সূচনা :
ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে পৃথক হয়ে ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ আর ১৫ আগস্ট ‘ভারত’ নামে দুটি পৃথক দেশ সৃষ্টি হয়। একরাতের আরাধনায় সিরিল জন র‌্যাডক্লিপ নতুন দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এবং আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণ করেন। যা এমন এক অদ্ভূত মানচিত্র তৈরী করে দিয়েছে; যেখানে এ অঞ্জলের মানুষের আচরণে ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ উপবেশিক মনোভাব থেকে যাওয়ায় সবল দুর্বলের পাথর্ক্য সাধারণ মানুষের বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা আরো প্রকট রূপ ধারণ করেছে। মানচিত্রের কারুকাজে ভারতের অংশে বাঙালী বাংলা ভাষাভাষীদের সংস্কৃতিতে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে অমিল থাকায় নাগরিক সুবিধা ও অনগ্রসরতা বিরাজমান। আর পূর্ব পাকিস্তান অংশে বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে মাতৃভাষা, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, নাগরিক অধিকার সহ সর্বস্তরেই শোষিত ও বঞ্চিত হয়। ফলে আবারো বিভক্তির সুর ওঠে। প্রথমে আঘাত আসে মাতৃভাষা বাংলায় ১৯৫২ সালে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ ৬ দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ৭০ এর নির্বাচন অবশেষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা এবং বিজয়। বাংলা কবিতায় ১৯৪৭ সালের সাথে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন - “তেলের শিশি ভাঙল বলে, খুকুর পরে রাগ করো।/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা - ভারত ভেঙে ভাগ করো! তার বেলা? / ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা- জমিজমা ঘরবাড়ী / পাটের আড়ৎ ধানের গোলা- কারখানা আর রেলগাড়ী!- তার বেলা?” (খুকু ও খোকা) ইতিহাস সাক্ষ্য, আবার ১৯৭১ সালে তারই লেখা- ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ ইতিহাস সাক্ষ্য। তারপর ১৯৭৫ সালের নৃশংসতম হত্যাকান্ডে বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর এমন জঘন্য হত্যাকান্ডের পর প্রথম এলিজির বা শোক গাঁথা রচয়িতা যিনি দাফন-কাফন করেছিলেন টুঙ্গি পাড়ার মসজিদের ইমাম শেখ আবদুল হালিম আরবী ভাষায় লেখা এবং পরে কবি নির্মলেন্দু গুণের অনুরোধে বাংলা অনুবাদ করেন সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতার প্রতি প্রথম এলিজি অকৃত্তিম ভক্তির ইতিহাস সাক্ষ্য। একই বিষয়ে প্রথম প্রতিবাদী কবিতা লেখেন কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি মহাদেব সাহা ও কবি নির্মলেন্দু গুণ ইতিহাস সাক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্ব সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর শোক গাঁথা, কবিতা লেখা হয়েছে বা হচ্ছে। কেননা বাংলার ইতিহাসে ’৭৫ সালে একই সাথে এত বেশী আপনজন হারানোর এক বিষাদ সিন্ধু রচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়েও ইতোমধ্যে বাংলা সাহিত্যে প্রচুর কবিতা লেখা হয়েছে বা হচ্ছে। ফলে শেখ হাসিনা ভিত্তিক সাহিত্যও সৃষ্টি হচ্ছে এবং এই সংক্রান্ত অনেক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।


বাংলা কবিতায় বিজ্ঞান যুগের সূচনা :


বিজ্ঞান যুগের সূচনা পর্বে প্রশ্ন থাকে বিজ্ঞান কবিতার সংজ্ঞা কী ?  বিজ্ঞান কবিতা (Science Poetry)  - বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে ব্যক্তি ও বস্তুর সমন্বয়ে রচিত কবিতা। বিজ্ঞান কবিতা মূলত মন্ময় ও তন্ময় দুটোতেই রচিত হতে পারে। কবি তার ব্যক্তি অনুভূতিতে অথবা পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমান বস্তু নিয়ে বিজ্ঞানকে অলংকারিক বিন্যাসে ছন্দিত করবে।  বিজ্ঞান আশ্রিত কবিতা। এখানে বিষয়গত, গঠনগত কবিতা সহ ছন্দবদ্ধ, গদ্য কবিতায় মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ ও তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ দুই-ই হতে পারে। বিজ্ঞান কিছুটা পরাবাস্তব। কেননা কবির স্বপ্ন আর দার্শনিকের তত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞানী প্রমাণের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলাফল এক নাও হতে পারে। অথবা ভাবনার চেয়ে বেশী কিছু বা অন্যরকম কিছু হতে পারে।
