আলোচনা  ১৮১


কবিতাটি কথ্য ভাষায় লিখা কিন্তু বেশ গভীর এর সত্যকে উন্মোচন করেছেন। সমাজে বিদ্যমান ধ্যান ধারনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। খুব অল্প কথায়, কয়েকটি শব্দের মধ্যেই সমাজের বৈষম্য, ধর্মান্ধতা, সুশাষনের অভাব এবং প্রচলিত সামাজিক ব্যাধিকে নির্দেশ করেছেন।


জাউড়া (জারজ), প্যাট (ক্ষুধাকে ইঙ্গিত), দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছি ( কোথায় মানবতা?) এবং কারে বিচার দিমু (বিচারহীনতার রাষ্ট্র ব্যবস্থা), সেইতো খায় চুমু (সুযোগের অভাবে সবাই সৎ কিনুত সুযোগ এলে বোঝা যায় নৈতিকতার জোড় কতখানি)


এবার ব্যাখা করা যাক-


সকল সন্তানই কোন না কোন নারী ও পুরুষের যৌন মিলনে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর সমন্বয়েই গঠিত হয়, তথাপি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কোন কোন সন্তানকে “জারজ সন্তান” বলে আখ্যায়িত করে, কবি এখানে কথ্য ভাষায় “জাউড়া” বলেছেন। উক্ত সন্তনের মায়ের মাতৃত্বকে পদদলিত করে প্রতিনিয়ত। মুলত ‘জারজ’ শব্দটির বুৎপত্তি ‘জ্যার’  থেকে। ‘জ্যার’ অর্থ গুপ্ত প্রণয়ী। এই প্রনয়ের সংসর্গে যে সন্তানের জন্ম অর্থাৎ জাত যে জাতক-জাতিকা তাকেই অভিধানে ‘জারজ’ বলে থাকে। বস্তুত জারজ শব্দটির যে ব্যাঞ্জনা তা এই শব্দের আভিধানিক তাৎপর্যের সঙ্গে মেলে না। কেননা ‘জার’ এর সংসর্গ ছাড়াও ধর্ষণ জাত সন্তান এবং যৌনকর্মীর সন্তানদের ও জারজ সন্তান হিসেবেই চিনহিত করা হয়। কাজেই শব্দটি ক্রমশ এর মূল অর্থ থেকে সরে এসেছে, এক কথায় এর তাৎপর্য দাঁড়িয়েছে এ রকম- স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষ বা অজ্ঞাত পিতার মিলনে নারী যে সন্তান ধারন ও প্রসব করে সে-ই জারজ সন্তান।


নারীর মাতৃত্বকে নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নানা ধরনের সামাজিক পদ্ধতি চালু রেখেছে। পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান- ধারনার ক্ষতি বৃদ্ধি হিসাব কষেই সামাজিক নিয়মের বৃদ্ধি বা বিনাশ ঘটে। পতিতা, বিরঙ্গনা, নর্তকী ইত্যাদি বিশেষণ নারীর মাতৃত্বকে মূলত ধর্ষণের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে তাদের মাতৃত্বকে সমাজ সব সময়য়ই অস্বীকার করে এসেছে। মূলত ধর্ষণ নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে, বিভ্রান্তির সুযোগে, বেহুঁশ বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়, ভয় দেখিয়ে বা সহবাসে বাধ্য বা প্রবৃত্ত করা কিংবা নাবালিকা নারী মাত্রই সম্মত হলেও তার সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হওয়া। এ অর্থে কোন কোন স্ত্রী প্রতি সঙ্গমেই স্বামী কর্তৃক ধর্ষিতা হন এবং জন্ম দেন ধর্ষণজাত সন্তানের।  কিন্তু  পিতৃতন্ত্র সঙ্গমে স্বামীর যৌন লাম্পট্যের/যৌন আগ্রাসনের প্রতি যথার্থই  উদার। বিয়ের মাধ্যমে নারীর দেহ মনের সম্পূর্ণ দখলদারিত্ব চলে যায় স্বামীর নিয়ন্ত্রনে। তিনিই স্ত্রীর একচ্ছত্র রক্ষাকর্তা এবং বয়নকর্তা। পিতৃতন্ত্র লালিত প্রতিটি ধর্ম ও স্বামীকে দান করেছে যেমন খুশি স্ত্রী ভোগের লিখিত সনদ অর্থাৎ চাহিদা মাত্র দেহদানকে বলে হয়েছে স্ত্রী ধর্ম। যখন খুশি স্ত্রী গমন কিংবা শস্যক্ষেত্র রূপে নারীতে উপগত হওয়ার বিধান বিভিন্ন ধর্মের যৌন সংস্কারে অন্তর্ভুক্ত। স্বামী কর্তৃক ধর্ষিতা স্ত্রীর সন্তানের মাতৃত্বকে সমাজ স্বীকার করে (যদিও তা যৌনকর্মীর সন্তানের মতোই জারজ সন্তান বলে আখ্যা দেয়া উচিত) কেননা সাধারন অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টির অগোচরে থাকে সে ধর্ষণের দৃশ্য/ কাহিনী।  ফলে সে ধরনের ধর্ষিতা নারীর মাতৃত্বের জন্য নিরাপদ মাতৃত্বের কিছু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে বৈকি।  কিন্তু অন্য সকল ধরনের সমাজ অস্বীকৃত সন্তান প্রসবের জন্য ও নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য কোন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা নাই বরং লোকচক্ষুর আড়ালে,সমাজচক্ষুর অন্তরালে যেন তেন ভাবেই নারীর মাতৃত্ব প্রক্রিয়ার কর্মটি সম্পাদন করা হয়।


