আলোচনা--ফুল
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
কবি--মোঃ আসাদুজ্জামান আসাদ
------------------------------
কিছু কথা থাকে যে কথাগুলো আক্ষরিক অর্থ অতিক্রম করে ভিন্ন আর একটি অর্থ প্রকাশ করে । তখন সেই কথা আর পাঁচটা সাধারণ কথার মতো কথা থাকে না,কথা হয়ে ওঠে কথকতা।আর সেই কথকতা যখন পাঠক হৃদয়ে বিশেষ ব্যঞ্জনা কিংবা বিশেষ সংবেদন সৃষ্টি করে তখন সেটি হয়ে ওঠে কবিতা।তখন পাঠক হিসেবে আমরাও অনুধাবন করি কবিতার সৌন্দর্য,রূপ রস রঙ,শব্দ স্পর্শ গন্ধ ।


তেমনই একটি কবিতা উপহার দিলেন আসর প্রিয় কবি মোঃ আসাদুজ্জামান আসাদ ।আসুন আমরাও কবির কথকতার মধ্য থেকে খুঁজে নিই কাব্যদ্যোতনা,কাব্য সৌন্দর্য।


আপাত সহজ সরল সাবলীল কথা কিভাবে হয়ে উঠেছে কাব্য,'ফুল' কবিতাটি তারই অনন্য নজির।কবিতার শরীর জুড়ে ছোট্ট একটি অনুগল্প,কিন্তু সেই গল্প যখন শেষ হলো ঠিক তখনই পাঠক মনে শুরু হলো ভিন্ন আর এক গল্প।যে গল্পের চোরাস্রোত বইতে থাকে ভেতরে ভেতরে অনন্ত ফল্গুর মতো।যা কবি কোথাও স্পষ্ট করে বলেননি ভারিক্কি কথায়।অথচ বক্তব্য নির্ভর কবিতার সেটাই কিন্তু মূখ্য বক্তব্য ।


কবির কাছে একজন ফুল চাইলো,কবি তাকে ফুলের বদলে দিলেন সেই ফুলের একটি ছোট্ট চারা।কবি নিজেই জানালেন সে কথা।


"আমার কাছে ফুল চাইলো
আমি তাকে চারা এনে দিলাম"


আপাত ভাবে মনে হতে পারে এ আসলে কবির ভ্রান্তি,কেউ আর এক ধাপ এগিয়ে বলতে পারেন এটা আসলে উন্মাদের কাজ। ফুল চাইলে কেউ কি চারাগাছ দেন ? কিংবা আম চাইলে আমলকি ? অথবা জল চাইলে জলপাই ? বড়জোর দেওয়ার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছা না থাকলে বলতেই পারতেন তাঁর অপারঙ্গমতার কথা।


না,কবি এসবের কিছুই করলেন না বরং পুনরায় ফুল চাইলে তিনি করলেন আর এক মহা ভুল ! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কবি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানালেনও সে কথা।বললেন ওহে বৎস,ফুলের চিন্তা ছেড়ে আমার দেওয়া চারা গাছের গোড়ায় ঢালো পরিমিত পানি।


"সে আমার কাছে আবারও ফুল চাইলো
আমি চারায় পানি দিতে বললাম" ।।


এবার বলুন এমন মানুষকে কি বদ্ধ উন্মাদ বলতে পারিনা আমরা ? না,পারিনা।কারণ যেখানে কবির গল্পের শেষ সেখান থেকেই আসল গল্পের শুরু।যে গল্প মানুষকে শিক্ষা দেয় তাঁর কাঙ্ক্ষিত বস্তু উৎপাদনের।তাই কবি সরাসরি ফুল না দিয়ে দিলেন চারাগাছ।চারাগাছ হচ্ছে সম্ভাবনার উৎস।পর্যাপ্ত জল হাওয়া অর্থাত্ উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে আজকের চারাগাছ আগামীতে দেবে অজস্র ফুল ফল। তাই দ্বিতীয়বার যখন ঐ ব্যক্তি আবারও ফুল চাইলেন,কবি চারাগাছের গোড়ায় জল দেওয়ার পরামর্শ দিলেন।


সুতরাং এককথায় বলা যায় কবি পাগল তো নয়ই,বরং চেতনাঋদ্ধ একজন আধুনিক মানুষ।কোনও মানুষ বিনা শ্রমে যখনই তাঁর কাঙ্ক্ষিত বস্তু হাতের নাগালে পেয়ে যান,তখন বস্তুটি সহজলভ্য ভেবে মূল্য তো দেনইনা বরং তিনি নিজে দিনে দিনে অলস হয়ে যান।কবি এটা মোটেই পছন্দ করেন না । তিনি জানেন অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা ।তাই তিনি ফুলের বদলে হাতে তুলে দিয়েছিলেন চারাগাছ । পক্ষান্তরে গোড়ায় জল দেওয়ার সুপরামর্শ ।


সংবেদনশীল কবি খুব ভালোই বোঝেন কর্ম বিমুখতা একটা গোটা জাতি কিংবা দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।তাই কবি তাঁর অর্জিত জ্ঞান খুব সুক্ষভাবে গল্পের ছলে আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করলেন । এখানেই রচয়িতা কবি তথা কাব্যের স্বার্থকতা।


সহজ সরল সাবলীল মাত্র চারটি লাইন,কিন্তু কি অসাধারণ ব্যপ্তি।কথায় বলে না সহজ কথা যায় না সহজে বলা।প্রিয় কবি মোঃ আসাদুজ্জামান আসাদ বললেন তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে । এখানেই একজন কবি সফল এবং স্বার্থক তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় । নামকরণটিও ভারি চমত্কার । 'ফুল' শব্দে কোনও ভুল নেই । ফুল সুন্দরের প্রতীক।এমন একটি প্রতীকী কবিতার শরীর জুড়ে কবি আসলে মগ্ন সুন্দরের আরাধনায় । চাওয়া নয়,পাওয়া নয় বরং আপন শ্রমে উৎপাদনের পথ দেখায় যে কবিতা সেই কবিতাটি নিজেই তো একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ বিকশিত ফুল।বলা যায় এই ফুলের সুবাস চিরকালীন,রেণু অবিনশ্বর।যেখানেই নিক্ষিপ্ত হবে সেখানেই থাকবে নিষেকের সম্ভাবনা ।শুধু প্রয়োজন উর্বর পলিমাটি ও অনুকূল আবহ।


এমন একটি মনোরম কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই । আগামীতে আমাদের চোখ থাকবে কবির কলমে ।শুভকামনা সতত।