আদিম যুগের (৫০০০-৫০০ খ্রিষ্টাব্দ) প্রাগৈতিহাসিক যুগ ও প্রাচীন যুগ। প্রাচীন যুগে সপ্তম শতাব্দী হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত চর্যাপদ হচ্ছে প্রাচীন যুগের একমাত্র সাহিত্য নিদর্শন। আর অলংকার বিবেচনায় এগিয়ে আছেন কবি বাল্মীকি। চর্যাপদ হলো বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত কাব্যের নমুনা। একহাজার বছর পূর্বের রচিত চর্যাপদ মানুষ জেনেছে একশ বছর আগে। মধ্যযুগে ১৪০০-১৪৫০ অর্ধশতকে রচিত উৎকৃষ্ট গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। চর্যাপদের ধর্মসঙ্গীত ও সামাজিক চিত্র থেকে বাংলা কবিতা বিবর্তিত রূপে মুক্তি পেয়ে শ্রীকীর্তন রূপে রাধা কৃষ্ণের লৌকিক প্রেম কাহিনীতে এসে পৌঁছায়। প্রাচীন যুগের দেহ বন্দনা ও ধর্মীয় সাধনা আর মধ্য যুগের ধর্মীয় আচ্ছাদন ও কুসংস্কার এবং প্রণয় উপাখ্যানের খোলস ত্যাগ করে ইউরোপীয় প্রভাবে উনিশশতকে বাংলার কবিতার নবজাগরণ শুরু হয়। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে জাগ্রত হয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশের সঙ্গেই সমাজ ও অর্থনীতির বাঁক বদল। যদিও প্রথম দিকে বুর্জোয়াদের অসঙ্গতি ছিল। পরবর্তীতে নতুন চিন্তা চেতনায় জাগ্রত একদল তরুণের সংগঠিত রূপ ইয়ংবেঙ্গল সমাজ ও ধর্মীয় কুসংস্কারের সংস্কার শুরু করলে মানুষের পরির্তন দ্রুততর হয়। চর্যাপদেও মানুষের বিচ্ছিন্ন মনোভাব দেখা যায়। এ সময় মানুষের মধ্যে লাম্পট্য ছিলো, শ্রেণী বৈষম্য ছিল। আর মধ্যযুগে (৫০০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) কবিরা অন্তর সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন যা সমাজের বৃহত্তর মানুষের সাথে একাত্ম ছিলোনা। তারা অন্তর্লোকের তৃপ্তির জন্য সাধনায় মশগুল ছিলেন। ষোল শতকের কবি চন্দ্রাবতী প্রেম ও ধর্ম চিন্তার কবিতা এক নতুন ভাবনার দিকে সমাজকে এগুতে সাহায্য করেছে। তারপর নাথ কাব্যের চেতনার পর বৈষ্ণব সাহিত্য এবং মঙ্গলকাব্য, পালাগান, গীতিকবিতা, সাহিত্যের হিন্দু-মুসলিমীকরণ আর সর্বশেষ আধুনিক কবিতার ধারা। বাঙ্গালী সমাজ ব্যবস্থার সংকট কালের দূত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) সমাজের বিশৃঙ্খলা দেখে নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন। তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন নিঃসঙ্গতার আর্তনাদ, হাস্য, রঙ্গরস, ব্যঙ্গ ও কৌতুকে দেশপ্রেম ও সমাজ চেতনা জাগ্রত করেছেন। ১৭৬১-১৮৬০ একশত বছরের নীরব প্রস্তুতির সময়ের পুরোহিত ছিলেন কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত। বাংলা সাহিত্য ভারতীয় পুরাণ থেকে উপাত্ত নিয়ে যাত্রা শুরু। এ সময়কে সাহিত্যের সন্ধিযুগের কাল বলা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মূলত মধ্যযুগের শেষ কবি। কবি ভারতচন্দ্র আধুনিক যুগের প্রথম পুরুষ আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত মধ্যবর্তী কালের যুগসন্ধিতে আর্বিভাব।


পরবর্তী সময়ে কবিরা বিভিন্নভাবে নান্দনিক আঙ্গিকে গীতিকবিতা, লোকজ উপাদান, নগর জীবন, মরমীবাদ, সুফীইজম, ধর্মচেতনা, আধ্যাত্মিকতা এবং অবচেতন মনে বিজ্ঞানকে আর্শীবাদ না দেখে দু’একজন অভিশাপ রূপে শংকিত কাব্য রচনা করেছেন। বর্তমান সময়ে কবিতা কেন বিজ্ঞান মুখী হবে এই বিষয়ে অনেক প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় বাংলা কাব্য চেতনা যখন নতুন মাত্রিকতা নিয়ে আর্বিভাব হয়েছে। তখনই দুটি পক্ষ বিপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এতে একটি পক্ষ অল্প সময়ের ব্যবধানে বিজ্ঞান কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের সাথে সাথে সাদরে গ্রহণ করেছে। অন্য পক্ষে বিরোধীতা হচ্ছে কবিতা নান্দনিক বিষয়। এখানে বিজ্ঞানের মিশ্রণ ঘটলে মানুষের মনের যে ছান্দিক প্রকাশ সেটি বাধাগ্রস্ত হবে। মানুষ মনের সুপ্ত স্বপ্ন অতিমাত্রায় বিজ্ঞানের কঠিন ফ্রেমে বাধা পড়বে। কিন্তু বিজ্ঞান কবিতার বই প্রকাশের পর সমালোচনায় এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বরং নান্দনিকতার আদল ঠিক রেখে বিজ্ঞানকে ব্যাকরণিক কলায় সিদ্ধ অর্ন্তভুক্তি বা সমন্বয় করেছে যা পাঠককে কবিতার ঘোরে আচ্ছন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞান কবিতার এই আন্দোলনটি অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠনের বর্তমান নির্বাহী সভাপতি কবি ও সাংবাদিক শেখ সামসুল হক ষাটের দশকে লেখা তার কাব্যগ্রন্থ চমৎকার সাহস গ্রন্থে বিজ্ঞানকে সমন্বয় করেছেন। তারই অনুপ্রেরণা, সার্বিক সমর্থন ও মনিটরিং -এ ১৯৮৮ সাল থেকে কবি হাসনাইন সাজ্জাদী শুরু করেছেন বিজ্ঞান কবিতা আন্দোলন। ধারাবাহিকভাবে ২০১৪ সালে বিজ্ঞান কবিতার রূপ রেখা দিয়ে যখন বই প্রকাশ করলেন তখন এটি পূর্ণজাগরণের মত সবার নজরে আসলো। তারপর রীনা তালুকদার’র (এই নিবন্ধকার) বিজ্ঞান কবিতা শীর্ষক অলংকারিক বিন্যস্ত ৪টি (বিজ্ঞান কবিতা, প্রেমের বিজ্ঞান কবিতা, সাত মার্চ শব্দের ডিনামাইট, স্বাধীনতা মঙ্গলে) একক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিজ্ঞান কবিতার প্রথম বই হিসাবে লিখিয়ে সমাজ ২টি প্রবন্ধ ও বেশ কটি কবিতার বই দিক নির্দেশনা হিসাবে পেয়ে গেছে। অলংকারিক বিন্যাসকে সমৃদ্ধ রেখে বিজ্ঞানকে সঠিক সমন্বয় করতে পারলে বিজ্ঞান কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে বিজ্ঞান আরো সহজ হয়ে ধরা দিবে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞান কবিতা মানুষের আয়ত্বে এসে প্রিয় হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। সেখানেই বিজ্ঞান কবিতার সার্থকতা নিহিত। কেননা বিহারী লাল চক্রবর্তী  তথা ত্রিশের দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা কবিতা একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কারণে এটি অবশ্যই বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যে এক নতুন সংযোজন নিঃসন্দেহে। সব কাজের শুরুতেই বাধা আসে। তাই নান্দনিকতা ও বিজ্ঞানকে দু’ভাগ করে যে বিতর্ক জমে ওঠেছে। তার মুখোমুখি হতে বিজ্ঞানকে নান্দনিকতার প্রলেপ দিয়ে ভালোবাসার আচ্ছাদনে বিজ্ঞান কবিতার এখন সফলতায় সুখের দিন।
বিজ্ঞান কালক্রমে ২০০’র অধিক শাখা বিষয়ভিত্তিক ভাগ থেকে আরো ভিন্নরকম শাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ও পড়ছে। অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে বিজ্ঞান এখন বিভক্ত। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞানও চলছে মানুষকে আরো উন্নতর সেবা প্রদান করার দিকে। ইউরোপীয় আদি কবি হোমার। গ্রীক পুরাণে ইলিয়ার্ড ও অডিসি হোমারের দেবত্ব কাহিনী। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের কবি হেসিওড এর ‘ওয়ার্ক এন্ড ডে’ কাব্যগ্রন্থ প্রথম মানুষের চরিত্রকে উপজীব্য করে কাব্য রচনা করেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ কবি ইমরুল কায়েসের কবিতাকে ইউরোপে রোমান্টিক কবিতা হিসাবে প্রচার করেন। টিএস ইলিয়ট কবিতা থেকে অলংকার মুক্ত করেন। ফরাসী কবি শার্ল বোদলেয়ার পরাবাস্তবতার কবিতাকে আধুনিক কবিতা হিসাবে জন্ম দেন। বাংলা চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব সাহিত্য ধর্মমত। নাথ ও বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মগ্রন্থ অপভ্রংশ। আর রামায়ন, মহাভারত, বেদ ও পুরাণ ধর্মগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ লালনের আধুনিক রূপ। বাংলায় পাঁচতারকা রবীন্দ্রনাথকে মুখোমুখি রেখে  টিএস ইলিয়ট আর বোদলেয়ার চর্চা করেন। কবি নজরুল ও সুকান্ত বিষয়ভিত্তিক ভাবে গণচেতনা নিয়ে কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন। তারপর শুধু একই লেবু চিবিয়ে তিতা করে চিনি, গুড়, ক্রিম মেখে স্বাদ পরিবর্তনের চেষ্টাই চলছিল। অর্থাৎ একই খাবারে জাবর কাটা। কেউ কেউ মনে করেন কবিতা হচ্ছে জলরং বা তেল রং, গদ কবিতা হচ্ছে ফটোগ্রাফি, ছড়া হচ্ছে কার্টুন ছবি। কবি তার কবিতায় বিজ্ঞানের এসব অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শাখাকে বিশ্লেষণ করে কবিতায় উপমা, রূপক, অনুপ্রাসসহ  অলংকারের অপরাপর অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। কালের ধারা বিবর্তনে সময়ের প্রয়োজনে বিদেশী ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন শব্দ সংযোজিত হয়েছে। আবার বিদেশী সাহিত্য থেকে বাংলা সাহিত্যের ছড়া ও কবিতা শাখায় নানা ধারার ছন্দ স্থান পেয়েছে। কবিতায় বিজ্ঞান বিষয়টা এখনো অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। বুঝেও না বুঝার ভান করেন কেউ কেউ, অনেকেই গোষ্ঠী বা ভাবনা কেন্দ্রিক ধারণায় অবজ্ঞার চোখে দেখেন। অনেকেই প্রশ্ন করেন বিজ্ঞান কবিতা কী ভাবে লিখবো ? অথবা কি কি উপকরণ থাকলে কবিতা বিজ্ঞান কবিতা বলে চিহ্নিত করা যাবে। অনেকেই ভ্রু কুঁচকে বলেন কবিতা আবার বিজ্ঞান হবে কিভাবে ? কবিতাতো নান্দনিক বিষয়। হ্যাঁ কবিতা নান্দনিকতো বটেই। মানুষ দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মানুষের অনুষঙ্গ হিসাবে অনেক যান্ত্রিক জিনিসের প্রয়োজন হয়। একথা অস্বাীকার করার কোনো যুক্তি নেই। পৃথিবীতে যত বেশী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে ততোই মানুষ যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করছে। সেজন্য মানুষের ব্যক্তি জীবন যাপনসহ যাবতীয় বিষয় এখন বিজ্ঞানভিত্তিক। কবিতা একটি বর্ণ নয়। বরং বর্ণ মিলে শব্দ এবং শব্দ মিলে বাক্যের সুশৃঙ্খল বিন্যাসিত রূপ। একা বর্ণ ও শব্দই কবিতা নয়। এর অনেক উপকরণ ও অনুষঙ্গ প্রয়োজন হয়। অনেক উপকরণের সমন্বয়েই একটা কবিতা ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে। তারপর আবার গুণগত ভাল মন্দের প্রশ্নতো আছেই।
প্রসঙ্গত: আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে বাংলা কবিতা বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্রের রূপ, বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক আঞ্চলিক ভাষার বহুল ব্যবহার, ভাষা ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি, লোক ঐতিহ্য, জলবায়ু, অষ্টিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন রকম শরীর ও মুখের রং বা চেহারার আকৃতি, আচরণগত পার্থক্য সেই সাথে বাংলা ভাষার শব্দের আবেদন চতুরমুখী হওয়ায় কবিতায় আবেদন ও মোহমায়া বা আবেগ বেশী। পাঠককে আচ্ছন্ন করতে সক্ষম। বর্হিবিশ্বের ভূ-প্রকৃতি, জীবনযাপন, আচরণ, ভাষা ও সংস্কৃতি দেশভিত্তিক। অনেক দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্য প্রায় মিল থাকায় এবং সমুদ্র, বরফ, আগ্নেয়গিরি, মরু অঞ্চল, ফুল-পাখির পাথর্ক্য আর আকাশ, নদী, বৃষ্টি-বাতাস, পাহাড়, বনভূমি, চাঁদ-তারা সারা বিশ্বেই এক রূপ। এসব তুলনা করলে বাংলা কবিতা বিশ্বে যে কোনো সাহিত্যের কাতারে দাঁড়াবার যথেষ্টই যোগ্য। বাংলা শব্দের অন্তর্মুখী-বর্হিমুখী ও চতুর্মুখী প্রকাশভঙ্গির কারণে বিজ্ঞান সমন্বয় খুব সহজ বলা যায় না। তারপরও এর সাফল্য হিসাবে অনেক কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে এবং চলমান রয়েছে।


ভাবনায় বঙ্গবন্ধু ও বিজ্ঞান কবিতা :


বঙ্গবন্ধু সাহিত্য ধারায় নতুন সংযোজন বিজ্ঞান কবিতা। কবি রীনা তালুকদার (এই নিবন্ধকার) বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ গঠন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতায় বিজ্ঞান সমন্বয় করে মান্নোনয়ন করার চেষ্টায় নিয়মিত বিজ্ঞান কবিতার পাঠের আসর চলমান। যা ফেসবুকের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায় থেকে বিশ্বের সাহিত্য প্রেমীদের কাছে সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। তাদের মান্নোনত সাহিত্য সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে রীনা তালুকদারের ২০১৫ সালে প্রকাশিত সাত মার্চ শব্দের ডিনামাইট কাব্যগ্রন্থটি একটি বিজ্ঞান কাব্যগ্রন্থ। বিজ্ঞান কবিতার ভাবনায় আন্দোলন চলছে বাংলা সাহিত্যে ১৯৮৮ সাল থেকে। দীর্ঘ আন্দোলনে দেশে বিদেশে বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠনের সাহিত্য চর্চায় বিজ্ঞান, কবিতায় সফল ভাবে সমন্বয় করে ইতোমধ্যে ২০১১ সাল থেকে পৃথক ভাবে কয়েকটি কবিতা ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। যা বেশ আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়েছে। আর একই ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞানের ছোঁয়া লেগেছে বাংলায় জনপ্রিয় ও চর্চিত বিভিন্ন ধারার বিদেশী সাহিত্যেও। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে দীর্ঘ সময়ে ১৯৭১-এরপর থেকে চলমান সময়ে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে। তা বিশ্বের যে কোনো সময়ের যে কোনো জনপ্রিয় নেতাকে নিয়ে হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জীবনী সাহিত্য থেকে শুরু করে প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং হাজার হাজার কবিতা লেখা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানকে সমন্বয় করে জাতির পিতাকে নিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থ-সাত মার্চ শব্দের ডিনামাইট গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে। যা জনপ্রিয় হয়েছে বা হচ্ছে। একই ধারাবাহিকতায় আমরা কতিপয় বিজ্ঞান মনস্ক কবি বাঙালী জাতির পিতাকে নিয়ে রচিত বিশেষ করে কবিতা ও কবিতা সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধ, নিবন্ধ বহুল গবেষণা ও চর্চা করছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত সাহিত্যকে বাংলা সাহিত্যের কালপঞ্জিতে চিহ্নিত করা যায় এমন যুগোপযুগি নামকরণ করা এবং এই সাহিত্য তথা কবিতা ও কবিতা সংশ্লিষ্ট লেখা গুলোকে আরো অগ্রসর ও বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াসে (এই নিবন্ধকার) বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। রীনা তালুকদার’র (এই নিবন্ধকার) প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে সাহিত্যের কাল পঞ্জিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেননা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাংলার মাতৃভাষার ১৯৫২ সালও অর্থহীন হয়ে যেতো। সেই দৃষ্টিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্য আজ গৌরবের সাথে এগিয়ে চলছে। কবিতা এক নিখুঁত শিল্প। আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে সাহিত্য গড়ে ওঠেছে; সেগুলোকে একটি কালজয়ী যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। ইংরেজী সাহিত্যে যেভাবে ভিক্টোরিয়ান যুগ, সংস্কৃতি সাহিত্যে চৈতন্য যুগ, বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগ, রবীন্দ্র যুগসহ এ রকম আরো বিভিন্ন সময়কে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাহিত্যে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একটি যুগ সৃষ্টি করেছেন বলে আমরা মনে করি। অনেক ধরনের সংগঠন বঙ্গবন্ধুর নামে দেশে বিদেশে কাজ করার অভিপ্রায়ে গঠিত হলেও বাস্তবিক সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত সাহিত্যকে উন্নত করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। অনেক সংকলন রয়েছে কিন্তু লেখার মান উন্নত করার বিষয়টি দেখা যায় না। আর সেখানে একটা শূন্যতা বিরাজ করছিলো বলেই আমরা বঙ্গবন্ধু ভিত্তিক প্রবন্ধ সাহিত্য ও কাব্য সাহিত্যের উন্নত করণের চিন্তা ভাবনায় এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নিজেই, ১৯৫৭ সালে ৩ এপ্রিল আইন সভায় বাংলা একাডেমী আইন পাস, পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৫৭ সালের ৪ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বিল উত্থাপন করে সাংস্কৃতিক বিকাশে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে আসার পথে পাকিস্তান কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে ভারতের মাটিতে নেমে প্রথম বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন- ‘কবি গুরু দেখে যান-আমার বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে’ এই কথা বলা এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কোনো পাসপোর্ট ছাড়া ভারতের মহান হৃদয়ের ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি সাপেক্ষে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এনে বাসভবন ও ভাতা নির্ধারণ, তার গানকে রণসঙ্গীতের মর্যাদাদান, সড়কের নাম ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’ করায় কবিদের মর্যাদার দিকটা আরো উঁচু করে দিলেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। রবীন্দ্র প্রিয় বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্র সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদাদান, কবি ফররুখ আহমদকে অনুদান, শিল্পী কমল দাশগুপ্তকে রেডিওতে চাকুরী দেয়া, কবি জসিমউদ্দীনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ, অসুস্থ কবি হুমায়ুন কাদির, কবি আবুল হাসান, কবি মহাদেব সাহাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ প্রেরণ, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে কবি দাউদ হায়দারকে নিরাপত্তা দিয়ে কলকাতায় প্রেরণ, জেলখানা থেকে মুক্তি দিয়ে কবি আল মাহমুদকে চাকুরি প্রদান, নাটকের উপর থেকে প্রমোদ কর ও সেন্সর প্রথা সহজীকরণ করেছেন। কবি/ সাহিত্যত্যিকদের মর্যাদা দেয়া এবং সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতিকে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা আরো বেগবান করে দিয়েছে। একই ভাবে বঙ্গবন্ধু কন্যাও কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি মহাদেব সাহা চিকিৎসার ব্যবস্থা, কবি হেলাল হাফিজের চিকিৎসা ও কবি শহীদ কাদরীকে মৃত্যুও পর দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। তিনিও কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহ নানাবিধ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন। আর  দেখা যায় যে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং সেই সাথে বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও সাহিত্যের বিশেষ করে কাব্য সাহিত্য বেগবান হচ্ছে৤


অনেকেই প্রশ্ন করেন কবিতা আবার বিজ্ঞান কেন ? অনেক প্রশ্ন পেয়েছি। অনেক উত্তরও লেখার চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যে এই নিয়ে প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস খুব নতুন নয়। সেই চর্যাগীতি থেকে বর্তমান বাংলা সাহিত্য;  বাংলাদেশের সাহিত্য পর্যন্ত চলমান। বাংলাদেশ এবং বাঙালী সাহিত্য দুটোতে সময় ও বিষয়বস্তুর কিছু পার্থক্য আছে। বাঙালী সাহিত্য সেই ইতিহাস পুর্বের ধারাবাহিকতায় চলমান। বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এই ঘোষণার ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমরা পেয়েছি। কিন্তু প্রকৃত মুক্তির জন্য এখনো অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংস্কৃতিক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশের সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাস বায়ান্ন সাল থেকে চলমান। এই দেশকে যারা ভালোবাসে, এদেশের যারা উন্নয়ন চায়, এদেশের মেহনতি মানুষের মুখে যারা হাসি দেখতে চায়, যারা দরিদ্র মানুষকে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দিতে চায়, যারা এদেশের সকল স্তরের শ্রমজীবি মানুষকে সুখে শান্তিতে দেখতে চায়, বাউল- লালন- হাসনের সেই কৃষ্টিকে লালন করে ধারণ করে এবং ঐতিহ্যকে চর্চা করে, ইতিহাসকে চর্চা করে, দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে দেশকে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে দেখতে চায় তাদের জন্যই বিজ্ঞান কবিতা লেখা। সাধারণ মানুষের মাঝে বিজ্ঞানকে সহজ ভাবে উপস্থাপন করে জাতিকে বিজ্ঞান মনস্ক করে গড়ে তোলার লক্ষেই বিজ্ঞান কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখে যেতে হবে, নিরন্তর চর্চা করতে হবে।


বাংলা কবিতার প্রকরণ ও ব্যকরণিক পরিবর্তন :


বিষয়বস্তুতে ব্যাপক পরিবর্তনে মাতৃভাষা হাজার বছরের খনার বচন সমৃদ্ধ লোক ঐতিহ্য ধারণ করে সাংস্কৃতিক চেতনায় বীর বাঙালীর কর্মঠ জীবনের নতুন পরিচয়। বিজ্ঞানের নবতর আবিস্কারকে ধারণ, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি সাধন, কম্পিউটার, পেনড্রাইভ, ইন্টারনেট, ব্রেইল ফোন, জুটা পকেট প্রিন্টার, সৌরবিমান আবিস্কার, ন্যানো টেকনোলজির জনপ্রিয়তা, মহাবিশ্বের গবেষণায় মঙ্গলে মানুষের বসতি স্থাপনের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন, হাইটেক পার্ক স্থাপন, দীর্ঘতম পদ্মা সেতু নির্মাণ, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নে ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তৃতি, অসাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী হামলা কবিতার প্রকরণকে বিস্তৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে কবিতায় নতুন শব্দ সৃষ্টি, ক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে সমুচ্চয়ী অব্যয়পদ বর্জন করে কবিতাকে সাবর্জনীন রূপ দেয়া, অলংকারিক বিন্যাসে, ছন্দের রিনিঝিনিতে উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও বক্রোক্তি সহ অপরাপর ব্যকরণিক বিষয়ে বিজ্ঞান সমন্বয়ে কবিতার সার্বজনীর রূপ কবিতাকে পৃথক বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। বিজ্ঞানকে ধারণের কতগুলো যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তা হলো বর্তমান বিশ্বের উষ্ণায়ণ, বরফ স্তর হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভূ-কম্পণে ভূ-ত্বকের পরিবর্তন, রাসায়নিকের ব্যবহারে ফসলী জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস, আবাদী জমি হ্রাস, হাইব্রিড পদ্ধতির ব্যবহার,  ক্ষতিকর ওষুধ মানব খাদ্যে ব্যবহার, সমুদ্র জলের স্তর হ্রাস, ধুমপানে নিকোটিন গ্রহণ, বনায়ন হ্রাস, গ্রীণহাউজ ইফেক্ট, বাতাসে দূষিত সীসা, জনসংখ্যা ও আরাম আয়েশ বৃদ্ধি পাওয়া, মানুষের রোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার, যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণ, গ্লোবালাইজেশন, মানুষের চাওয়া-পাওয়া সমন্বয় সাধন ইত্যাদি কারণেই বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার বিষয়গুলো কবিতায় অনস্বীকার্য। কারণ এগুলো মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা ও জীবন জীবিকার সাথে সম্পৃক্ত।
ত্রিশোত্তর সময়ে কালভেদে বিশ্ব সাহিত্যে রোমান্টিসিজম, রিয়্যালিজম, ইম্প্রেশিনিজম, ফাবিজম, কিউবিজম, ফিউচারিজম, এক্সপ্রেশিনিজম, সুররিয়্যালিজম, কমিউনিজম, এক্সিসটেনশিয়ালিজম-এর মতবাদ কবিতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ত্রিশে পাঁচতারকার লড়াই রবীন্দ্র ভাবনার বিরুদ্ধে। চল্লিশের দশকে সাম্যবাদী জোয়ার কবিতায়। আর পঞ্চাশে আন্তর্জাতিকতার ঢেউ এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সমরসেনের কবিতায় গণচেতনা। পূর্ব বাংলায় সাহিত্য ক্ষেত্রে একদিকে মানবতাকে দুরে সরিয়ে নজরুলের কবিতার ধর্মীয়করণ করার চেষ্টা; অন্যদিকে মাতৃভাষার দাবী, পঞ্চাশ দশকের পরে কবিতার পরিবর্তন কী ? ষাটের সময়ে কবিতাঙ্গনে হতাশা, গ্লানি, নৈরাজ্য ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ৬০ এর দশকে অতিযতি ব্যবহার, অতিযতি মুক্তকরণ এবং দুঃখবাদী কবিতা চর্চা করা হয়েছে। সত্তরের দশকে প্রেম আর বিপ্লব থাকলেও বিপ্লব কবিতায় কতটুকু ছিলো ? একাত্তরের যুদ্ধ ছড়া সাহিত্যে স্বদেশ প্রেম, ৮০ দশকে দুঃখবাদী ও ক্ষুধা বিরোধী কবিতা চর্চা, ৯০ দশকের কবিরা শূন্য দশকে এসে বিজ্ঞান কবিতা নিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।  শূন্য দশকে বিজ্ঞান কবিতা চর্চার বিস্তৃতি। চলছে শূন্য এক বা শূন্য দশ দশক। এছাড়া ৭৫ থেকে ধারাবাহিক ভাবে চলমান সময়ে বঙ্গবন্ধু বা মুজিববাদী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মুজিব কেন্দ্রিক প্রবন্ধ ও কাব্য সাহিত্য বিজ্ঞান সমন্বয় করে নতুন দিক্ সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞান কবিতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গন। ফেসবুক, ব্লগার সহ নানা অ্যাপস বর্তমানে বিশ্বব্যপী একটি সামাজিক নেটওয়ার্ক। যা বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করছে, সবাইকে একসূত্রে গেঁথে রাখছে, সবার সাথে দৈনন্দিন বা যখন তখন যোগাযোগ ঘটছে। ফেসবুক সাহিত্য ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলছে। বর্তমানে ফেসবুক, ব্লগার সহ নানা অ্যাপস সাহিত্য সবার কাছেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। বিশেষ করে কাব্য সাহিত্য বেশ চর্চা হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। মুহূর্তেই লেখা কবিতা বিশ্বব্যপী ছড়িয়ে দেয়া যায়। বর্তমানে বিজ্ঞান কবিতা অলংকারিক বিন্যাসে কোমলতায় বিজ্ঞানের সমন্বয়ে লিঙ্গবৈষম্য, ধর্ম-বর্ণ-জাত-গোত্রকে পরিহার করে সার্বজনীন মানুষ মানবতার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। এটিও বিজ্ঞান কবিতার এক বিস্ময় ও আর্শীবাদ। মানুষের আরাম আয়েশে উন্নত জীবন যাপন, সরকারের গণকর্মমুখী পদক্ষেপ মানুষের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সাহিত্য চর্চায় সকল অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটছে। সরকারী পৃষ্টপোষকতায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ধারণ, লালন, পালন উন্মুক্ত হয়েছে। বিজ্ঞান কবিতা মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের কবিতার সুরের বিচ্ছিন্নতার রূপায়ন ঘটেছে। ভাষা ও সাহিত্যের ধারায় বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞান কবিতা বহুল চর্চা হচ্ছে বিজ্ঞান সমন্বয়ে। বর্তমানে বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যে চলছে বিজ্ঞান কবিতার আন্দোলন। কবিতার গতি প্রকৃতি বদলে দেয়ার লক্ষে উপস্থাপিত বিজ্ঞান কবিতার থিওরী বিশ্বে আলোচিত ও গৃহীত হয়েছে এবং হচ্ছে। যা বাঙালির বিশ্ব জয়ের আরেক দফা উত্তোরণ বলেই মনে করি।


ফেসবুক সাহিত্য :
ফেসবুক বর্তমানে বিশ্বব্যপী একটি সামাজিক নেটওয়ার্ক। যা বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করে, সবাইকে একসূত্রে গেঁথে রাখে, সবার সাথে দৈনন্দিন বা যখন তখন যোগাযোগ ঘটে। সরাসরি দূরের মানুষের সাথে কথা বলা, ছবি দেখা বা কাঙ্খিত বিষয় জানা ও দেখা যায়। কিন্তু এ ফেসবুককে অনেকেই অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বিশাল জনগোষ্ঠিকে বিপদের সম্মুখীন করে। অনেকেই ফেসবুকে বাজে ছবি পোষ্ট করে যা দৃষ্টি কটু হয়ে দাঁড়ায়। ফেসবুক সাহিত্য ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলছে। এটিও বিজ্ঞান কবিতার এক বিস্ময় ও আর্শীবাদ। বর্তমানে ফেসবুক সাহিত্য সবার কাছেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে কাব্য সাহিত্য বেশ চর্চা হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। মুহূর্তেই লেখা কবিতা বিশ্বব্যপী ছড়িয়ে দেয়া যায়। তবে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের সাথে বসবাস করছে। সেই হিসাবে অফুরন্ত সময় থাকে না। তাই ফেসবুককে একধরণের বিনোদন হিসাবে গ্রহণ করছে। বাংলা সাহিত্যও সেই ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ ছোট ছোট কথায় ফেসবুকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুখের কথা লিখে জানান দিচ্ছেন তাদের পরিচিতজন ও সারা বিশ্বকে।


উপসংহার :
বিশ্ব সাহিত্যে কবিতা এক উচ্চমার্গের শিল্প মাধ্যম। খুব কম মানুষ রয়েছেন যারা সৃজনী শক্তিকে কবিতা চর্চায় কাজে লাগান। বিশ্বে বিভিন্ন ভাষা ভাষী জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের আঙ্গিক তৈরী করে জাতিসত্তার রূপায়নে কবিতা প্রতিনিধিত্ব করে। বিশ্ব সাহিত্যে কবিতার বিভিন্ন উপকরণ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকরণিক নিয়মে পরিবর্তন ও সংযোজন বিয়োজনের মাধ্যমে বিবর্তনের চেষ্টা এখনো চলমান রয়েছে। একই ধারায় বাংলা কবিতা চর্যাপদ থেকে বিজ্ঞান কবিতায় উত্তরণ ঘটেছে। বিশ্ব সাহিত্যে বর্তমানে বিজ্ঞান সমন্বয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন বলে মনে করি। বিশ্বব্যপী প্রথম ও দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধ এবং হিরোশিমা নাগাসাকির ক্ষত, ইসরাইল-ফিলিস্তিন দাঙ্গা, পৃথিবী ব্যপী উগ্রবাদীদের নিজস্ব থিওরীর প্রতিষ্ঠায় শান্তিকামী সাধারণ জনতার জীবনহানি, পাশাপাশি উগ্রবাদীদের দমনে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা, হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সহ বিশ্বব্যপী উগ্রবাদী হামলার প্রতিবাদে প্রচুর কবিতা রচিত হয়েছে, জলবায়ু উষ্ণায়ন, বাংলা কাব্যসাহিত্যে ইতিহাসে বিজ্ঞান সমন্বয় বিশ্ব ব্যপী বিস্তৃতি লাভ করেছে। আর  কবিতায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। কবিতা আরো সমৃদ্ধ হয়ে কাব্য সাহিত্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে সমৃদ্ধ স্ব-মহিমায়। বাংলা ভাষার যুদ্ধ তবেই সার্থক।



পরিচিত : নব্বই দশকের কবি, গবেষক। সাবেক ছাত্রনেতা (ছাত্রলীগ)। সভাপতি- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ, নির্বাহী সচিব- অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন। পড়াশুনা- এম.এ। জন্ম - ২১ আগস্ট, ১৯৭৩, জেলা-লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ। কাব্যগ্রন্থ- ১৪টি, গবেষণা প্রবন্ধ-২টি (বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা ও কাব্য কথায় ইলিশ), সম্পাদনা-২টি, জাগ্রত ছোট কাগজের সম্পাদক, সহযোগী সম্পাদনা- ১১টি। লেখালেখির জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর মহান বিজয় দিবস-২০১১ সম্মাননা ও সাপ্তাহিক শারদীয়া কাব্যলোক বিশেষ সম্মাননা-২০১৩ পেয়েছেন। ঠিকানা: এ-১ ও এ-২,  বাণিজ্যবিতান সুপারমার্কেট, ইস্টকর্ণার, ২য়তলা, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫, বাংলাদেশ।