আলোচ্য কবিতায় কবি, দেখিয়েছেন, কোন সন্তানের গাঁয়ে যখন “জাউড়া” বা  “জারজ” তকমা লেগে যায় তখন সমাজে তার বেঁচে থাকা কতটা অমানবিক হয়ে ওঠে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে ব্যবস্থা কেউই তার জন্মগত মানবাধিকারগুলো নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসে না। ক্ষুধা নিবারন করার জন্য খাদ্য প্রতিটি মানুষের জন্মগত মানবাধিকার অথচ শুধুমাত্র “জাউড়া” তকমার কারনে তার সেই মানবাধিকারও লঙ্ঘিত হয় পদে পদে, রাষ্ট্র এখানে বির্বিকার ভূমিকা পালন করে।


প্রথমত, কোন সন্তানকে “জাউড়া” তকমা দেয়াই একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন তার পর আবার সেই তকমার কারনে তার উপর চলে উপর্যুপুরী নির্যাতন।


কবি, ক্ষুধা’কে চিত্রায়ন করেছেন মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন হিসেবে, সেই ক্ষুধা আবার সাধারন কোন মানুষ নয়, সাধারন কোন সন্তান নয়, এক “জাউড়া” সন্তনের ক্ষুধা। ক্ষুধার যন্ত্রনায়, জাউড়া সন্তান এখানে সেখানে ঘোরে, কোথাও খাবার নিশ্চিয়তা পায় না, উপরন্ত সবাই তাকে আবারো ভোগের সামগ্রি হিসেবেই ভাবে। সমাজ, একবার তার মা’কে অপবাদ দিয়ে তাকে “জাউড়া” তকমা দিয়েছে, এখন আবার তাকেই ভোগের সামগ্রি বানিয়েছে। যারা এই “জাউড়া” প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তাদের আমরা সবাই চিনি, আমাদেরই পরিবারের কেউ না কেউ, ফলে আমরা সকলেই এর দায় এড়াতে পারি না।


কবি নির্মম সত্যকে খুব অল্প কথায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন-


জাউড়া প্যাট নিয়া কারে
বিচার আমি দিমু,
বিচার আমি দেই যাহারে
সেইতো খায় চুমু।


সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে, বিচারহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক চূড়ান্ত উদাহরন। একজন সাধারন মানুষ, কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোথায় বিচার দিবে? কোথায় সুবিচার পাবে? নিঃসন্দেহে রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, নানা ধরনের আইনি প্রতিষ্ঠান রয়েছে? রয়েছে একটু সুগঠিত আইনি প্রক্রিয়া যেখানে সকল নাগরিকের আইনি লড়াই করা এবং বিচার পাওয়া অধিকার রয়েছে কিন্তু সেটা কতোটা নাগরিক সুবিধেকে নিশ্চিত করে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্ত আলোচ্য কবিতায়, সাধারন কোন সন্তান বা নাগরিকে কথা বলা হয়নি, এখানে সমাজ কর্তৃক বিশেষ এক “তকমা” প্রাপ্ত সন্তানের অধিকারের কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ‘জাউড়া” নামক একটি তকমা প্রদানকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা সমাজপতিতে বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিয়ে থাকে, প্রথম প্রশ্ন তো সেটিই, তারপর বাকী প্রশ্ন??


কবি’র প্রতি রইলো অফুরান শুভেচ্ছা, সমাজের একটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে খুব অল্প কথায় একটি দারুন প্রতিবাদি চরিত্রের কবিতা “জাউড়া প্যাট” উপহার দেয়ার জন্য।