স্বল্প দৈর্ঘ্য চিত্রনাট্য
কবি---জাহিদ হোসেন রণজু
আলোচক---রণজিৎ মাইতি
-------------------------------------
বিযুক্ত হয়েই
মুরগীটা গা ঝাড়া দিয়েই---- দে ছুট্;
মোরগটা অচেনা এখন


ঝুঁটিওয়ালা মোরগটাও তাই----একই;
পাল তুলে দিয়ে নতুন বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা


স্বল্প দৈর্ঘ্য চিত্রনাট্য;


'সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা'


এখন প্রেমিক ও প্রেমিকা;সময় ও নদীর স্রোত
----   ----   ----   ----   -----   ----  
জীবনে অনুষঙ্গের গুরুত্ব অপরিসীম।অচেনা অজানা স্থান,কাল ও পাত্র চিনতে জানতে প্রায়শই আমরা এর প্রয়োগ করি। ধরুন বিশাল গ্রাম,আপনি রামের বাড়ি যাবেন কিন্তু চেনেন না বাড়িটি।একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললো,-- ওই তো ওদের গ্রামে যে শিব মন্দিরটি আছে তারই এক্কেবারে কাছের দোতলা বাড়িটি।যেহেতু শিব মন্দিরটি আগে থেকেই চেনা,সুতরাং রামকে খুঁজে পেতে আপনার অসুবিধা হয়না।অর্থাত্ চেনা বিষয় থেকে অচেনা বিষয় সম্পর্কে জানতে পারছেন।এই ভাবে অনুষঙ্গের প্রয়োগে আমরা চেনাজানা বিষয় থেকে অজানা বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি।যুক্তিবিদ্যায় এর প্রয়োগ অনস্বীকার্য।পুরো বীজগণিত তথা ব্রহ্মাণ্ডটাই ঘুরছে যুক্তিবিদ্যা নির্ভর।ধরুন a=b,b=c,c=d হলে বলা যায় a=d,a=c,b=d। শক্তিমান কবি জাহিদ হোসেন রণজু তাঁর রচিত 'স্বল্প দৈর্ঘ্য চিত্রনাট্য' কবিতার মধ্য দিয়ে এক চিত্রনাট্য থেকে আর এক চিত্রনাট্য এঁকে দিলেন আমাদের মনে।আমরাও ডুবে গেলাম পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নেপথ্য চিত্রনাট্যের ভাবসাগরে।


কি সেই চিত্রনাট্য যা স্বল্প দৈর্ঘ্য হলেও দর্শক মনে বৃহত্তর ছাপ রেখে যায়!ইংরেজিতে যা শর্টফিল্ম বাংলাতে তাই তো স্বল্প দৈর্ঘ্য চিত্রনাট্য।শুরুতেই চিত্র পরিচালক কবি বললেন,"বিযুক্ত হয়েই" অর্থাত্ পর্দার আড়ালে থাকা যে ব্যক্তির গল্পটি পরিচালক বলতে চাচ্ছেন তিনি আগে কোনও না কোনও কারণে অপর একজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলো।প্রশ্ন আসে কি সেই গল্প? কে কার সাথে যুক্ত ছিলো ? কি কারণে যুক্ত ছিলো?এখন কেনই বা বিযুক্ত হলো?চিত্রনাট্যের শুরুতে দর্শক মনে উথ্বিত এই প্রশ্নগুলোই তাঁকে সম্পূর্ণ শর্টফিল্মটির গভীরে যেতে উৎসাহিত করে।এখানেই চিত্রপরিচালকের অনন্যতা।শুরুতেই কি হয়,কি হয়!টানটান উত্তেজনার মধ্যেই উত্তর মিলে যায় ছায়চিত্রের ঠিক পরবর্তী অংশে এসে।এবং অঙ্কিত চিত্র এতোটাই বাস্তব থেকে উঠে আসা দেখতে দেখতে সম্পূর্ণ চলমান চিত্রনাট্যটাই মনে স্থায়ী দাগ রেখে যায় স্থিরচিত্র রূপে।সুতরাং আসুন আগ্রহী দর্শক হিসেবে রুপালি পর্দায় চোখ রাখি।


"বিযুক্ত হয়েই
মুরগিটা গা ঝাড়া দিয়েই---- দে ছুট্;
মোরগটা অচেনা এখন"


না,এই পর্যন্ত এসেও চিত্র পরিচালক দর্শকদের একবারের জন্যেও বিরতিতে(ইন্টারভেল) যাওয়ার সুযোগ দেননি।কারণ ক্লাইম্যাক্স তখনও বাকি।তখনও প্রশ্নের ভীড়।বিয়োগ ব্যথা বুকে নিয়ে মোরগটা কি করলো ?সে কি গভীর দুঃখে বনবাসী হলো?নাকি সব শেষে হলো শরৎবাবুর দেবদাস?কিংবা আদৌ কি মোরগটা ব্যথা পেয়েছিলো?যদি বিচ্ছেদ জনিত কারণে ব্যথা পায় তবে তো বলতেই হয়,'আহা রে গোবেচারা মোরগ'।কিন্তু বিরতির সুযোগটুকু না দিয়ে কবি তাঁর নিজের চোখে দেখা চিত্রনাট্য হুবহু মেলে ধরলেন দর্শকদের সামনে।যা দেখে দর্শক অবাক হলেও মেনে নিলেন বাস্তব।


"ঝুঁটিওয়ালা মোরগটাও তাই----একই
পাল তুলে দিয়ে নতুন বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা"


আসলে চিত্র পরিচালক জানেন কোথায় কতোটুকু বিরতি দরকার।ছবি যখন চুড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই সময় ইন্টারভেল মানেই রসচ্যুতি।তাই সম্পূর্ণ রস বজায় রেখে শেষ করলেন নায়ক মোরগ ও নায়িকা মুরগির বিয়োগান্তক প্রেমের উপাখ্যান।যদিও কবি কখনও বলেননি যোগ বিয়োগের খেলাটি ছিলো শরীরী প্রেমের উপাখ্যান।কিন্তু দর্শক হিসেবে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না,কারণ আমাদের চলমান জীবনে দৈনন্দিন এমন চিত্র আমরা প্রায়শই দেখি চোখের সামনে।কোনও সন্দেহ নেই পাখিদের রতিক্রিয়ার নিখুঁত নিপুণ চিত্র মেলে ধরেছেন চিত্রনির্মাতা তাঁর "স্বল্প দৈর্ঘ্য চিত্রনাট্যে"।


এখন দর্শকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে প্রাত্যহিক দেখা এমন সাধারণ চিত্রনাট্যে অসাধারণ তো কিছুই নেই,তবে এতো ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে লোক টেনে আনার কি দরকার ছিলো!সবটাই কি তবে ব্যবসায়ী পলিসি,কর্পোরেট কায়দা?প্রোডাক্ট বিক্রির ফিকির?পরিচালক জানেন গল্পের আড়ালে আদিরস,যা দর্শককে সবচেয়ে বেশি টানে।সেটাই তিনি করলেন সুকৌশলে।নামকরণটাও যেভাবে হাইলাইটস করা হয়েছে দর্শক হিসেবে মনে হতেই পারে মোরগ-মুরগীর রতিমিলন ছাড়া কিছুই তো নেই এই চলচ্চিত্রে।তাছাড়া ছবিটি প্রদর্শন করার পর পরই পরিচালক আবারও মনে করিয়ে দিলেন "স্বল্প দৈর্ঘ্য চিত্রনাট্য"।মানে এটুকুই চিত্রনাট্য,এবং এখানেই শেষ।যে চিত্রনাট্যের ক্লাইম্যাক্সে আদিরসের আবহ ও যবনিকায় চিরন্তন বিচ্ছেদের সুর।পরিষ্কার দেখলাম ঝুঁটিওয়ালা মোরগটাও পাল তুলে দিয়ে নতুন বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে।সুতরাং আগামীতে নায়ক-নায়িকা পুনরায় কখনও মিলিত হবে সে আশাও ক্ষীণ।বরং বিচ্ছেদের আবহে নাটকের সমাপ্তি।


দর্শক হিসেবে নিশ্চয়ই আপনি খুব রেগে যাবেন,পয়সা উসুল করে নিতে চাইবেন পর্দায় জুতো ছুঁড়ে।না,হয়তো দক্ষ পরিচালক সেই অবকাশ দিতে চাননি,তাই ঘুরিয়ে দিলেন মুভির অভিমুখ।তখনই সাদা পর্দায় ভেসে উঠলো বহুল প্রচলিত এবং শাশ্বত একটি প্রবাদ,
"সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা"।  
আর ঠিক তখনই দর্শক অবাক হয়ে দেখলো অনুচিত্রটি আর অনুচিত্র থাকছেনা,বরং সময়ের চিরন্তন স্রোত বেয়ে হয়ে উঠছে বৃহত্তর মুভি।ফিরে যেতে হচ্ছে একবার উৎসে পরক্ষণে বর্তমানে।সেখান থেকেই উঠে আসছে অনাগত আগামী সম্পর্কে গভীর শঙ্কা।আকাশ ঢেকে যাচ্ছে বজ্রগর্ভ মেঘে।যার কেন্দ্র বিন্দুতে সমাজ সংসার,যা শারীরিক প্রেম সম্পর্কিত কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে দর্শকদের। ঠিক তখনই মোরগ- মুরগিরও নিছক মোরগ-মুরগী থাকছে না,তাদের জায়গা নিচ্ছে আধুনিক মানব- মানবী।অর্থাত্ আজকের রোমিও জুলিয়েট।প্রেমিক-প্রেমিকার অবয়বে মোরগ-মুরগি হয়ে ওঠছে বর্তমান সমাজ ও সময়ের প্রতিভূ।সনাতন যে সমাজ একদিন শাঁখা-সিঁদুর ও মালাবদলের মধ্য দিয়ে স্বামী স্ত্রী রূপে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌন জীবনের ছাড়পত্র পেতো,তাদের কাছে যৌনতা এখন জলভাত।ঠিক যেমন মানুষ চা খেয়ে ছুঁড়ে ফেলে মাটির খুরি,ঠিক সেভাবেই মুরগিরটা বিযুক্ত হয়েই গা ঝাড়া দিয়েই দে ছুট্,আর মোরগটা নতুন বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে!


এখন ভাবতে হয় দায়িত্বহীন অবাধ যৌনতা উচিত কি উচিত নয়।এবং যারা ঔচিত্যের সমর্থক তাদের কাছে নিরুচ্চারে কিছু প্রশ্ন রেখে যান দক্ষ চিত্রনির্মাতা।দায়িত্বহীন অবাধ যৌনতার ফলস্বরূপ আগত অবৈধ সন্তানদের তবে কি হবে?কে হবেন তাদের মা-বাবা মানে অভিভাবক?না কি কোনও কূল কিনারা না পেয়ে শেষে একা নায়িকা গোপনে দাঁড়াবে নার্সিং হোমের অন্ধকার দরজায়,কিংবা এসেই যখন গেছিস তবে থাক কোনও অনাথ আশ্রমে!


ছায়াছবির এই পর্যন্ত এসে মনে হলো এখন চিত্রপরিচালক নিছক চিত্র নির্মাতা নন,সিফ্ট করলেন কবিত্বে।দেখলেন যৌনতা সময় ও নদীর স্রোতের মতো এগিয়ে যাচ্ছে স্রোতের অনুকূলে।আসলে কবিও আমাদের মতো এই চিত্রনাট্যের দর্শক মাত্র।তিনি দেখেন,কিন্তু কিছুই করতে পারেন না।তবে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে রেখে যান অব্যক্ত প্রশ্ন।শেষে যে প্রশ্নগুলো আপামরের হয়ে যায় । এখানেই চিত্র পরিচালক হিসেবে কবির সার্থকতা।যা একজন প্রকৃত কবির কাজ।


শুরুতে মোরগ-মুরগির রতিদৃশ্য আসলে সমগ্র চিত্রনাট্যের একটি অনুসঙ্গ মাত্র।যা ছায়াছবির আবহ নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও আসল ভুমিকা নিয়েছে সময় ও সময়ের স্রোত।যার অন্তরালে সময়ই হয়ে উঠছে ছবির মুখ্য চরিত্র,অর্থাত্ নায়ক।আক্ষেপের সুরে কবি বলেও ফেললেন সেই কথা অবলীলায়,---
এখন প্রেমিক-প্রেমিকা;সময় ও নদীর স্রোত"
সময় নায়ক হলে,নায়িকা অবশ্যই স্রোতবতী নদী।যে সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেদিনের সনাতন কুললক্ষ্মীরাও আজ ভেসে যাচ্ছে নায়ক সময়ের প্রলোভনে।


কোন সন্দেহ নেই কবিতাটি এক কথায় অসাধারণ।প্রকৃতি থেকে নেওয়া এক বিশেষ চিত্ররূপময়তা কবিতাটির প্রাণ হলেও চিত্ররূপের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা মনন কবিতাটির প্রকৃত আত্মার সন্ধান দেয়।সুতরাং যেমন নামকরণ তেমনই কবিতার বিন্যাস।তবে পাঠক হিসেবে মনে হলো--- "বিযুক্ত হয়েই
মুরগিটা গা ঝাড়া দিয়েই---- দে ছুট্;"


উপরোক্ত লাইন দুটি আসলে একটি বাক্য।একই বাক্যে দুটি ("হয়েই,দিয়েই") শব্দের শেষ বর্ণ 'ই'।যেকোনো ক্রিয়া পদের শেষে 'ই' দিয়ে আমরা ক্রিয়া পদের অতিসক্রিয়তা বোঝাই।এখানে কবি 'হয়েই' মানে বোঝাতে চেয়েছেন বিযুক্ত হওয়া মাত্র,আর 'দিয়েই' মানে এখানে গা ঝাড়া দেওয়া মাত্র বোঝাতে চেয়েছেন।সুতরাং অর্থগত ও ব্যাকরণগত কোনও ভুল না থাকলেও মনে হলো পাঠ কালে আটকে যাচ্ছে,হারাচ্ছে পাঠের গতি।তাই আমার মনে হয়,---


"বিযুক্ত হয়েই
মুরগিটা গা ঝাড়া দিয়ে--- দে ছুট্;"
অথবা
"বিযুক্ত হয়ে
মুরগিটা গা ঝাড়া দিয়েই---- দে ছুট্"


এমন হলে ভালো হতো।তবে আমার ব্যক্তিগত সমর্থন প্রথম বাক্যটিতে।কারণ এখানে দিয়ে শব্দটার শেষে 'ই' না লিখলেও "দিয়েই" বোঝাচ্ছে।যা কবি বলতে চেয়েছেন।কেবল 'ই'টি এখানে উহ্য থেকে যাচ্ছে ।অবশ্য এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভাবনা।আগেও বলেছি,এখনও বলছি ব্যকরণগত ভুল নেই।কেবল পাঠকালিন গতি রোধ হচ্ছে।তাই কবিও ভেবে দেখতে পারেন।


কবিতাটি নিঃসন্দেহে নিটোল ও নিখুঁত নির্মাণ।এমন একটি রসোত্তীর্ণ ও অপূর্বসুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে একরাশ শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।আগামীতে কবির কলম আরও আরও শানিত হোক এই কামনা করি।