বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা ,
       বিধির মানস-বালা ,
  মানস-সরসী ওই নাচিছে হরষে ।
       প্রদীপ্ত তুষাররাশি ,
       শুভ্র বিভা পরকাশি ,
  ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে হিমাদ্রি উরসে ।




       অদূরেতে দেখা যায় ,
       উজল রজত কায় ,
   গোমুখী হইতে গঙ্গা ওই বহে যায় ।
       ঢালিয়া পবিত্র ধারা ,
       ভূমি করি উরবরা ,
   চঞ্চল চরণে সতী সিন্ধুপানে ধায় ।




ফুটেছে কনকপদ্ম অরুণ কিরণে ।।
       অমল সরসী - ' পরে ,
       কমল , তরঙ্গভরে ,
ঢুলে ঢুলে পড়ে জলে প্রভাত পবনে ।




       হেলিয়া নলিনীদলে ,
       প্রকৃতি কৌতুকে দোলে ,
সরসী-লহরী ধায় ধুইয়া চরণ ।
       ধীরে ধীরে বায়ু আসি ,
       দুলায়ে অলকরাশি ,
কবরী-কুসুম-গন্ধ করিছে হরণ ।




       বিজনে খুলিয়া প্রাণ ,
       নিখাদে চড়ায়ে তান ,
শোভনা প্রকৃতিদেবী গান ধীরে ধীরে ।
       নলিন নয়নদ্বয় ,
       প্রশান্ত বিষাদময় ,
ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বহিল গভীরে ।




‘ অভাগী ভারত! হায় , জানিতাম যদি ,
       বিধবা হইবি শেষে ,
       তা হলে কি এত ক্লেশে ,
তোর তরে অলংকার করি নিরমাণ ?
তা হলে কি পূতধারা মন্দাকিনী নদী
তোর উপত্যকা - ' পরে হত বহমান ?
       তা হলে কি হিমালয় ,
       গর্বে ভরা হিমালয়
দাঁড়াইয়া তোর পাশে
       পৃথিবীরে উপহাসে ,
তুষারমুকুট শিরে করি পরিধান ।




       তা হলে কি শতদলে ,
       তোর সরোবরজলে ,
হাসিত অমন শোভা করিয়া বিকাশ ?
       কাননে কুসুমরাশি ,
       বিকাশি মধুর হাসি ,
প্রদান করিত কি লো অমন সুবাস ?




       তা হলে ভারত! তোরে ,
       সৃজিতাম মরু করে ,
তরুলতা-জন-শূন্য প্রান্তর ভীষণ ;
       প্রজ্বলন্ত দিবাকর ,
       বর্ষিত জ্বলন্ত কর ,
মরীচিকা পান্থদের করিত ছলন! '
থামিল প্রকৃতি করি অশ্রু বরিষন ।




       গলিল তুষারমালা ,
       তরুণী সরসী বালা ,
ফেনিল নীহার-নীর সরসীর জলে ।
       কাঁপিল পাদপদল ;
       উথলে গঙ্গার জল ,
তরুস্কন্ধ ছাড়ি লতা লুটিল ভূতলে ।



১০
       ঈষৎ আঁধাররাশি ,
       গোমু্‌খী শিখর গ্রাসী ,
আটক করিয়া দিল অরুণের কর ।
       মেঘরাশি উপজিয়া ,
       আঁধারে প্রশ্রয় দিয়া ,
ঢাকিয়া ফেলিল ক্রমে পর্বতশিখর ।



১১
আবার ধরিয়া ধীরে সুমধুর তান ।
প্রকৃতি বিষাদে দুঃখে আরম্ভিল গান ।
‘ কাঁদ্‌! কাঁদ্‌! আরো কাঁদ্‌ অভাগী ভারত
       হায়! দুঃখ-নিশা তোর ,
       হল না হল না ভোর ,
হাসিবার দিন তোর হল না আগত ?



১২
       লজ্জাহীনা! কেন আর ,
       ফেলে দে-না অলংকার ,
প্রশান্ত গভীর ওই সাগরের তলে ?
       পূতধারা মন্দাকিনী ,
       ছাড়িয়া মরতভূমি
আবদ্ধ হউক পুনঃ ব্রহ্ম-কমণ্ডলে ।



১৩
       উচ্চশির হিমালয় ,
       প্রলয়ে পাউক লয় ,
চিরকাল দেখেছে যে ভারতের গতি ।
       কাঁদ্‌ তুই তার পরে ,
       অসহ্য বিষাদভরে ,
অতীত কালের চিত্র দেখাউক স্মৃতি ।



১৪
       দেখ্‌ , আর্য সিংহাসনে ,
       স্বাধীন নৃপতিগণে ,
স্মৃতির আলেখ্যপটে রহেছে চিত্রিত ।
       দেখ্‌ দেখি তপোবনে ,
       ঋষিরা স্বাধীন মনে ,
কেমন ঈশ্বরধ্যানে রহেছে ব্যাপৃত ।



১৫
       কেমন স্বাধীন মনে ,
       গাহিছে বিহঙ্গগনে ,
স্বাধীন শোভায় শোভে প্রসূননিকর ।
        সূর্য উঠি প্রাতঃকালে ,
        তাড়ায় আঁধারজালে ,
কেমন স্বাধীনভাবে বিস্তারিয়া কর!



১৬
      তখন কি মনে পড়ে —
      ভারতী-মানস-সরে ,
কেমন মধুর স্বরে বীণা ঝংকারিত!
      শুনিয়ে ভারত-পাখি
      গাহিত শাখায় থাকি
আকাশ পাতাল পৃথ্বী করিয়া মোহিত ?



১৭
সে-সব স্মরণ করে , কাঁদ লো আবার ।
       ‘ আয় রে প্রলয় ঝড়
       গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার!
স্বর্গমর্ত্য রসাতল হোক একাকার ।



১৮
       প্রভঞ্জন ভীম-বল!
       খুলে দাও , বায়ুদল!
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক ভারতের বেশ ।
       ভারতসাগর রুষি
       উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ ।



১৯
বলিতে নারিল আর প্রকৃতি-সুন্দরী ।
       ধ্বনিয়া আকাশভূমি ,
       গরজিল প্রতিধ্বনি ,
কাঁপিয়া উঠিল বেগে ক্ষুব্ধ হিমগিরি ।



২০
       জাহ্নবী উন্মত্তপারা ,
        নির্ঝর চঞ্চল ধারা ,
বহিল প্রচন্ডবেগে ভেদিয়া প্রস্তর ।
       মানস সরস-পরে ,
       পদ্ম কাঁপে থরে থরে
দুলিল প্রকৃতি সতী আসন-উপর ।



২১
       সুচঞ্চল সমীরণে ,
       উড়াইল মেঘগণে ,
সুতীব্র রবির ছটা হল বিকীরিত
আবার প্রকৃতি সতী আরম্ভিল গীত ।



২২
‘ দেখিয়াছি তোর আমি সেই এক বেশ ,
অজ্ঞাত আছিল যবে মানবনয়নে ।
নিবিড় অরণ্য ছিল এ বিস্তৃত দেশ ,
বিজন ছায়ায় নিদ্রা যেত পশুগণে ,
কুমারী অবস্থা তোর সে কি পড়ে মনে ?
      সম্পদ বিপদ সুখ ,
      হরষ বিষাদ দুখ ,
  কিছুই না জানিতিস্‌ সে কি পড়ে মনে ?
সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ ,
       যখন মানবগণ ,
       করে নাই নিরীক্ষণ ,
তোর সেই সুদুর্গম অরণ্যপ্রদেশ ।
       না বিতরি গন্ধ হায় ,
       মানবের নাসিকায়
বিজনে অরণ্যফুল , যাইত শুকায়ে
তপনকিরণ-তপ্ত মধ্যাহ্নের বায়ে ।
সে এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ ।



২৩
সেইরূপ রহিল না কেন চিরকাল!
       না দেখি মনুষ্যমুখ
        না জানিয়া দুঃখসুখ
না করিয়া অনুভব মান অপমান ।
       অজ্ঞান শিশুর মত
       আনন্দে দিবস যেত ,
সংসারের গোলমালে থাকিয়া অজ্ঞান ।
  
তা হলে তো ঘটিত না এ-সব জঞ্জাল!
সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল ?
       সৌভাগ্যে হানিল বাজ ,
       তা হলে তো তোরে আজ
অনাথা ভিখারীবেশে কাঁদিতে হত না ?
       পদাঘাতে উপহাসে ,
       তা হলে তো কারাবাসে
সহিতে হত না শেষে এ ঘোর যাতনা ।



২৪
       অরণ্যেতে নিরিবিলি ,
       সে যে তুই ভালো ছিলি ,
কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা ।
       দেখি মরীচিকা হায়!
       আনন্দে বিহ্বলপ্রায়!
  না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না ।



২৫
       আইল হিন্দুরা শেষে ,
       তোর এ বিজন দেশে ,
নগরেতে পরিণত হল তোর বন ।
       হরিষে প্রফুল্লমুখে ,
       হাসিলি সরলা! সুখে ,
আশার দর্পণে মুখ দেখিলি আপন ।



২৬
       ঋষিগণ সমস্বরে
       অই সামগান করে
চমকি উঠিছে আহা! হিমালয় গিরি ।
       ওদিকে ধনুর ধ্বনি ,
       কাঁপায় অরণ্যভূমি
নিদ্রাগত মৃগগণে চমকিত করি ।
       সরস্বতী-নদীকূলে ,
       কবিরা হৃদয় খুলে
গাইছে হরষে আহা সুমধুর গীত ।
       বীণাপাণি কুতূহলে ,
       মানসের শতদলে
গাহেন সরসী বারি করি উথলিত ।



২৭
       সেই এক অভিনব
       মধুর সৌন্দর্য তব ,
আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে ।
আঁধার সাগরতলে
       একটি রতন জ্বলে
একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে ।
       সুবিস্তৃত অন্ধকূপে ,
       একটি প্রদীপ-রূপে
       জ্বলিতিস তুই আহা ,
       নাহি পড়ে মনে ?
  
কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি
হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে ।
       সেই অমানিশা তোর ,
       আর কি হবে না ভোর
কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে ।
       অনন্ত কালের মতো ,
       সুখসূর্য অস্তগত ,
ভাগ্য কি অনন্ত কাল রবে এই রূপে ।
       তোর ভাগ্যচক্র শেষে ,
       থামিল কি হেথা এসে ,
বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার
       আয় রে প্রলয় ঝড় ,
       গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার ।
       প্রভঞ্জন ভীমবল ,
       খুলে দেও বায়ুদল ,
ছিন্ন ভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ ।
       ভারতসাগর রুষি ,
       উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ ।