মা লক্ষ্মীদেবী আবাহন....... কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা
এসো মা লক্ষ্মী আমার ঘরে (তৃতীয় পর্ব)
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


আশ্বিনের শারদপূর্ণিমা নিশিতে মা লক্ষ্মী জগৎ পরিক্রমা করেন। যে প্রদোষকালে লক্ষ্মীপূজা করেন, এবং ঐ রাত্রিতে নারিকেলোদক পান করে অক্ষক্রীড়া প্রভৃতি দ্বারা রাত্রিজাগরণ করেন, তাঁকে মা ঐশ্বর্য দান করেন। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় পূর্ণিমা তিথি প্রদোষব্যাপিনী হলেই সেই দিনে পূজা হয়। যদি আগের দিন নিশিব্যাপিনী তিথি হয়, তবে আগের দিন রাত্রি জাগরণ করে পরের দিন পূজা করতে হয়। পরের দিন প্রদোষকাল পর্যন্ত তিথি না থাকলে তবে আগের দিনই পূজা হবে। প্রদোষকালের সময়সীমা হচ্ছে সূর্যাস্তের পর দুই দণ্ড অর্থাৎ, ৪৮ মিনিট পর্যন্ত।


গৌরবর্ণা সুরূপা সাভূষণা দেবীর যাম্য অর্থাৎ দক্ষিণ করে পাশ ও অক্ষমালা, সৌম্য অর্থাৎ বাম করে পদ্ম ও অঙ্কুশ শোভা পাচ্ছে। তিনি পদ্মাসনে উপবিষ্টা। নীচের বাম হস্তে তিনি কনকপদ্ম ও দক্ষিণ হস্তে বরদান করছেন। এই দেবীই শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মী ও ত্রিলোকের মাতা। এই হল লক্ষ্মীদেবীর প্রচলিত ধ্যানমন্ত্র। যদিও বঙ্গদেশে দ্বিভুজা লক্ষ্মীদেবীর পূজার প্রচলনই বেশি। দেবীর এক হাতের ধানের ঝাঁপি অথবা সিঁদুরকৌটো আর অপর হাতে থাকে পদ্ম বা বরমুদ্রা। চতুর্ভূজা মহালক্ষ্মী বা গজলক্ষ্মীর পূজা বঙ্গে নেই বললেই চলে। গৃহলক্ষ্মীর প্রতিমায় পূজাও খুব কম। গ্রামে-গঞ্জে বেশিরভাগই প্রতীকে পূজা হয়। শাস্ত্রে কোজগরকৃত্যের উল্লেখ থাকলেও কোজাগরীর লক্ষ্মীপূজা মূলত পূর্ববঙ্গের মানুষদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল।


দেশভাগের পর এই বঙ্গেও বহুলভাবে প্রচলিত হয়ে যায়। পূর্ববঙ্গের মানুষরা সরায় পূজা করতেন, বরিশাল অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এবং আরও কোথাও কোথাও পঞ্চপত্রিকা বা নবপত্রিকা বা কলাবৌ এনে প্রকৃতিরূপা দেবীর পূজা প্রচলিত আছে। স্বাভাবিকভাবেই কোজাগরীর পূজায় পূর্ববঙ্গীয়দের পূজা অধিক বৈচিত্র্যময়, কারণ পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারে বছরে বেশ কয়েকটি লক্ষ্মীপূজা থাকলেও পূর্ববঙ্গীয়দের একটিই লক্ষ্মীপূজা, আর তা হল কোজাগরী। কলার পেটো দিয়ে সাতটি মান্দাস বা ডিঙা বানানো হয়। যেখানে থাকে হলুদ, চাল, ডাল, পাটপাতা, বস্ত্র, টাকা, হরিতকি ইত্যাদি। বোঝাই যায়, বাণিজ্যের প্রতীকে মায়ের আরাধনা করা হয়। নদীঘেরা ওপার বাঙলায় নৌকাই ছিল অন্যতম প্রধান যানবাহন।
এছাড়াও থাকে বেড়ি লক্ষ্মী, কচি কলাগাছের ছাল আর নারকেল কাঠির সাহায্যে চোঙার মতো নয়টি আধার তৈরী হয়। সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক এঁকে তাতে রাখা হয় পঞ্চশস্য, সোনা, রুপো, দুই রকমের চন্দনকাঠ। এটিও বাণিজ্য তথা সমৃদ্ধির প্রতীক। পূর্ববঙ্গীয়দের পূজায় নারকেলের খুব মাহাত্ম্য আছে। সশীর্ষ ঝুনো নারকেলের গায়ে সরা পাতা হয়। সেই নারকোলের পিঠে খাওয়া হয় পরে কোনও শুভদিনে। নারকেলের জল দেওয়া হয়। দুধ, নারকোল, ঘি দিয়ে চিড়ে মাখা হয়, এই চিড়েমাখা পূজোর পরে খাওয়া তো হয়ই আবার পিতৃপুরুষের উদ্দেশে ভাসানোও হয়।


শাস্ত্রেও এই নির্দেশ আছে। এছাড়াও নারকেল, চিড়ে, খই, তিল, মুড়ি প্রভৃতির নাড়ু বা মোয়া থাকে। খইয়ের মুড়কি বা ‘উপড়া’ থাকে। বাঙালদের লক্ষ্মীপূজোতে পঞ্চব্যঞ্জনসহ বিহিত আমিষ খাওয়াই রীতি, যদিও এদেশীয়দের নিরামিষ খাওয়া হয়। যে সরায় লক্ষ্মীপূজা হয়, তার বিভিন্ন ধরন আছে। মূলত আঁকার বিভিন্নতার জন্যই যেমন, ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা, শান্তিপুরী সরা, তিন পুতুলের সরা ইত্যাদি। শাক্তবাড়িতে দুর্গাসরায় লক্ষ্মীপূজা হয় আবার বৈষ্ণববাড়িতে রাধাকৃষ্ণ বা লক্ষ্মীনারায়ণ আঁকা সরাতেও লক্ষ্মীপূজা হয়।


এছাড়া শোলার মুখাতেও লক্ষ্মীপূজা হয়। সরাগুলি লোকবৈচিত্র্যে ভরপুর এবং পটচিত্রের তুমুল উদাহরণ। যেমন ঢাকাই সরায় মা লক্ষ্মীকে নৌকাবাহিনী হিসেবে দেখানো হত, বোঝাই যায়, অঞ্চল ও পরিবেশের কতটা লোকপ্রভাব এর সঙ্গে জড়িত। যদিও এখন আর সেই বৈচিত্র্য দেখা যায় না। শিল্পের চাহিদা কমলে শিল্পীও কমে যায়। মাটির উত্তল সরা কৃষিজীবী বাংলার উর্বরতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক। খুব সাধারণ কিছু উপচারে মা লক্ষ্মীর পূজা হয়, যা দেখতে সাধারণ, কিন্তু বাংলার জীবন-জীবিকায় গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরা যাক, শোলা। শোলার মালা, মুখা, কদমফুল, চাঁদমালা এগুলি তো লক্ষ্মীপূজার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলার খোলা মাঠেঘাটে আগে অনাদরে বেড়ে উঠত এই জলজ গাছটা। শোলার শিল্পও উৎকৃষ্টতা লাভ করেছিল। এখন বাংলায় জলাজমি ভরে ফ্ল্যাট হচ্ছে, শোলা হয়ে উঠছে মহার্ঘ্য এবং দুর্লভ। স্বভাবতই শিল্পীরাও হারিয়ে যাচ্ছেন।


এদেশীয়দের মধ্যে কুনকে বা হাঁড়ির লক্ষ্মী দেখা যায়। হাঁড়ি বা কুনকেতে সিঁদুর লেপে ধান ভর্তি করে কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। সঙ্গে থাকে সিঁদুরকৌটো, কাঠের পেঁচা, রূপোর পেঁচা, সাদা কড়ি, কালো কড়ি ইত্যাদি। অনেকে শুধু মাটির ঘটেও লক্ষ্মীপূজা করে থাকেন। ধানের গোলাতেও আলপনা এঁকে হয় লক্ষ্মীপুজো। আলপনার সঙ্গেও লক্ষ্মীপুজোর নিবিড় সম্পর্ক। চালের গুঁড়ি দিয়ে ধানের শিষ, ধানের গোলা, নৌকা, লক্ষ্মীর পা, পেঁচা এবং আরও নানারকম কায়দায় সারা বাড়ি জুড়ে আলপনা দেওয়া হয়। বাংলার দারুশিল্পেও লক্ষ্মীপেঁচা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি কাজ।


কোজাগরকৃত্যে শাস্ত্রীয় কিছু নির্দিষ্ট বিধিও আছে। এই লক্ষ্মীপূজায় দুইবার সঙ্কল্প করতে হয়। প্রথমে দ্বারদেবতাগণের পূজার জন্য সঙ্কল্প করা হয়। তারপর হব্যবাহন, পূর্ণেন্দু, রুদ্র, স্কন্দ, নন্দীশ্বর মুনি, সুরভি, হুতাশন, বরুণ, বিনায়ক, রেবন্ত, নিকুম্ভ প্রভৃতি দেবতার পূজা হয়। চন্দ্রকে অর্ঘ্যও দেওয়া হয়। পুনরায় সঙ্কল্প করে লক্ষ্মীর ষোড়শোপচারে পূজা হয়। তারপর নারায়ণ, কুবের, ইন্দ্রের পূজা হয়। তারপর স্তবস্তুতিতে পূজা সমাপ্ত হয়। এইদিন গৃহবধূরা সারারাত্রি ঘৃতদীপ জ্বালিয়ে রাখেন। বৃন্দাবনে এইদিন পালিত হয় রাধাকৃষ্ণের মহারাস। নবদ্বীপাদি বৈষ্ণব পীঠস্থানগুলিতেও শারদ রাসের আয়োজন হয়। বর্তমানে সমস্ত বারোয়ারি ও বাড়ির দুর্গাপূজায় একই মণ্ডপে দুর্গার ও কোজাগরী পূজার রীতি প্রচলিত হয়েছে।
বাংলা কবিতার আসরের সকল কবিগণ ও সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাগণকে জানাই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার শুভেচ্ছা।
সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!!!


মা লক্ষ্মীদেবী আবাহন....... কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা
এসো মা লক্ষ্মী আমার ঘরে (তৃতীয় পর্ব)
কলমে- কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


শারদ পূর্ণিমা তিথি পূণ্য শুভক্ষণ,
বিধিমতে করা হয় মা লক্ষ্মী পূজন।
মাটির প্রতিমা এক রাখি বেদী পরে,
দেবীর মঙ্গল ঘটে রাখো জল ভরে।


আম্রের পল্লব সহ কচি ডাব রাখি,
নববস্ত্র, ফুল, মালা কিছু নাহি বাকি।
ধান্য, দূর্বা, গঙ্গাজল, সুগন্ধি চন্দন,
শঙ্খধ্বনি দিয়ে কর দেবী আবাহন।


শারদীয়া পূর্ণিমায় সবে ঘরে ঘরে,
সযতনে ভক্তিভরে লক্ষ্মীপূজা করে।
পূজাপাঠ, হোমযজ্ঞ, অঞ্জলি প্রদান,
পূজান্তে পাঁচালি-পাঠ বিধির বিধান।


এসো মাগো লক্ষ্মীদেবী করি আবাহন,
বর্ষে বর্ষে থাকো মাগো আমার ভবন।
ঐশ্বর্য, বৈভব আর ভক্তি করো দান,
করযোড়ে কহে কবি লক্ষ্মণ শ্রীমান।