"চলো একটু পালিয়ে বাঁচি'  (কবিতাটি আসলে এক জীবন থেকে আর এক জীবনে উত্তোরণের গল্প)।
কবি-- দেবেশ মহান্তি।
আলোচক---রণজিৎ মাইতি।
---------------------------------------
চলো একটু পালিয়ে বাঁচি
দেবেশ মহান্তি
-------------------
চলো না হয় কিছুক্ষণ চাঁদটার নিচে বসি
কয়েকটি মূহুর্ত বাস্তবের রুঢ়তা ভুলে থাকি।
মাংসল অস্তিত্বের ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে একটু রূপকথায় বাঁচি।
চলো না দিনের ধুলো ঘাম জোছনার জলে ধুয়ে ফেলি।
কিছুক্ষণ অন্তত রোজকার এই ব্যর্থতাপ,
এই প্রতিদিনের মৃত্যু, ক্ষোভ, হতাশা,
এই জীবনের পরাজয়, রিক্ততা, ভয়
না হয় মিছিমিছি, ভুলে থাকি
শ্রান্ত হৃদয়ে চলো একটু জোছনায় আশ্রয় খুঁজি।
----------------------------------


আমরা প্রায়ই বলি জীবন থেকে পালিয়ে কখনো বাঁচা যায় না।কথাটি কতক ঠিক,অনেকাংশে ভুল।তবে ভুল ঠিক নির্বাচন করতে গেলে আগে জানতে হবে জীবন আসলে কি?আপনার জীবনবোধই বলে দেবে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা ঠিক না ভুল।


প্রিয় কবি দেবেশ মহান্তি তাঁর "চলো একটু পালিয়ে বাঁচি" কবিতায় বাঁচার আবেদন রাখলেন জীবন থেকে পালানোর আবেদন জানিয়ে। কোন জীবন থেকে? কবি বললেন,যে জীবন প্রতিদিন তিল তিল করে মরে রোজকার ব্যর্থতাপে,ক্ষোভে,হতাশার পারদে। সেই জীবন থেকে কবি পালিয়ে বাঁচতে চান,যেখানে পরাজয়ের গ্লানি অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে সমগ্র জীবন,রিক্ততা ও ভয়  রক্তশূন্য করে দেয় আচ্ছন্ন চেতন মনন,সেখান থেকেই কবি পালিয়ে বাঁচতে চান।


এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো দার্শনিক হেগেলের কথা,"মরে বাঁচো,মানুষ হও।" এই কবি বললেন, আসুন "পালিয়ে বাঁচি" কোনো অজ্ঞাত আশ্রয়ে জোৎস্নার রেণু মাখতে মাখতে কোনো অজানা অচেনা বেনুবনে।নিশ্চয়ই সেখানে শুনতে পাবো জীবনবাঁশীর সুমধুর ঐকতান।


হাঁ,এটাই কবির আশা।আশাবাদী কবির এই আশা-ভরসা থেকেই জন্ম প্রত্যয়ের। তাই তিনি প্রথম লাইনেই একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেন প্রত্যাশায় রাখলেন মরমী আবেদন-----


"চলো না হয় কিছুক্ষণ চাঁদটার নিচে বসি"


লক্ষ্যনীয়,'না হয়' শব্দটির মধ্য দিয়ে কবি কি চমৎকার ভাবে ফোটালেন জীবনের অনিশ্চয়তা। কারণ কবিও আরও পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো জানেন না জীবনের জ্বালা পোড়া থেকে কোথায় প্রকৃত সুখ-শান্তি। এবং চাঁদটার কথা এমন ভাবে বললেন যেনো চাঁদ আমাদের কতো আপন কাছের। তাছাড়া এই অনিশ্চয়তার বোধই কবিকে নিজস্ব মত পোষণ থেকে বিরত থাকতে বাধা দেয়। তাই কবি প্রথম লাইনে কোনো যতি চিহ্ন ব্যবহার করেননি। ঠিক তার পরপরই বললেন,---
আসুন
"কয়েকটি মূহুর্ত বাস্তবের রুঢ়তা ভুলে থাকি।"
অবশ্য দ্বিতীয় পংক্তিতে কবিকে অনেকাংশে প্রত্যয়ী মনে হলো।


জীবনবোধে ঋদ্ধ কবি জানেন বাস্তবের রুঢ়তা চিরতরে ভুলে থাকা যায় না,কিন্তু কয়েকটি মূহুর্ত তো ভুলে থাকা যায়। সেই লোভ সম্বরণ করতে পারেন না কবি নিজেও। তিনি নিশ্চিত,বাস্তবের রুক্ষ মাটি জ্বালায় পোড়ায়। সেই দহন উপশম করতে পারে একমাত্র রূপসী চাঁদই।তাই কিছু সময়ের জন্যে হলেও দহন জ্বালা ভুলতে বাস্তবের রুক্ষ মাটি ছেড়ে যেতে চান জল জোৎস্নার কাছে।


একদিকে রুঢ় বাস্তব,অন্যদিকে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার আর্তির মধ্যে জীবনের পল-অনুপল এবং রূপকথা শোনালেল রূপমুগ্ধ কবি। ঠিক কোথায় রূপ-অরূপ ও বাস্তব-পরাবাস্তবের দ্বান্দ্বিকতা।তাই কবি বললেন,--


"মাংসল অস্তিত্বের ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে একটু রূপকথায় বাঁচি। "


কি আন্তরিক আবেদন,কিন্তু বাস্তবে কি ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে থাকা যায়!!! কবি নিজেও জানেন যায়না। তাই অস্তিত্বের মাংসল অস্তিত্বকে স্বীকার করতেই ক্ষুধাতৃষ্ণাকে তার জড়ধর্ম থেকে টেনে বের করে আনলেন।এবং নিপুণ দক্ষতায় সেখানেই ফেললেন চড়া আলো,করলেন জীবনদান।যদিও আপামরের প্রতিনিধি অন্নগতপ্রাণ কবি দৈনন্দিন সংকর্ষণ থেকে হাঁপিয়ে ওঠেন।তাই সেই চরম দ্বান্দ্বিকতা থেকে একটু মুক্তি পেতে রূপকথার বাঁচতেও পিছপা হননা। হয়তো এও এক ধরনের অভিযোজন,যা জীবনই শিখিয়েছে জীবনঋদ্ধ কবিকে।


কবি এতোটাই নিখুঁত চিনেছেন জীবন অববাহিকা,জেনেছেন ক্ষুন্নিবৃত্তির ফলস্বরূপ মাংসল অস্তিত্ব জুড়ে জমে ওঠা ধুলো ঘাম কিভাবে অতিষ্ঠ করে একঘেঁয়ে জীবন,তাই আবারও প্রিয় ও কাছের মানুষদের কাছে আন্তরিক আবেদন করেন---


"চলো না দিনের ধুলো ঘাম জোছনার জলে ধুয়ে ফেলি।"


আহা কি অসাধারণ আন্তরিক আহ্বান,"চলো না"। কতোটা কাছের হলে এমন আন্তরিক ডাক দেওয়া যায় কবি নিশ্চিত জানেন।তখন আমাদেরও মনে হয় কবির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেটাই আমাদের সকল ব্যর্থ জ্বালা


"কিছুক্ষণ অন্তত রোজকার এই ব্যর্থতাপ,"


এবং তিলতিল করে মরার চেয়ে--


"এই প্রতিদিনের মৃত্যু, ক্ষোভ, হতাশা,"


ধুয়ে ফেলি জোছনার স্নিগ্ধ জলে। মুছে যাক যতো ক্লেদ--


"এই জীবনের পরাজয়, রিক্ততা, ভয়"
না হয় মিছিমিছি, ভুলে থাকি


আসলে গুণী কবি জানেন হোক না তা মিছে,কিন্তু রূপকথার আশ্রয়ে মিছে ভুলে থাকার মহড়াও আদতে মানুষকে জীবনে ফেরায়। সংগীতে যেমন শমে এসে একটু বিরতি নেয়,জীবন তেমনই বিরাম চায় রূপকথায়।


আসলে আধুনিকতার নামে বর্তমান কর্মব্যস্ত জীবন মানুষকে বানিয়ে তুলছে যন্ত্রমানব। সেখান থেকে মানুষ যদি প্রকৃতির কাছে না ফেরে তার মৃত্যু অবসম্ভাবী। হচ্ছেও তাই। তাই কবি ঘোরাতে চান সভ্যতার অভিমুখ।জোছনার জলে সিক্ত হয়ে জীবনকে করতে চান রূপসী চাঁদের মতো ঝকঝকে তকতকে। তাই শেষের শেষ আহ্বানেও জানিয়ে গেলেন বিক্ষিপ্ত হয়োনা,জীবনের সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বাঁচার মতো বাঁচতে, চলো--


"শ্রান্ত হৃদয়ে চলো একটু জোছনায় আশ্রয় খুঁজি"


অবগাহন করি স্বপ্নে-শিশিরে,কুয়াশায় সিক্ত হতে হতে রচনা করি নতুন ভোর, নতুন সূর্য।সূর্যসারথী হই,অথবা উত্তরাধুনিক গড়ুরবাহন।


ভারি সুন্দর কবিতা।নামকরণটিও ভারি সুন্দর।সমগ্র কবিতা জুড়ে নতুন ভাবে বাঁচার বীজমন্ত্র কবি যেভাবে রোপণ করেছেন,সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিক জীবনের স্বরূপ তাতে মনে হয় না কেউ কবির আহ্বানে সাড়া দিতে কার্পণ্য করবেন। সত্যি যদি তেমন কোনো দুর্মুখঃ থেকে থাকেন ভূভারতে,তিনি নিঃসন্দেহে অজ্ঞতার কারণে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারবেন।সুতরাং মোহাচ্ছন্ন আধুনিক জীবনের মায়া কাটিয়ে কবির পালিয়ে বাঁচার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জোছনার জলে স্নান করাই যুক্তিসঙ্গত।


অতএব বলা যায়
নামকরণ স্বার্থক,এবং যুক্তিসঙ্গত ।তবে একটি বানান চোখে খুব লাগছে।তাই কবিকে তা মেজে নিতে অনুরোধ করবো।শব্দটি হলো ক্ষুধাতৃষ্ণা।


জীবন সমৃদ্ধ চমৎকার কবিতা।এমন একটি সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে গুণী কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই। আগামীতে কবির কলম এভাবেই পত্রে পুষ্পে বিকশিত হোক এই কামনা করি।