রথযাত্রার পৌরাণিক ইতিহাস
(তথ্য সংগৃহীত)


প্রতি বছরের মতো নিয়ম মেনে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয় তিথিতে রথযাত্রা উত্সয়ব পালন করা হয়। আর সেই রথযাত্রায় সামিল হতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে যান শ্রীক্ষেত্রে। রথে অবস্থিত জগন্নাথদেবকে একবার দর্শন পেতে, একবার স্পর্শ পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন ভক্তরা। এবছর এই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা পালিত হচ্ছে আগামীকাল, ২০ জুন। আর তাই পুরীধামে এখন প্রস্তুতি চলছে তুঙ্গে। স্নানযাত্রায় ১০৮ কলসি দুধ ও জল ঢালার পর তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন মহাপ্রভু জগন্নাথদেব। তারপর থেকেই তাঁকে সুস্থ করে তোলার জন্য রোজ নির্দিষ্ট বৈদ্যের মাধ্যমে মহৌষধি তৈরি করে জগন্নাথদেবকে খাওয়ানো হত। রথের আগের দিন মহাপ্রভু সুস্থ হয়ে নবজীবনে সঞ্চারিত হন। দেওয়া হয় চক্ষুদানও। তারপর পুজো ও আরতির মাধ্যমে জগন্নাথদেবকে তুষ্ট করা হয়। রাতে ভোগ নিবেদন করে শয়নকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ রথযাত্রার সকাল থেকেই চলে বিশেষ রীতি-নীতি। রথের আগের দিন জগন্নাথদেব সুস্থ হয়ে উঠলে জনসাধারণের জন্য পুরীর মূল সিংহদ্বার খুলে দেওয়া হয়। এদিন আপামর ভক্ত জগন্নাথদেবের রাজবেশ দর্শন পান।


রথযাত্রার সকাল থেকেই শুরু হয় বিশেষ আচার। প্রতি বছর জগন্নাথদেব, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শনচক্রের জন্য নতুন রথ নির্মাণ করা হয়। প্রতি বছরের মতো রথের রশিও নতুন করে তৈরি করা হয়। উল্টোরথের পর ফের রথ ভেঙে ফেলা হয়। প্রতিদিনের মতো জগন্নাথদেবের নিদ্রাভঙ্গ করে জাগ্রত করা হয়। তারপর মুখে ধুয়ে, দাঁতকাঠি দিয়ে ব্রাশ করানো হয়। তারপর বাসি পোশাক ছাড়িয়ে নতুন বেশ পরানো হয়। তারপর চলে মঙ্গলারতি, অবকাশ। প্রতিদিন যেভাবে পুজো ও সেবা দান করা হয়, ঠিক সেইভাবেই রথের দিন জগন্নাথদেবের আরাধনা করা হয়। শুধু জগন্নাথ দেবেরই নয়, বলরাম ও সুভদ্রা, নারায়ণ, সুদর্শন চক্র-সহ প্রায় ১৬টি দেবতার পুজো ও আরতি করা হয়। তারপর দেওয়া হয় খিচুরি ভোগ। এই খিচুরি ভোগ দেওয়ার পিছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনি।


রথের রশিতে টান পড়ার আগে সোনার ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দেন গজপতি রাজা!
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরেক অবতার হিসেবে মর্ত্যে আগমন ঘটেছিল এই জগন্নাথদেব রূপেই। পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, ভগবান কৃষ্ণের পরম ভক্ত কর্মাবাঈ একবার পুরীতে বসবাস শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই জগন্নাথদেবকে পুত্রের রূপে পুজো করতেন। একদিন কর্মাবাঈ বল, মিষ্টি বা বাদামের পরিবর্তে নিজের হাতে বানানো খাবার বানিয়ে নিবেদন করতে চেয়েছিলেন। সেইমতো জগন্নাথদেবকে তাঁর ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন। সেইমতো, স্বপ্নে মহাপ্রভু জানিয়েছিলেন, যা কিছু হাতে বানানো হয়েছে, সেটাই যেন ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। সেদিন বানিয়েছিলেন খিচুড়ি। এমন স্বপ্নাদেশ পেয়ে রোজ সকালে উঠেই তিনি আগে খিচুড়ি রান্না করতেন। তারপর অন্য বাকি সব কাজ। এই রীতি মেনেই প্রতিদিন সকালে জগন্নাথের ভোগ হিসেবে খিচুড়ি নিবেদন করা হয়।


খিচুড়ি ভোগ নিবেদনের পাশাপাশি জগন্নাথদেবের প্রিয় পিঠেও দেওয়া হয়। ষোড়শোপচারে পুজো করা হয়। পরে ভোগস্থান পরে জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করা হয়। এরপর জগন্নাথদেবের মঙ্গলাপর্ণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ডোরা-লাগি, পুষ্পাঞ্জলি ও তুলি আচার পালন করা হয়ে থাকে। এই সবই করে থাকেন মুদিরথ সেবকরা ও দইতাপতি সেবকরা। এরপর দইতাপতিরা জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তিকে বন্ধনমুক্ত করেন। এর অর্থ হল, রুপোর চেন দিয়ে পিছন থেকে বেঁধে রাখা হয়। সুবিশাল ও অত্যন্ত ভারী তিন দারুমূর্তি যাতে কাত হয়ে না পড়ে যায়, তার জন্য রুপোর চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তারপর শুরু হয় জগন্নাথদেবের পাহন্ডি। সকাল থেকেই চলে মহাআয়োজন।


আর এই পাহন্ডি কী? তিন দেবদেবীর দারুমূর্তিরই কটিদেশে রেশমের মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে দুদিক থেকে বাঁধা থাকে। দুদিক থেকে দড়ি ধরে টান মারেন সেবকরা। অন্যদিকে অন্য সেবকরা তিন শ্রীবিগ্রহের কাঁধ, শ্রীপদ্মচরণে হাত দিয়ে নড়াবার চেষ্টা করেন সেবকরা। এই কারণেই বিগ্রহগুলি সামান্য নড়াচড়া, দোল খেতে খেতে রথের দিকে যাত্রা করেন। স্নানযাত্রার দিনও ঠিক এইভাবেই সর্বসম্মুখে স্নান করেন।


ভোজনের পর বন্দাপনা রীতি মেনে চলা হয়। তারপরেই চার দেবদেবীর বিজয়যাত্রা আরম্ভ হয়। পাশাপাশি রথ মার্জনা, রথ প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলে। রথ প্রতিষ্ঠার পর মন্দিরের চারদেবতার পাশাপাশি অন্য দেব-দেবীদের রথে তোলা হয়। রথে প্রথম তোলা হয় সুদর্শন চক্রকে। তারপর বলরাম, সুভদ্রা ও সবশেষে জগন্নাথদেবকে রথে তোলা হয়। এছাড়া জগন্নাথের সঙ্গে রথে থাকেন মদনমোহন, শ্রীরাম থাকেন বলরামের রথে ও সুদর্শন থাকেন সুভদ্রার রথে। এই সুদর্শন বোন সুভদ্রাকে নিরাপত্তা দিতেই বিরাজ করেন। কথিত আছে, রথের দিন রথযাত্রায় জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের পাশাপাশি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীও বিরাজ করেন। তাই এদিন রথ দর্শন করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। নির্দিষ্টি তিথিতে শুভমুহূর্তে প্রথমে জগন্নাথের রথ, তারপর সুভদ্রা ও সবশেষে বলরামের রথ টানা হবে।


রথের দিন কলকাতার যাত্রাপাড়ার সেই জৌলুস এখন ইতিহাস ৷ রথযাত্রার দিনটা এখনও একটু বেশিই বিশেষ দিন যাত্রাশিল্পীদের কাছে ৷ এদিনই হয় যাত্রাপালার বায়না ৷ এদিন থেকে প্রতিবছর নতুন যাত্রার সৃচনা ঘটে ৷ এখন আর তেমন জাঁক নেই ৷


আজিকে রথের মেলা
কলমে- কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


রথের মেলায় এসেছে সবাই
টানিবে আজিকে রথ,
জয় জগন্নাথ দেয় সবে ডাক
ভিড় করে রাঙাপথ।


আমের শাখায় ফুল আর মালায়
সুসজ্জিত রথখানি,
জয় জগন্নাথ ডাকিছে সবাই
রথ নিয়ে যায় টানি।


রাঙাপথের দুইধারে আজি
বসেছে দোকান সারি,
হরেক জিনিস পাঁচসিকে দাম
ডাক ছাড়ে গলা ছাড়ি।


ম্যাজিকের খেলা সার্কাসের খেলা
পুতুল নাচের খেলা,
তাই দেখে হায় দিন কেটে যায়
আজিকে সারা বেলা।


রথের মেলায় ভিড় জমে যায়
চারিদিকে হাঁক ডাক,
ভোলা ময়রা সন্দেশ দোকানে
জিলিপিতে দেয় পাক।


হরেক রকম খেলনা পুতুল
তাল পাতার বাঁশি,
পাঁচ টাকায় কাঠের পুতুল
সেইখানে ভিড় বেশি।


খুন্তি কড়াই ঝাঁঝরি হাতা
রয়েছে বেতের ঝুড়ি,
আলতা সিঁদুর পায়ের নুপুর
মালা ও কাঁচের চুড়ি।


রথের মেলায় খুশি সবাই
খোকনের মুখে হাসি,
মা খোকাকে দিয়েছে কিনে
তাল পাতার বাঁশি।


পুতুল কিনে দেয়নি মা এক
মায়ের বকুনি খেয়ে,
রথের মেলায় কাঁদছে একা
বসে এক ছোট মেয়ে।


হাসির চেয়ে কান্না যে দামী
আজিকে রথের মেলা,
কান্না হাসির বেচা কেনা চলে
চিরদিন একই খেলা।