রাখি বন্ধন উৎসব
রাখি বন্ধন উৎসব হল একটি মহাপবিত্র ও সুন্দর সংহতির অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের দ্বারা ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসা ও স্নেহের বন্ধনকে দৃঢ় শক্তিশালী ও পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। এই চিরন্তন পবিত্র উৎসব পরিবারের সকল সদস্যদের পাশাপাশি সমাজ তথা সমগ্র মানবজাতিকে সুসম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে ও ঐক্যকে নিশ্চিত করে। রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানে ভাইদের পাশাপাশি বোনরা নতুন পোশাক পরিধান করে এবং মিষ্টি মুখ করানোর মধ্য দিয়ে ভাইদের হাতে পবিত্র সুতো বা রাখি বেঁধে দেয়। পরিবর্তে ভাইরা বোনদেরকে উপহার দিয়ে থাকে।


রাখি বন্ধন উৎসব কেন পালন করা হয়
রাখি বন্ধন বা রাখি পূর্ণিমা ভারতের একটি সুপ্রচলিত পবিত্র উৎসব। প্রধানত এই দিনে ভাই-বোনের সম্পর্ক আজীবন রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দাদা বা ভাইয়ের ডান হাতের কব্জিতে দিদি বা বোনেরা পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। এর মাধ্যমে দিদি বা বোনেরা, দাদা বা ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে থাকে। বিনি হিন্দু পঞ্জিকা মতে শ্রাবণ মাসের শুক্লা পক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। রাখিবন্ধন উৎসবটি ভারতবর্ষের সকল জাতি ও বর্ণের মানুষরা পালন করে থাকে; তবে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের মধ্যেই বেশী প্রচলিত। তবে বর্তমানে এদেশের পাশাপাশি বিদেশেও এই উৎসব খ্যাতি অর্জন করেছে।


রাখি বন্ধন উৎসব প্রথম কবে পালিত হয়
ঐতিহাসিক কাহিনী থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ১৯০৫ সালে প্রথম রাখি বন্ধন উৎসব পালিত হয়। আর এই ১৯০৫ সাল থেকে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করা হয়।


রাখি বন্ধন উৎসব কে চালু করেন
রাখি বন্ধন উৎসব চালু বা প্রচলন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখি বন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। তিনি কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই-বোনকে আহ্বান করেছিলেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য।


রাখি বন্ধন উৎসবের পৌরাণিক কাহিনী
রাখি বন্ধন উৎসবের উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে মহাভারতের কাহিনী সম্পর্কে জানতে পারি। মহাভারতে বর্ণিত, এক যুদ্ধে কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। ফলতু দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয়া হলেও, তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোনের মর্যাদা দেন। পরবর্তীতে কৌরব পক্ষ কতৃক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণকালে শ্রীকৃষ্ণ দৌপদী সম্মান রক্ষা করে ভাই-বোনের সম্পর্ককে দৃষ্টান্ত স্বরূপ গড়ে তোলে, এইভাবেই রাখি বন্ধনের প্রচলন হয়।


ঐতিহাসিক কাহিনী বা রাখিবন্ধন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছালে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাকে দুটি প্রদেশে বিভক্ত করবে। ফলতু তৎকালীন সময় দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চরম আকার ধারন করে। ব্রিটিশ সরকারের এই বিরূপ সিদ্ধান্ত বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎকালীন হিন্দু ও মুসলিম ভাই-বোনকে একত্রিত হওয়ার জন্য আহ্বান করেছিলেন।


১৯০৫ সালের জুন মাসে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে ওই বছরেরই আগস্ট মাসে বঙ্গভঙ্গ আইন পাশ হয়। বঙ্গভঙ্গ আইনটি ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর কার্যকর হলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগিয়ে তোলা এবং ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য আহ্বান করেন।


রাখী বন্ধন উত্সব
কলমে কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


রাখী বন্ধনের দিন হরষিত মন,
ভাইবোনের মধুর অটুট বন্ধন।
ভগিনী ভ্রাতার হস্তে রাখী বেঁধে দেয়,
ভগিনী চরণ ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয়।


ঘরে ঘরে আজি হয় রাখী উত্সব,
সবাকার মুখে তাই হাসি কলরব।
মহা ধূমধাম হয় আজিকার দিনে,
ভগিনী ভ্রাতার তরে রাখী আনে কিনে।


প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি সহোদরাগণ,
ভ্রাতার কপালে দেয় সুগন্ধি চন্দন
পরে ধান্য দূর্বা দেয় মস্তকে ভ্রাতার,
ভ্রাতা ভগিনীরে দেয় নানা উপহার।


শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনি হয় ঘনে ঘনে,
ভ্রাতার হস্তেতে রাখী বাঁধে সযতনে।
বর্ষে বর্ষে আসে রাখী মহা ধূমধাম,
রাখী উত্সবে আজি মেতে উঠে গ্রাম।