হাঁটছি তখন হলুদ রোদে
বুকে ছিল নীল মেঘেদের বাস
চোখের রঙে আকাশ রঙিন
পায়ের নিচে মজনু-রঙা ঘাস,


পাল্লা-আঁটা বরফবাড়ি চোখে
খুলবে কিনা ভাবছি শতবার
মত্ত বাতাস ছন্দ-হাতে হঠাৎ
খুলেই দিল বন্ধ থাকা দ্বার,


দাঁড়িয়ে ছিলে সেই দরজার ফাঁকে
ভরিয়ে দিলে বাড়িয়ে দেওয়া ঝুলি
ছবি আঁকার শখ ছিল না আগে
সেই তো প্রথম হাতে নিলাম তুলি।


রোজ বিকেলে আঁকতে বসি আজো
ধূসর রোদে ডুবন্ত ক্যানভাস
ঝোড়ো হাওয়ায় হলুদ জোয়ার
বিকেল ভাসায় মধ্যাহ্ন অভ্যাস।
----------------------------------------------
একুশে বই মেলা ২০১৬-য় সাহিত্য দেশ প্রকাশনী (ঢাকা) থেকে প্রকাশিত" প্রাণের পড়শী" কাব্য সংকলনে এই কবিতাটি আছে।
------------------------------------------------------------------------------
অনেক সময় পাঠকের ব্যাখ্যা কবির ব্যাখ্যার সাথে মেলে না। বিশেষত রূপক কবিতার ক্ষেত্রে এরকমটি প্রায়শঃই ঘটে থাকে। আবার  অনেক সময়  এমনও হয়, পাঠকের ব্যাখ্যা রচয়িতার ব্যাখ্যাকেও ছাপিয়ে যায়। যেন চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের সেই ঘটনাটিঃ বিদেশে আত্মগোপন করে থাকাকালিন নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগছিলেন চ্যাপলিন। ঠিক সেই সময় বিজ্ঞাপন থেকে জানতে পারলেন, একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে যেখানে চ্যাপলিনকে নকল করে দেখাতে হবে।যে সবচেয়ে ভাল নকল করতে পারবে সে পাবে প্রথম পুরস্কার। চ্যাপলিন ভাবলেন, অর্থকষ্ট লাঘবের দারুণ একটা  মওকা পাওয়া গেল তো!। খুব সহজেই প্রথম পুরস্কারটা ছিনিয়ে নেওয়া যাবে। তার চেয়ে কে আর ভাল তাকে নকল করতে পারবে? অথচ বাস্তবে দেখা গেল প্রথম পুরস্কারটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল অন্য একজন!


     আবার এমনও হয়, বহু দিন আগে লেখা কোন কবিতা রচয়িতার নিজের চোখেই কেমন যেন অচেনা লাগে। মনে হয়, কবিতাটা সত্যিই কি আমি লিখেছিলাম? ফলে রচনাকালে যে ভাব ব্যাক্ত করেছিলেন তা বিস্মৃত হয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবে কবিতাটি তাঁর চোখে ধরা দেয়। আপনারও কি এমন হয়? জানতে ইচ্ছে করে।


      যাই হোক, শিরোনাম থেকে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এখানে আমি নিজেরই কিছু কবিতা নিজেই ব্যাখ্যা করে পাঠকের সামনে তুলে ধরে বুঝে নিতে চাই  , তা পাঠককে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে কি না। আজ আমি চার বছর আগে লেখা একটি কবিতার ব্যাখ্যা দেওয়ার চিষ্টা করছি।


      
        ( কবিতাটি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত।)


        ব্যাখ্যাঃ হলুদ রোদ সাধারণত শরৎ ঋতুতে দেখা যায় যা মনকে উৎফুল্ল করে তোলে। বিষেশত কিশোর ও যুবকদের। " বুকে ছিল নীল মেঘেদের বাস" আর " পায়ের নিচে মজনু-রঙা ঘাস" পঙক্তিদুটো থেকে সহজেই বোঝা যায়, কথকও তখন কিশোর অথবা যুবক।বুকে নানা রকম সতেজ স্বপ্ন নীল মেঘেদের মতো বাসা বাঁধে তো তখনই।"মজনু-রঙা ঘাস" কথাটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কথকের তখন প্রেমে পাগল অবস্থা।


        কিন্তু প্রেম অথবা মানসী পাল্লা-আঁটা বরফবাড়িতে বন্দি। "পাল্লা-আঁটা" কেন?পরিবারটি যে ভারি রক্ষণশীল। " বরফবাড়ি" কেন? এমন পরিবারে কোন প্রেমিক কি উষ্ণ অভ্যর্থনা পায়? তাই " বরফবাড়ি" বলা হয়েছে।আর সেজন্যই কথকের মনে সংশয় প্রেমের দুয়ার খুলবে কি কখনও? তবু একদিন খুলে যায়। দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা মানসী প্রেমে মত্ত একনিষ্ঠ প্রেমিক-কাঙালকে আর ফেরাতে পারে না। তার বাড়িয়ে দেওয়া ঝুলি প্রেম-তণ্ডুলে ভরিয়ে দেয়। কথকও সেই প্রথম প্রেমিকাকে নিয়ে নানারকম রঙিন স্বপ্নের ছবি আঁকতে শুরু করে।


      কথক আজও আঁকতে বসে। কখন? বিকেলে। কেননা তার জীবনটাই এখন বিকেলে উপনীত হয়েছে। এখন তার প্রৌঢ়-কাল। হলুদ রোদের বদলে  তার আকাশে এখন ধূসর রোদের উঁকিঝুকি। তবু ধূসর রোদে ডুবন্ত ক্যানভাসেও কথক ছবি আঁকতে চেষ্টা করে। যৌবনের সেই দিনগুলোর স্মৃতি জোয়ারের মতো প্রৌঢ়ত্বকে ভাসিয়ে দিতে চায়।যৌবনের অভ্যাসগুলো ফিরে পেতে চায়।মধ্যাহ্ন এখানে যৌবনকালের প্রতীক।


        * জানিনা ব্যাখ্যাটা ঠিকঠাক দিতে পারলাম কি না? হয়তো আপনাদের অনেকেরই মনঃপুত হবে না। তবে চেষ্টা করলাম নিজের মতো করে। মহাপুরুষ বলে গেছেন, চেষ্টা করে যাও, ফলের আশা কোরো না।
        
        ** তবে, অন্ততঃ তিনজনের মন্তব্যে শিশি বা বোতলের কথা উঠে এসেছে। কেন? তা আজও আমার মোটা মাথায় ঢোকে নি। সম্ভবত বিকেলে মদের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার কথা বোঝাতে চেয়েছেন।  অথচ কবিতাটিতে কোথাও 'বোতল' বা 'শিশি' কথাটি নেই। আর হলুদ জোয়ার? মদকে হলুদ বলা হয় বলে তো শুনিনি, অনেক সময় লাল পানি বলা হয়ে থাকে বোধ হয়।
-----------------------
কলকাতা-৭০০১২৫
২৮/০৫/২০১৮