একদিন মুখে এল নূতন এ নাম —
           চৈতালিপূর্ণিমা ব ' লে কেন যে তোমারে ডাকিলাম
                       সে কথা শুধাও যবে মোরে
                                  স্পষ্ট ক ' রে
                            তোমারে বুঝাই
                        হেন সাধ্য নাই ।
           রসনায় রসিয়েছে , আর কোনো মানে
                       কী আছে কে জানে ।
                 জীবনের যে সীমায়
                       এসেছ গম্ভীর মহিমায়
                            সেথা অপ্রমত্ত তুমি ,
                 পেরিয়েছ ফাল্গুনের ভাঙাভাণ্ড উচ্ছিষ্টের ভুমি ,
           পৌঁছিয়াছ তপঃশুচি নিরাসক্ত বৈশাখের পাশে ,
                       এ কথাই বুঝি মনে আসে
                            না ভাবিয়া আগুপিছু ।
           কিংবা এ ধ্বনির মাঝে অজ্ঞাত কুহক আছে কিছু ।
                       হয়তো মুকুল-ঝরা মাসে
           পরিণতফলনম্র অপ্রগল্‌ভ যে মর্যাদা আসে
                            আম্রডালে ,
                       দেখেছি তোমার ভালে
                 সে পূর্ণতা স্তব্ধতামন্থর —
           তার মৌন-মাঝে বাজে অরণ্যের চরম মর্মর ।
           অবসন্ন বসন্তের অবশিষ্ট অন্তিম চাঁপায়
                       মৌমাছির ডানারে কাঁপায়
                            নিকুঞ্জের ম্লান মৃদু ঘ্রাণে ,
           সেই ঘ্রাণ একদিন পাঠায়েছ প্রাণে ,
                 তাই মোর উৎকণ্ঠিত বাণী
                       জাগায়ে দিয়েছে নামখানি ।
                  সেই নাম থেকে থেকে ফিরে ফিরে
                       তোমারে গুঞ্জন করি ঘিরে
     চারি দিকে ,
            ধ্বনিলিপি দিয়ে তার বিদায়স্বাক্ষর দেয় লিখে ।
                 তুমি যেন রজনীর জ্যোতিষ্কের শেষ পরিচয়
                       শুকতারা , তোমার উদয়
                            অস্তের খেয়ায় চ ' ড়ে আসা ,
                       মিলনের সাথে বহি বিদায়ের ভাষা ।
                                  তাই বসে একা
                       প্রথম দেখার ছন্দে ভরি লই সব-শেষ দেখা ।
                                   সেই দেখা মম
                                        পরিস্ফুটতম ।
                 বসন্তের শেষমাসে শেষ শুক্লতিথি
                            তুমি এলে তাহার অতিথি ,
                 উজাড় করিয়া শেষ দানে
           ভাবের দাক্ষিণ্য মোর অন্ত নাহি জানে ।
                  ফাল্গুনের অতিতৃপ্তি ক্লান্ত হয়ে যায় ,
                       চৈত্রে সে বিরলরসে নিবিড়তা পায় ,
                 চৈত্রের সে ঘন দিন তোমার লাবণ্যে মূর্তি ধরে ;
           মিলে যায় সারঙের বৈরাগ্যরাগের শান্তস্বরে ,
                 প্রৌঢ় যৌবনের পূর্ণ পর্যাপ্ত মহিমা
                       লাভ করে গৌরবের সীমা ।


           হয়তো এ-সব ব্যাখ্যা স্বপ্ন-অন্তে চিন্তা ক'রে বলা ,
                 দাম্ভিক বুদ্ধিরে শুধু ছলা —
                       বুঝি এর কোনো অর্থ নাইকো কিছুই ।
           জ্যৈষ্ঠ-অবসানদিনে আকস্মিক জুঁই
                        যেমন চমকি জেগে উঠে
                 সেইমতো অকারণে উঠেছিল ফুটে ,
                       সেই চিত্রে পড়েছিল তার লেখা
           বাক্যের তুলিকা যেথা স্পর্শ করে অব্যক্তের রেখা ।
                       পুরুষ যে রূপকার ,
           আপনার সৃষ্টি দিয়ে নিজেরে উদ্‌ভ্রান্ত করিবার
                            অপূর্ব উপকরণ
বিশ্বের রহস্যলোকে করে অন্বেষণ ।
                       সেই রহস্যই নারী —
           নাম দিয়ে ভাব দিয়ে মনগড়া মূর্তি রচে তারি ;
                 যাহা পায় তার সাথে যাহা নাহি পায়
                             তাহারে মিলায় ।
                 উপমা তুলনা যত ভিড় করে আসে
                            ছন্দের কেন্দ্রের চারি পাশে ,
                 কুমোরের ঘুরখাওয়া চাকার সংবেগে
           যেমন বিচিত্র রূপ উঠে জেগে জেগে ।
                 বসন্তে নাগকেশরের সুগন্ধে মাতাল
           বিশ্বের জাদুর মঞ্চে রচে সে আপন ইন্দ্রজাল ।
                 বনতলে মর্মরিয়া কাঁপে সোনাঝুরি ;
           চাঁদের আলোর পথে খেলা করে ছায়ার চাতুরী ;
                       গভীর চৈতন্যলোকে
           রাঙা নিমন্ত্রণলিপি দেয় লিখি কিংশুকে অশোকে ;
                 হাওয়ায় বুলায় দেহে অনামীর অদৃশ্য উত্তরী ,
                      শিরায় সেতার উঠে গুঞ্জরি গুঞ্জরি ।


             এই যারে মায়ারথে পুরুষের চিত্ত ডেকে আনে
                 সে কি নিজে সত্য করে জানে
                            সত্য মিথ্যা আপনার ,
           কোথা হতে আসে মন্ত্র এই সাধনার ।
                       রক্তস্রোত-আন্দোলনে জেগে
                 ধ্বনি উচ্ছ্বসিয়া উঠে অর্থহীন বেগে ;
           প্রচ্ছন্ন নিকুঞ্জ হতে অকস্মাৎ ঝঞ্ঝায় আহত
                       ছিন্ন মঞ্জরীর মতো
                  নাম এল ঘূর্ণিবায়ে ঘুরি ঘুরি ,
           চাঁপার গন্ধের সাথে অন্তরেতে ছড়াল মাধুরী ।