কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য কেবল একজন কবি নন,নিভৃতচারী এক সচেতন যাত্রীক।।
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
------------------------


ফেস বুকে আমার বিচরণ প্রায় চার বছর হতে চললো।এই চার বছর যেনো চার যুগ। যেহেতু নিজে একটু আধটু কলম ধরি সেই সুবাদে অনেক কলমবাজ বন্ধু পেয়েছি।হয়তো তাদের তুলনায় আমি নগণ্য।তবু তাদের সান্নিধ্য আমাকে গর্বিত করেছে।এই মূহুর্তে কাকে ছেড়ে কার কথা বলি।দীর্ঘ লাইন স্মৃতি ভারে নুয়ে পড়ছে।তাছাড়া স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমার স্মৃতি এমনিতেই খুব দুর্বল ।তাই কোনও নাম অনিচ্ছাকৃত অনুল্লেখ থাকলে তার জন্যে বন্ধুদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী ।


যাঁরা একটু নাকউঁচু স্বভাবের,মনে করেন ফেবুতে যাঁরা লেখেন তারা আবার কবি নাকি ! তাদের উদ্দেশ্যে বলবো আপনারা কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য পড়ুন,কিংকর চক্রবর্তী পড়ুন,কবি কান্তিময় ভট্টাচার্য,বেবী সাউ, রত্নদীপা দে ঘোষ,সেলিম মন্ডল,গৌরাঙ্গ মন্ডল,সোনালী মিত্র,গৌরাঙ্গসুন্দর পাত্র,উত্তম দত্ত,স্বপন পাল,পরাণ মণ্ডল,বিদিশা সরকার, প্রমুখ পড়ুন ।এটুকু বলতে পারি হতাশ হবেননা।দেখবেন অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির চেয়ে ইনারা কোনও অংশে কম নন।বরং এদের অনেকেই এরই মধ্যে এমন উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন যাদরে আগামী কুর্নিশ করতে বাধ্য থাকবে।


কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য তেমনই একজন কবি।তিনি কেবল একজন কবি নন,যেনো নিভৃতচারী সচেতন এক যাত্রীক।তাঁর অনায়াস বিচরণ সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন গলি-ঘুঁজিতে।আবার কখনো নিজেকে মেলে ধরেন ইতিহাসের পাতায়।পথে নুড়ি,পাথর,ঝিনুক যা-ই দেখতে পান কুড়িয়ে নেন।এসব তাঁর কাছে সাহিত্যের উপাদান,শিলালিপি।এবং তা তাঁর শৈল্পিক হাতের জাদুস্পর্শে হীরকের মতো ভাস্বর হয়ে ওঠে।কবিতার নির্মাণ,বিষয় এবং নিপুণ ও নিখুঁত উপমা যেকোনো সমঝদার পাঠকেকে চুম্বকের মতো টেনে নেবে কাছে।হয়তো আত্মমগ্ন সৃষ্টিশীল মানুষটি প্রচারবিমুখ বলেই দিনশেষে থেকে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে।কিন্তু প্রতিভার আগুনকে কখনও কি ছাই দিয়ে ঢেকে রাখা যায় ? চন্দনের মতো সুবাস স্বতঃই ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।হয়তো একদিন দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে আছড়ে পড়বে আলোর উৎসার কোনও অজানা অচেনা দেশে।আপাতত আমরা সেই অপেক্ষায় থাকি।বরং আসুন এখন উনার কাব্যের সাথে কিছুটা চেনাজানা হোক।


সুররিয়ালিজম
সঞ্জয় ভট্টাচার্য
#


স্বপনের ভেতরে তোমায় খেয়ে ফেলি
আর সুখ স্নান তুলে রাখি গুপ্ত ড্রয়ারে


ফেরতের দাপট ক্রমে ক্রমে ফিকে হয়ে আসে


খাতা পত্তরের পাশে ডট পেন নড়ে উঠছে ফের
টের পাচ্ছি লিক সারাচ্ছে সাইকেল


চুরি যাওয়া বেল বেজে উঠছে দ্বিতীয় পাড়ায়


দেখুন কবি প্রথম লাইনে বললেন,---


"স্বপনের ভেতর তোমায় খেয়ে ফেলি"


অর্থাত্ প্রথম লাইন থেকে পরিষ্কার কবি একটি স্বপ্ন দেখছিলেন।আমরা সবাই জানি স্বপ্ন অবচেতন মনের খেলা।আমাদের চেতন মনের অনেক কথা,ভাবনা অনেক সময় আমরা প্রকাশ করতে পারিনা,তাই বলে কি আমরা তা ভুলে যাই ? না ভুলি না তা আমাদের অবচেতন মনে থেকে যায়।কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় সেই কথা বা ভাবনা উঠে আসে আমাদের চেতন স্তরে।তখন তাকে আমরা স্বপ্ন বলি।


সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কবি তেমনই একটি স্বপ্ন দেখেছেন যা হয়তো তাঁর অনেক দিনের কাঙ্খিত ও বাঞ্ছিত,কিন্তু কবির বাসনাটি এতোটাই ব্যক্তিগত আমরা বুঝে উঠতে পারছিনা বাসনাটি কি।যা কবি খেয়ে ফেলতেও পিছপা নন।অর্থাৎ এখানে কবির আকাঙ্খা ও স্বপ্ন একাকার।স্বতঃই পাঠক হিসেবে আমাদের তাড়িত করে কবির স্বপ্নের শরিক হতে।


ঠিক পরের লাইনে এসেই কবি যখন বলেন,----


"আর সুখ স্নান তুলে রাখি গুপ্ত ড্রয়ারে"


এখানে এসেও কি আমরা পরিষ্কার হতে পারছি কি ছিলো কবির স্বপ্ন ? তবে বুঝতে না পারলেও এটুকু বোঝা যাচ্ছে বাস্তবতা ও স্বপ্ন মিলে গিয়ে কবি মনে এমন একটা সুখের সংবেদন সৃষ্টি হচ্ছে সেই আনন্দে তিনি সুখ স্নান তুলে রাখছেন "গুপ্ত ড্রয়ারে",
অর্থাত্ মনের মণিকোঠায়।এ সবই কবির স্বগতোক্তি।


কিন্তু বেশিক্ষণ এই সুখ স্থায়ী হয় না,গুপ্ত ড্রয়ারে সঞ্চিত স্বপ্নধন,যা কিনা দুইয়ে দুইয়ে চার ভেবে তুলে রেখেছিলেন আমানত স্বরূপ,তা কেবল স্বপ্নই।যার সঙ্গে বাস্তবের আসমান-জমিন ফারাক।রিটার্ন তিনি কিছুই পান না।তাই হয়তো কবি গভীর হতাশায় পুনরায় স্বগতোক্তির মতো বলে যান,---


"ফেরতের দাপট ক্রমে ক্রমে ফিকে হয়ে আসে"।


লক্ষ্যণীয় এই যে এখানে এসে কবির চেতন স্তর এবং অবচেতন স্তরের ভেতর দ্বান্দ্বিকতা লক্ষ্য করলাম।প্রতিটি আমানত চায় লাভজনক রিটার্ন।যে স্বপ্ন সুখের ভেবে গোপন দেরাজে তুলে রেখেছিলেন তার ফেরতকালিন দাপট বড়োই বিবর্ণ অর্থাত্ ফিকে।


উদাহরণ স্বরূপ বলি,যেমন ধরুন আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন।শত সহস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা প্রতিটি দেশবাসীর সচেতন মনে সঞ্চার করেছে সাম্য,ন্যায়,সুশাসনের স্বপ্ন।আমাদের প্রতিষ্ঠিত জনগণমন সরকার সব নাগরিককে দেবে উপযুক্ত সম্মান । কিন্তু আমরা দেখছি বাস্তবের সঙ্গে আকাঙ্ক্ষার কোনও মিল নেই ।স্বাধীনতার ধারণা সর্বসাধারণের সুখের জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে এখন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতের তাস । হয়তো কবির স্বপ্নও তেমনই কোনও স্বপ্ন ।কিন্তু স্বপ্নঘোর কেটে গেলে কবি বুঝতে পারেন ফেরতের দাপট শূণ্য । সুতরাং যেকোনো সচেতন নাগরিকের হতাশা গ্রাস করা স্বাভাবিক ব্যাপার।এবং এখানে এসে কোথাও কবির সাথে আমরাও একাত্ম বোধ করি।তখন কবির ভাবনা আমি থেকে আমরায় উত্তোরণ হয়ে যায় ।


যদিও কবি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন,তাঁর ভেতরে আছে এক নাছোড় মনোভাব।তাই তিনি খাতা কলম নিয়ে বসে যান।আঁক কাটেন।অঙ্কে কোথাও ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? তাই বারবার,পুনরায় আঁক কাটেন যা কবির কথায় ফের।আসলে কবি জানেন ভুলের রাস্তাও সবসময় খোলা।যে কোনো সিদ্ধান্ত যুক্তি তর্ক ও অনেকগুলো প্যারামিটারের উপর দাঁড়িয়ে থাকে।কবি চান না কোনও ভাবে নিজের ভুল সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে।তাই তিনি সবদিক বারবার নির্ভুল ভাবে খুঁটিয়ে দেখেন।শেষে বুঝতে পারেন,না সিদ্ধান্তে কোথাও ভুল নেই।ওই তো----


"টের পাচ্ছি লিক সারাচ্ছে সাইকেল"


কি করুন পরিণতি ভাবুন!রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বড়ো সাধের স্বাধীনতা,কিংবা গণতন্ত্র যাই বলুন সাইকেলের টিউবের মতো ফুটো হয়ে গেছে।যা তালিতাপ্পি দিয়ে কোনও ভাবে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে,ধুঁকতে ধুঁকতে।সাইকেলের টায়ারের যেমন লিক সারাই করি আবারও কাঁটাফুটে হয় লিক।তেমন আমাদের স্বাধীনতা বহিঃশত্রু ও ভেতরের নানান শত্রুর দ্বারা বারবার হচ্ছে ফুটো।কোনও ভাবেই একে করা যাচ্ছে না ফুটোহীন।


কবি যখন এমন কথা বলেন তখন মনে হয় কবি কেবল তাঁর নিজের কথাই বলছেন না,তিনি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি স্বরূপ সবার মনের কথাই বলে গেলেন। এবং কবির সাথে আমরাও অনুভব করলাম স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা ।যন্ত্রণার মাত্রা আরো বেড়ে যায় যখন শুনি চুরি যাওয়া বেলের আওয়াজ আসছে বেপাড়া থেকে । এই যে সাইকেলের লিক সারানো হচ্ছে বারবার এটা তবুও একটা গঠন মূলক প্রসেস । হয়তো এইরূপ চেষ্টার মধ্যে থাকলে কোনও একদিন আমরা পৌঁছে যেতে পারি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে । কিন্তু বেল চুরি হয়ে গেলে সাইকেল নিয়ে কি রাস্তায় বেরোনো যায় ? তখন সম্পূর্ণ ফতুর বা নিঃস্বই বলা যায় । সত্যি বর্তমান সময় ও সমাজ আমাদের সেদিকেই ইঙ্গিত করে । যেমন বিগত দুশো বছর ব্রিটিশ বেনিয়ারা আমাদের লুণ্ঠন করেছে তেমনই বর্তমান গণতন্ত্ররুপী সাইকেলের বেলও যে বেপাড়ায় বাজছে লুণ্ঠিত হয়ে।সেটাই ভয়ের সবচেয়ে বড়ো কারণ বলেই কবি মনে করেন।


এবার নামকরণের কথায় আসি,
-------------------------------------------
প্রথমেই জানতে ইচ্ছে করে "সুররিয়ালিজম" কি?এমন একটি সাইকোডেলিক এবং হাইপ কবিতার এমন নামকরণ কেন করলেন রচয়িতা কবি?


ইংরেজিতে 'সুররিয়ালিজম'(surrealism) বা বাংলায় 'পরাবাস্তবতা' হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোন মিল নেই।বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণা মিলানো যায় এখানে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের ভাবনা- মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেন- এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্তবতা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে- কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’ এর পরবর্তী আন্দোলন হচ্ছে ‘সুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’। এখন আবার যা জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে।
মার্ক আর্নেস্ট এর সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। সুররিয়েলিজমকে তিনি বলেছেন- সুর রিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে- অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকাও সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সঙ্গে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া।(… to create a super-reality in which real and unreal meditation and action, meet and mingle and dominate the whole life.)


সুতরাং কবির স্বগতোক্তি থেকে বোঝাই যাচ্ছে এখানে কবির স্বপ্নও বাস্তবের মাটিতে এসে ভেঙে চৌচির।স্বপনের ভেতর যা তিনি খেয়ে ছিলেন,'স্বপ্ন স্নান' তুলে রেখেছিলেন 'গুপ্ত ড্রয়ারে' তা বাস্তবে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে।শুধু তাই নয় মেরামতের চেষ্টাও নিষ্ফল হয়ে যাচ্ছে, কারণ সাইকেলের বেলই তো চুরি হয়ে গেছে, যা বাজছে অন্য পাড়ায়।


যেহেতু কবিতার শরীর জুড়ে কবির স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক সেহেতু 'সুররিয়ালিজম' নামকরণ যথার্থ এবং সার্থক বলে মনে করি।


সবশেষে কবির কলমে রইলো অশেষ শ্রদ্ধা এবং প্রিয় কবির প্রতি রইলো অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা ।