব্যোমকেশ কাহিনি প্রথম লেখেন ১৯৩২ সালে। আমার ভাবতে অবাক লাগে প্রায় ১০০ বছর আগে লেখা সেসব কাহিনী। কিন্তু  যখন পড়ি তখন মনেই হয়না অনেক আগের ঘটনা । আমার কাছে মনে হয় বর্তমানেই চোখের সামনেই সেটা ঘটছে । বড় বড় মানুষেরা তাদের সময়ের থেকে বোধহয়  অনেক বেশী এগিয়ে থাকেন। সেটা তখনকার প্রজন্ম অনেকেই বুঝতে পারেন না। অনেক অনেক পরে  তাঁদের মূল্যায়ন হয়। কখনো আবার হয়না। কেউ কেউ হারিয়েও যান ।


শরদিন্দু ১৯৩৮ সালে মুম্বাইতে চলে যান । সিনেমায় কাজ শুরু করেন। না ,নায়ক হিসেবে নয়। উইকিপিডিয়া তে শরদিন্দুর ছবি আমি দেখেছি। শার্পই মনে হয়েছে।নায়কও হয়ত হতে পারতেন। কিন্তু শরদিন্দুর ঝোঁক ছিল লেখার প্রতি।  মুম্বাই সিনেমার চিত্রনাট্য তিনি লিখতেন। বেশ কিছু হিট সিনেমার চিত্রনাট্যও শরদিন্দু  লিখেছেন। ১৪ বছর সেখানে ছিলেন। সে সময়ের স্মৃতিকথাও আমি পড়েছি । এত সুন্দর করে গুছিয়ে  চমৎকারভাবে যে  লেখা সম্ভব  সেই লেখা না পড়লে বিশ্বাস করাই কঠিন।


শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে ভালবাসতেন । আমার সব পড়া হয়নি। গৌড় মল্লার, তুঙ্গভদ্রার তীরে , তুমি সন্ধ্যার মেঘ, কালের মন্দিরা ইত্যাদি তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস । তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরষ্কার পান। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে তাঁর সদর্প  বিচরণ ছিল । তার মধ্যে আছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কিশোর সাহিত্য, অনুবাদ।শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর  কিছু অনুবাদ এত চমৎকার ছিল যে অন্যরা সেটাকে শরদিন্দুর মৌলিক লেখাই মনে করতেন।


১৯৫২ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তেষট্টিটি মৌলিক গ্রন্থ লিখেছেন। আরও অনেক লেখা লিখেছেন। বেশ কিছু হারিয়েও গেছে। তবে এখন  বাজারে গল্পসংগ্রহ পাওয়া যায় ।ব্যোমকেশ সমগ্রও পাওয়া যায় ।  যে কেউ পড়লেই তিনি যে কত বড়মাপের লেখক ছিলেন বুঝতে পারবেন। এই বিরল প্রতিভাবান মানুষটি ১৯৭০ সালে পরলোক গমন করেন। বাংলা রহস্যগল্পের আলোচনা যখনই কেউ করুক যেখানেই করুক তার নাম অনিবার্য ভাবেই চলে আসবে। আসতেই হবে। নাহলে যে আলোচনা অপূর্ণই থেকে যাবে!