হঠাৎ আমার খেয়ালি মনে বাসনা জাগলো পুরানো কলকাতার কিছু কবিতা আসরের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার | আর সেই বাসনা থেকে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা | কবিতা গুলির সংগ্রাহক শ্ৰীযুক্ত হরিহর শেঠ মহাশয় |
"প্রাচীন কলকাতা প্রবন্ধ' বইটিতে উনি কবিতাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন "ভারতবর্ষ" পত্রিকা থেকে |
পুরানো কলকাতার কবিতাগুলো ছিল একদম ভিন্ন ধরণের | একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় বেশিরভাগ কবিতা তখন লেখা সমাজে তৎকালীন জীবনযাত্রায় সচরাচর যা যা ঘটছে তারই প্রতিফলন |তার মধ্য থেকে আমার কিছু বিশেষভাবে ভালো লাগা কবিতা এখানে প্রকাশ করলাম |


প্রথমেই শুরু করি সেই সময়ের বিখ্যাত কবিয়াল 'ভোলা ময়রা কে দিয়ে | কারণ তখনকার দিনে পদ্যের মাধ্যমে কবির লড়াই ছিল খুব মজার | আসরে বসে তৎক্ষণাৎ ছড়া বাঁধা হতো ও দুই কবির লড়াই জমে উঠতো |এই ছড়াটি র রচয়িতা কবি ভোলা ময়রা স্বয়ং |এটি বাঁধা হয়েছিল সেকালের বড়লোকদের ধাজ ধারণা চেহারা প্রভৃতি  লক্ষ করে |
                  " আমি ময়রা ভোলা ভিয়াই খোলা বাগবাজারে রই  
                    নই কবি কালিদাস তবে খোশামুদের মাথা খাই |
                    বাবুতো লালাবাবু কোলকাতাতে বাড়ী
                   বেগুন পোড়ায় নুন দেয়না সে ব্যাটা তো হাঁড়ি |
                   পিঁপড়ে টিপে গুড় খায় সকতের মধু অলি
                   মাফ করো গো রায়বাবু দুটো সত্য কথা বলি |
                   মোষের মতো মুন্সিবাবু মসির মতো কালো
                   পান খেয়ে ঠোঁট রাঙায় চেহারাখানা ভালো |
                   পূর্বজন্মের পুণ্যফলে পান খেতে পাই
                   লক্ষীছাড়া বাসি মরা যার পানের কড়ি নাই |


পদ্যের  মাধ্যমে সহজ উপায়ে তখন বাচ্চাদের ইংরেজি শব্দ শেখানো হতো |
একটি নমুনা ------

"গড্ ঈশ্বর লর্ড ঈশ্বর কম মানে এস
ফাদার বাপ্ ,মাদার মা .সিট্ মানে বস |
ব্রাদার ভাই ,সিস্টার বোন , ফাদার সিস্টার পিসি ,
ফাদার-ইন-ল মানে শ্বশুর, মাদার সিস্টার মাসি |
আই মানে আমি আর ইউ মানে তুমি ,
আস মানে আমাদিগের , গ্রাউন্ড মানে জমি |
ডে মানে দিন আর নাইট মানে রাত .
উইক মানে সপ্তাহ ,রাইস মানে ভাত |
পম- কিম লাউকুমড়া কোকোম্বার শশা .
ব্রিনজেল বেগুন আর প্লোম্যান চাষা |



সেকালে গাঁজা খাওয়া খুব প্রবল ছিল |বিভিন্ন স্থানে স্থানে গাঁজা ,চণ্ডুর(একরকমের ঘরে বানানো মাদকীয় পানিও ) আড্ডা ছিল | এই ছড়াটি লেখা হয়েছিল এই ধরণের আড্ডা কে উদ্দেশ্য করে |


"  বাগবাজারে গাঁজা আর গুলি কোন্নগরে
  বটতলায় মদের আড্ডা চণ্ডুর বৌবাজারে  
  এই সব মহাতীর্থ যে না চোখে হেরে
  তার মতো মহাপাপী নাই ত্রিসংসারে " |


ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল |
তাকে উদ্দেশ্য করে কেও একজন এই ছড়াটি লিখেছিলেন ---


" হাতীপর হাওদা ,ঘোড়াপড় জীন
  জলদি যাও , জলদি যাও
  ওয়ারেন হেস্টিংস " |


ইংরেজদের কাছে বাঙালির লাঞ্ছনা দেখে কোনো এক অজানা কবি
এটা লিখেছিলেন ----


"তাঁতির শোভা তাঁতখানা
       দর্জির শোভা সুতো
বাঙালির শোভা বেত্রাঘাতে
       জুতো আর গুঁতো "|


সবশেষে ঈশ্বর গুপ্তের একটি লেখা দিয়ে শেষ করছি -----


"যত ছুড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে
এ বি শিখে,বিবি সেজে বিলাতি বোল কাটেই কবে
আর কিছুদিন থাকরে ভাই, পাবেই পাবে দেখতে পাবে
আপন হাতে বাগিয়ে বগি ,গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে "|


প্রত্যেক কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলি অত্যন্ত সহজ এবং ছন্দ ও অন্তমিল প্রশংসার দাবি রাখে |


সব পাঠককে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ   |


যাবার আগে শেষ কথাটি বলে যাই :-


দেখতে দেখতে বছর কেটে গেলো |জীবন থেকে  আরো একটি বছর চলে গেলো |মহাকালের স্রোত পেরিয়ে নতুন বছর আসতে চলেছে ২০১৭ | নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ঘন্টা ধ্বনি শুরু হয়ে গেছে |
কবিগুরুর ভাষায় বলি -----
"জগৎ জুড়ে উদার সূরে
আনন্দ গান বাজে "


সেই আনন্দ গান বেজে উঠুক আপনার মনে আমার মনে আসরের সব কবিদের মনে | বেজে উঠুক তা সবার চেতনার মাঝে এই শুভকামনা নিয়ে এ বছরের মতো শেষ লেখাটি লিখে বিদায় প্রার্থনা করছি আসরের অতি প্রিয় কবি বন্ধুদের কাছ থেকে | সবাই ভালো থাকুন সবাই সুস্থ থাকুন ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা