কবি দিলীপ কর কেবল একজন কবি নন চলমান সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন বটবৃক্ষ
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
----------------×---------------×--------------×-------
এইদিন,,,, সেইদিন / দিলীপ কর
..................................................
আজকের সকাল আগামী কালের সকালকে
কতটা স্পর্শ করবে জানি না।


আজকের যন্ত্রণা গুলো আগামীর যন্ত্রণাতে
কতটা ছাপ ফেলবে জানি না।


একদিন এইদিন শেষ হবে
এইদিন সবদিন থাকে না
আসে নতুন সকাল, নতুন প্রেমিক ।


হৃদয় মুক্ত হতে চায় যন্ত্রণা থেকে
যন্ত্রণা বিহীন হৃদয়ের কতটুকু উন্নতি?


হাসির মধ্যেও কি থাকে না গভীর বেদনা?
ভালবাসা ও কি হৃদয়ে রাখে না বারুদ?


আগুনে হাত পুড়ে না
বরং স্পর্ধিত হাতে থাকে গনগনে উত্তাপ।


তরঙ্গ ওঠে তরঙ্গ মিলায়ে যায়
রিক্ত শাখা আবার সাজে ফুল সজ্জায়।


বেলা শেষে সূর্য ডোবে
ডুবে যাওয়া ই কি সূর্যের ভবিষ্যৎ?


কে পারে নিশ্চয় করে বোঝাতে যে
ভবিষ্যতের কোনো অতীত বর্তমান নেই ?


যারা আছে প্রতীক্ষার মিছিলে
ছাড়পত্র বুকে সেঁটে
ভবিষ্যতের কানে কানে তারা বলে যাবে
বাপ্,,,,,, তোরা থাক
উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে গেলাম
আমার উজ্জ্বল সকাল গুলো।


বন্ধু প্রতিম অগ্রজ কবি দিলীপ কর শুধু একজন কবি নন,তিনি একজন সচেতন যাত্রিক।তাঁর কলমে মূখ্যত উঠে আসে সমাজ,সমকাল ও দর্শন।তিনি যেখানেই দেখেন অন্যায়-অনাচার-অবিচার সেখানেই তাঁর চোখ আটকে যায়।এড়িয়ে যেতে পারেন না মানুষের সম্পর্কের বাঁধন,তাঁর সুখ-দুঃখ, বেদনা-যন্ত্রনা।কখনো সময়ের হাত ধরে এগোতে গিয়ে অনিশ্চয়তার মেঘ প্রবুদ্ধ কবিকে ঘিরে ধরে।তাই তো কবি মনে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারিত হয়,---


"আজকের সকাল আগামী কালের সকালকে
কতটা স্পর্শ করবে জানি না।


আজকের যন্ত্রণা গুলো আগামীর যন্ত্রণাতে
কতটা ছাপ ফেলবে জানি না।"


মনে হয় সকাল অর্থাত্ সময় যা কালের আবর্তনে বারবার ফিরে ফিরে আসে,এবং সাথে যাপিত যন্ত্রণা সবই বড়ো অনিশ্চিত।এই অনিশ্চয়তাও মহাকালের মতো প্রলম্বিত।যখন কবি এমন কথা বলেন পাঠক হিসেবে প্রিয় কবির সাথে আমরাও একাত্ম হয়ে যাই।যা শুধু কবির ভাবনা নয়, সমগ্রের ভাবনা হয়ে উঠে আসে সচেতন কলমের প্রবুদ্ধ ডগায়,যা মসির কালিতে আঁকা বিষন্ন কথাকলি স্বরূপ।


যদিও কবি হতাশ নন,তাঁর বিশ্বাস---


"একদিন এইদিন শেষ হবে
এইদিন সবদিন থাকে না
আসে নতুন সকাল,নতুন প্রেমিক ।"


বিশ্বাস তো আর এমনি এমনি গড়ে ওঠে না,
তার জন্যে প্রয়োজন যথোপযুক্ত নজির প্রমাণ স্বরূপ। দিন বদলের ইতিহাসই হয়ে ওঠে কবির বিশ্বাসের সেই উপাদান।সাথে দিন বদলের অনিবার্য নিয়ম সাথী হয়ে যায় প্রিয় কবির।অবশ্য তা যেমন ভালোও হতে পারে তেমনই খারাপের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।কিন্তু কোথাও যেনো মনে হলো কবি খারাপের পক্ষপাতী নন।তাঁর আশাবাদী মন যে সকাল,যে প্রেমিকের প্রত্যাশী তা নতুন ও অবশ্যই শুভদায়ক।হয়তো মানুষ আশাবাদী বলেই এমন ভাবতে পারেন । তাছাড়া কবি তাঁর গভীর বিক্ষায় জানেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যন্ত্রণা থেকে মুক্তির লড়াই।তাই তো কবির ঋদ্ধ কলমে উঠে আসে সেই অমোঘ উচ্চারণ ---


"হৃদয় মুক্ত হতে চায় যন্ত্রণা থেকে
যন্ত্রণা বিহীন হৃদয়ের কতটুকু উন্নতি?"


এই যে যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে চাওয়ার লড়াই তা তো উন্নতির সূচক।মানব ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকে এই যন্ত্রণাকে বহন করেই তো সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে উৎকর্ষের সোপানে।আমার সবাই জানি প্রচলিত প্রবাদ "Necessity is the father of invention".সুতরাং যন্ত্রণা থাক,কিন্তু তা যেনো উন্নতিকে তরান্বিত করে।তাছাড়া হৃদয়ও সমৃদ্ধ হয়না যন্ত্রণার অনুভূতি ছাড়া ।


এইভাবে একদিকে যন্ত্রণাকে বরণ ও  যন্ত্রণা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যা হয়ে ওঠে মানুষের সহজাত ও দৈনন্দিন রোজনামচা।


শুধু তাই নয়,তিনি গভীর পর্যবক্ষেণে বোঝেন যন্ত্রণার মতো তার যাপন ছুঁয়ে থাকে সুখ।যে সুখের প্রতিফলন দেখি মুখে।কালে কালে এই মহাজীবনই হয়ে ওঠে হাসি-কান্নার জীবন্ত দলিল।


"হাসির মধ্যেও কি থাকে না গভীর বেদনা?
ভালবাসা ও কি হৃদয়ে রাখে না বারুদ?


যদিও সব হাসি হাসি নয়,মুখোশের আড়ালে থাকে গভীর বেদনা হতাশা।সেই বেদনা হতাশা থেকে পথ খুঁজতে গিয়ে দেখেন ----


"আগুনে হাত পুড়ে না
বরং স্পর্ধিত হাতে থাকে গনগনে উত্তাপ।


তরঙ্গ ওঠে তরঙ্গ মিলায়ে যায়
রিক্ত শাখা আবার সাজে ফুল সজ্জায়।"


পরিক্রমণ পথে নানান উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে।যার মূল উপাদান আগুন।সভ্যতাও অন্ধকার এই একটুকরো আগুনের অভাবে।সেই আগুনের আঁচে যতোটা না হাত পোড়ে, (বরং পোড়েই না) যা হয়ে ওঠে ক্ষুধা নিবৃত্তির সহায়ক। তারচে স্পর্ধিত হাতে ঢের বেশি পোড়াই জীর্ণসংস্কার।দিন শেষে সেই তরঙ্গও বেলাভূমিতে বিলিন হয়।এবং শাখায় শাখায় যেটুকু রিক্ততা শূন্যতা তা ভরে ওঠে ফুলে ফলে।


কবি কিছু ভুল দেখেননি।প্রকৃত জীবন পরিক্রমা তো এমনই।হয়তো প্রকৃতি কিছুই নেয় না,আবার ফিরিয়েও দেয় না।তরঙ্গ ও আগুন শুধুই রূপান্তরিত হয় এক দেহ থেকে আর এক দেহে,এক জীবন থেকে আর এক জীবনে।আমাদের ফিরে যেতে হয় শঙ্করাচার্যের কাছে আশঙ্কাবিহীন,রামানুজের পদতলে বসে খুঁজি আমাদেরই প্রকৃত আয়না । "ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা"।জাগতিক জীবনের সুখ-দুঃখ,হাসি- কান্না সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় বধ্যভূমিতে। স্মরণে আসে বেদ, উপনিষদ ও শ্রীমৎভগবতগীতার পুণ্যশ্লোক।কাজলাদিদির দেখা চাঁদ আমিও দেখি সেই একই আত্মায়। আত্মা অবিনশ্বর।তার জরা নেই,খরা নেই কিন্তু খরতাপ আছে।আমার অর্জিত ধন দিয়ে যাই আমারই আত্মাকে, অপত্যের হাতে।সুতরাং 'আত্মানাং বৃদ্ধি'।কবি তাই তাঁর গভীর বিক্ষা থেকে হৃদয়রস নিঙড়ে তুলে আনেন মাঠা। বলেন---


"বেলা শেষে সূর্য ডোবে
ডুবে যাওয়া ই কি সূর্যের ভবিষ্যৎ?


কে পারে নিশ্চয় করে বোঝাতে যে
ভবিষ্যতের কোনো অতীত বর্তমান নেই ?


বেলা শেষে ডুবুক না সূর্য,তাতে কি এসে যায়।আগামী ভোরে সেই তো ফিরে ফিরে আসে আর এক রোদ ঝলমলে সকালের মতো নব নব রূপে।বাস্তব জীবনে সন্তানের মধ্যেই তো সেই সূর্যের প্রকাশ বিকাশ।কোনো এক কিষান রমণীর আদুরে বুকে নাড়ুগোপাল হয়েই তো তার যতো হাসি-কান্না ও দেয়ালা।যেমন আলাপী হাওয়ায় ফোটে স্নিগ্ধ শতদল।


অতএব নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারি না আগামীর ভবিতব্য নেই,নেই জেগে অতীত অতল ও অধুনাতন পুণ্যসলিলার জাগ্রত বাসরে একাকী কোজাগরী চাঁদ।


সুতরাং যারা আছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার মিছিলে
ছাড়পত্র বুকে সেঁটে হতাশ না হয়ে তাদের উচিত ভবিষ্যতের কানে কানে বলে যাওয়া, 'নে নরেন,আমার সমস্ত স্থাবর- অস্থাবর,চিন্তন মনন'।ফতুরও ফতুর নয় ফতুরেই প্রাণ।যেনো ডুবন্ত সূর্যের মুখেই ফুটবে আগামী সকাল।মানুষ তো মরে না,দেহান্তরই হলো প্রকৃতির প্রকৃত বিধান।


অতএব আসুন এবার আমরাও কবির সাথে সাথে বলি,----


"বাপ্,,,,,, তোরা থাক
উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে গেলাম
আমার উজ্জ্বল সকাল গুলো।"


হাঁঁ,এ সকাল সত্যিই ম্যাড়মেড়ে নয়,বরং উজ্জ্বল অতীতের মতো। "এইদিন,,,, সেইদিন"ই তো নয়ই।যার পুুুুরোটাই পুনরাবৃত্তির পরস্পরা।এই বাঁশি সেই একই কৃষ্ণের মোহনবাঁঁশি,বরং কবির ভাবনায় একাত্ম হয়ে বলি এই বাঁশিই হবে আগামী মোহনা। এই মহোৎসবই আগামীর মহাপ্রসাদের আতুড়,পাকগৃহ।বাঁশের গল্প কবি নাইবা করলেন ।কিন্তু বুুুঝে নিতে অসুুবিধা হয়না বর্তমানের কংস কারা,আর কারাই বা অধুুুুনা কংসারী।হয়তো যতোদিন পৃথিবী থাকবে আমরাও বাঁধা থাকবো এক আত্মা থেকে আর এক আত্মার পরম্পরায়।বিজ্ঞানের ভাষায় তাকেই তো বলছি Alternation of Generation.  


এ এক গভীর জীবন পরিক্রমা। যার পরতে পরতে নশ্বরতার ইঙ্গিত । কিন্তু নশ্বরতার গভীরে কবি মনে উঁকি দেয় আর এক গভীর প্রশ্ন বাপ তোরা উজ্জ্বল সকালগুলো নে,তবে নশ্বরতাই কি শেষ কথা ?যদি তাই হতো তবে কি কবি মনের গভীরে উঁকি দিতো আগামী সকালের ভাবনা ? এই দার্শনিক প্রশ্নের আড়ালে বেজে ওঠে সৃষ্টির সুর।যে সুর কৃষ্ণের সেই বিখ্যাত বংশীধ্বনীর মতো মধুর মধুর । কিন্তু এটাও ঠিক এই জগত শাশ্বত নয়,সুতরাং মৃত্যুকে মেনে নিয়ে বলি বাপ নে আমার যা কিছু গচ্ছিত সেবধি,স্থাবর ও অস্থাবর সব।এই যে ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত এই জীবন তা কিন্তু মায়া স্বরূপ ছুঁয়ে যায় স্নেহ ভালোবাসার পবিত্র হাত।"বাপ্,,,,,, তোরা থাক"এই বাক্যবন্ধটির মধ্য দিয়ে কবিতাটি যেমন জীবন্ত হয়ে ওঠছে তেমনই ঝরে পড়ছে কাব্য লালিমা ও লালিত্য।


ভারি সুন্দর কবিতা তেমনই যথার্থ নামকরণ।এমন একটি চমত্কার কবিতা   উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।ভালো থাকুন সবসময় ।এবং এমনই অপূর্ব কাব্যের ডালি উপহার দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করুন বারবার প্রতিবার ও প্রতিটি দিন ।