কী আসে যায়!
কবি-পল্লব আশফাক
আলোচক-রণজিৎ মাইতি
----------------
শুনেছি কৃষ্ণের বাঁশির সুরে রাধা বিভোর হতেন এবং ছুটে আসতেন সখা কৃষ্ণের কাছে।এই যে ছুটে আসা তা কি শুধুই বাঁশির সুরের কারনে ? নাকি রাধা বাঁশি ছাড়া অন্য কোনো যন্ত্রের সুর ভালোবাসতো না তাই। যদি তাই হতো তাহলে যে কেউ বাঁশি বাজালেই রাধিকা তার কাছে ছুটে যেতো । তেমন হয়েছে বলে কখনও শুনিনি । আসলে কৃষ্ণের বাঁশি বাজানোর দক্ষতায় যে নান্দনিক সুর ছড়িয়ে পড়তো সেই সুরই রাধাকে পাগল করে দিতো।


কোনও কোনও কবিতাও তেমন । পড়তে মন না চাইলেও প্রথম লাইনটির আকর্ষণ ক্ষমতাই পাঠককে দিয়ে জোর করে পড়িয়ে নেই শেষ অবধি ।শ্রদ্ধেয় কবি পল্লব আশফাকের "কি আসে যায় !" তেমনই একটি কবিতা । যা আমার মতো আনাড়ি পাঠককেও জোর করে পড়িয়ে নিলো।


কি আছে কবিতাটিতে এবার দেখে নেওয়া যাক । তবে কবিতাটিতে ঢোকার আগে মনে হয় পটভূমি জানার দরকার আছে । কোন পরিস্থিতিতে কবি রচনা করলেন এমন কবিতা ।আসলে কবির আজ জন্মদিন ।সম্ভবত অভিনন্দনের বন্যায় ভাসতে ভাসতে কবির মনে হয়েছে আবার এসব কেনো ! আর পাঁচটা দিনের মতো জন্মদিনও তো আর একটা দিন। এমন তো নয় হঠাত্ দুম করে বছরের কোনও একদিন এসে গেলো জন্মদিন।কবি এমন দর্শনে বিশ্বাসী বলেই তাই তিনি বলতে পারলেন,---


"একটি দিনে কি বা আসে যায়!
বছর ঘুরে একটি করে
প্রতিদিনই যে দিন ঝরে
এ দিন কি আর বেশি বলো তাদের তুলনায়?


দেখুন উপরোক্ত চারটি লাইনই কবির বিবৃতি,যে চারটি লাইন থেকে ফুটে উঠেছে সময় দিন মাস বছর সম্বন্ধে কবির নিজস্ব জীবন দর্শন। যা তিনি বলেও ফেললেন স্বতস্ফূর্ত । আসলে কবি জন্মদিনটিকে বিশেষ দিন হিসেবে দেখার পক্ষপাতী নন।কারণ প্রতি ক্ষণে ক্ষণে এই বিপুলা পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ জন্ম নিচ্ছে । যদি জন্মক্ষণ সত্যিই শুভক্ষণ হয় তবে প্রতিটি ক্ষণই শুভ। সেখানে ব্যক্তি আমার একটা দিনকে বিশেষ ভাবে দেখার প্রয়োজন আছে কি ? এবং প্রতিদিনই জীবন থেকে এভাবেই একটা একটা করে দিন ঝরে যায় ।সেদিক থেকে তুলনা করে কবির মনে হয়েছে মহাকালের গর্ভে বছর মাস দিন ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড নিয়ে আদিখ্যেতা বড়োই মূল্যহীন ।এবং এই সময়ের স্রোত ও তার নিত্যতা বোঝাতে গিয়ে কবি বললেন,----


"এমন তো নয় বছর শেষে  
হঠাৎ করে আজকে এসে
চুল পেকেছে,কিংবা বলি চোখের কিনারায়!"


কবি বাস্তব থেকে সরে যেতে চান না,বরং ছুঁয়ে থাকেন মাটি। মেনে নেন জন্ম-মৃত্যুর অমোঘ সত্যতা।তাই নির্দ্বিধায় জানিয়ে যান, এই যে পলিতকেশ এবং বলিরেখা ফুটে উঠেছে চোখের কিনারায় তা একদিনে হয়নি।অনেক বসন্ত বিদায়ের ফল মানুষের জরা।হঠাত্ পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে কবি বিস্মিত হন সময়ের এই গতি জাড্যে। যখন কবি এমন কথা বলেন তখন আমরাও পৌঁছে যাই সময় নামক কু ঝিক ঝিক এর সামনে।উফঃ যেনো বুলেট ট্রেন!এই সেদিনের শৈশব আজ বন্দী হয়েছে মহাকালের গ্রাসে। তবে কিই বা প্রয়োজন একটা দিনের এমন মুর্চ্ছনা শোনার ।


এভাবে জীবন সংগীত শোনাতে শোনাতে শেষে যেনো কবি একেবারে শমে চলে গেলেন!শুনতে ভয়ংকর মনে হলেও মুখ থেকে স্বতস্ফূর্ত উঠে এলো অমৃতবানী । যাহা সত্য,তাহাই সুন্দর।আর যাহা সুন্দর, তাহাই অমৃত । মৃত্যু মানেই কি নয় অমৃতলোকে যাত্রা? কবি বললেন,---


"যেদিন থেকেই হোক না শুরু
প্রতিদিনই হচ্ছি বুড়ো
প্রতিদিনই একটু আরো যাচ্ছি ঠিকানায়।
একটা দিনে কি বা আসে যায়! "


যখন কবি এমন করে বলেন তখন আমরাও কোথাও যেনো শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে যাই।বড়ো একা মনে হয়,ছুঁয়ে যায় নিঃসঙ্গতার কালা পাহাড় । ভেঙে পড়ে আমাদের সমস্ত বৈভব।সমাজ,সম্পর্ক ও সভ্যতার সেতু দুলতে থাকে । যেকোনো সময় ভেঙে যাবে  এবং হবে সলিল সমাধি।কবির কথায় সেটাই আমাদের শেষ ঠিকানা,যেদিকে আমরা প্রতিটি সেকেন্ডে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি । এবং যেহেতু এটাই জীবনের চরম সত্য তাই কবি সহজেই বলতে পারেন একটা দিনে কি বা আসে যায় ।


কবিতাটি এমনই পাঠ করতে গিয়ে কোথায় যেনো আমরাও হারিয়ে যাই।নিটোল ও নিখুঁত কবিতা । সহজ সরল শব্দ চয়ন,চমত্কার ছন্দ ও বিষয় ভাবনা এবং সাবলীল গতি এই কবিতাটির প্রাণ। নামকরণ নিয়েও বিশেষ কিছু বলার নেই,শুধু বলি যথার্থ নামকরণ । এমন একটি মনোগ্রাহী কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে শুভ জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।


পরিশেষে একটা কথাই বলবো,প্রিয় কবি প্রাণ খুলে লিখুন,আপনার ঠিকানা খোঁজার ভার আমাদের মতো আনাড়ি পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে আপনি নিশ্চিত থাকুন ।আবারও শুভেচ্ছা অজস্র ।