ইস্‌টিমারের ক্যাবিনটাতে কবে নিলেম ঠাঁই ,
                                  স্পষ্ট মনে নাই ।
                            উপরতলার সারে
                       কামরা আমার একটা ধারে ।
                                   পাশাপাশি তারি
                                        আরো ক্যাবিন সারি সারি
                                             নম্বরে চিহ্নিত ,
                 একই রকম খোপ সেগুলোর দেয়ালে ভিন্নিত ।
           সরকারী যা আইনকানুন তাহার যাথাযথ্য
                 অটুট , তবু যাত্রীজনের পৃথক বিশেষত্ব
                       রুদ্ধদুয়ার ক্যাবিনগুলোয় ঢাকা ;
                 এক চলনের মধ্যে চালায় ভিন্ন ভিন্ন চাকা ,
                                        ভিন্ন ভিন্ন চাল ।
                                  অদৃশ্য তার হাল ,
                       অজানা তার লক্ষ্য হাজার পথেই ,
                 সেথায় কারো আসনে ভাগ হয় না কোনোমতেই ।
           প্রত্যেকেরই রিজার্ভ করা কোটর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ;
                 দরজাটা খোলা হলেই সম্মুখে সমুদ্র
                       মুক্ত চোখের'পরে
                                  সমান সবার তরে ,
                            তবুও সে একান্ত অজানা ,
                       তরঙ্গতর্জনী-তোলা অলঙ্ঘ্য তার মানা ।
  
                 মাঝে মাঝে ঘণ্টা পড়ে । ডিনার-টেবিলে
           খাবার গন্ধ , মদের গন্ধ , অঙ্গরাগের সুগন্ধ যায় মিলে —
                       তারি সঙ্গে নানা রঙের সাজে
                 ইলেক্‌ট্রিকের আলো-জ্বালা কক্ষমাঝে
                       একটু জানা অনেকখানি না-জানাতেই মেশা
                            চক্ষু-কানের স্বাদের ঘ্রাণের সম্মিলিত নেশা
                                         কিছুক্ষণের তরে
মোহাবেশে ঘনিয়ে সবায় ধরে ।
                        চেনাশোনা হাসি-আলাপ মদের ফেনার মতো
                            বুদ্‌বুদিয়া ওঠে আবার গভীরে হয় গত ।
                                   বাইরে রাত্রি তারায় তারাময় ,
                            ফেনিল সুনীল তেপান্তরে মরণ-ঘেরা ভয় ।
  
                       হঠাৎ কেন খেয়াল গেল মিছে ,
                 জাহাজখানা ঘুরে আসি উপর থেকে নীচে ।
           খানিক যেতেই পথ হারালুম , গলির আঁকেবাঁকে
                             কোথায় ওরা কোন্‌ অফিসার থাকে ।
                       কোথাও দেখি সেলুন-ঘরে ঢুকে ,
           ক্ষুর বোলাচ্ছে নাপিত সে কার ফেনায়-মগ্ন মুখে ।
                            হোথায় রান্নাঘর ;
                       রাঁধুনেরা সার বেঁধেছে পৃথুল-কলেবর ।
            গা ঘেঁষে কে গেল চলে ড্রেসিং-গাউন-পরা ,
                       স্নানের ঘরে জায়গা পাবার ত্বরা ।
                 নীচের তলার ডেকের ‘ পরে কেউ বা করে খেলা ,
                       ডেক-চেয়ারে কারো শরীর মেলা ,
                   বুকের উপর বইটা রেখে কেউ বা নিদ্রা যায় ,
                       পায়চারি কেউ করে ত্বরিত পায় ।
           স্টুয়ার্ড্‌ হোথায় জুগিয়ে বেড়ায় বরফী শর্বৎ ।
                 আমি তাকে শুধাই আমার ক্যাবিন-ঘরের পথ
                                  নেহাত থতোমতো ।
                 সে শুধাল , নম্বর তার কত ।
                             আমি বললেম যেই ,
                        নম্বরটা মনে আমার নেই —
                 একটু হেসে নিরুত্তরে গেল আপন কাজে ,
                       ঘেমে উঠি উদ্‌বেগে আর লাজে ।
                 আবার ঘুরে বেড়াই আগে পাছে ,
           চেয়ে দেখি কোন্‌ ক্যাবিনের নম্বর কী আছে ।
                 যেটাই দেখি মনেতে হয় , এইটে হতে পারে ;
                       সাহস হয় না ধাক্কা দিতে দ্বারে ।
ভাবছি কেবল , কী যে করি , হল আমার এ কী —
                       এমন সময় হঠাৎ চমকে দেখি ,
                             নিছক স্বপ্ন এ যে ,
                       এক যাত্রার যাত্রী যারা কোথায় গেল কে যে ।
                  গভীর রাত্রি ; বাতাস লেগে কাঁপে ঘরের সাসি ,
                      রেলে গাড়ি অনেক দূরে বাজিয়ে গেল বাঁশি ।