১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারবি থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থমালা সিরিজে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী র সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার বই বেরিয়েছিল । কোনোটা একশ' আট পাতা কোনোটা একশ' কুড়ি পাতার । ছ' টাকা ক'রে । চাকরিতে সবে ঢুকেছি । মাইনে তিন শ' দশ টাকা সত্তর পয়সা । তাও প্রবেশনারি পিরিওডে , পি এফ কাটা শুরু হয় নি । ভাবুন , সাকুল্যে হাতে কত আসতো পার্মানেন্ট হওয়ার পরে । কিন্তু তখন থেকেই গরিবের ঘোড়া রোগ । কবিতার ভুত ঘাড়ের উপর । কবিতার বই বেরুলেই কিনতে হবে । ছয় টাকা মাত্র তো তখন মাত্র কয় টাকা ছিলনা !! তবু সুনীল আমার কব্জায় এসে গেল ।
এ ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে গেলো খানিকটা ।আসল কথা যা বলতে চেয়ে শুরু করেছিলাম বেমালুম সব ভুলে অনেক দূরে সরে এসেছি । বলতে চেয়েছিলাম , বইটার ভূমিকার কয়েক টি কথা । যেখানে সুনীলের মত কবি ও বলছেন , " এখানে একটি কথা বলে রাখা আমার পক্ষে অত্যন্ত দরকারি , কোনো রচনাকে শ্রেষ্ঠ বলা তো দূরে থাক , আমি আমার কোনো রচনা কেই এ পর্যন্ত সার্থক বলে মনে করিনা ।এখনো কিছুই লেখা হয়নি । দৃষ্টিবিভ্রমের মতন মুহুর্মুহু সত্যভ্রম হয় , ভাষা কিংবা রূপ ও আলেয়ার মতন । যা লিখতে চাই , তা এখনো কিছুই লিখতে পারিনি । তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি , এই আর-কি !! "
মনে রাখবেন আরেক বার --কথা গুলো সুনীল গাঙ্গুলি বলছেন-- অন্য কেউ নয়--১৯৭০ সালের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় -- নীললোহিত !!
কিন্তু আমি আটকে গিয়েছিলাম অন্য জায়গায় । ভাবছিলাম সেদিন কার সেই বয়সের চিন্তা ধারায়-- যে কবিতা গুলোর সংকলন টা স্বয়ং কবি ই করেছিলেন , যিনি ততদিনে হঠাৎ নীরার জন্য বা শুধু কবিতার জন্য আফশোষ করেন এই ব'লে যে ' আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায় ' , যিনি মনে করতেন , নীরার অসুখ হলে কলকাতা বড় দুঃখে থাকে , যিনি মনে করতেন , যে হাত ছুঁয়েছিল নীরার মুখ সে আর কোন অপরাধ করতে পারে না , যিনি আথেন্স থেকে কায়রো যাওয়ার পথে বিমানের মধ্যে টাই খুলে ফেলে , সিট বেল্ট সরিয়ে চিৎকার করে বলেন 'আমি নিঃসংগ ভারতীয় , আমি সম্রাটের বিবাগী পুত্র সমস্ত পৃথিবীর উদ্দেশে এখন আমি তীব্র কন্ঠে বলতে চাই আমার খিদে পেয়েছে , আমার খিদে পেয়েছে , আমি আর সহ্য করতে পারছি না-- আমি কামড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে খাবার জন্য উদ্যত হয়েছি , কিংবা যিনি মনে করেন , চে , তোমার মৃত্যু আমায় অপরাধী করে দেয় , কিংবা ইন্দিরা গান্ধীকে উপদেশ দেন , প্রিয় ইন্দিরা , তুমি বিমানের জানালায় বসে গুজরাটের বন্যা দেখতে যেওনা ,বন্যার দৃশ্য দেখে ও একদিন তোমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে যেতে পারে , বাঃ কি সুন্দর ! কিংবা যিনি নিখিলেশের সঙ্গে জীবন বদল করে দেখেন যে কোনো লাভ হোলোনা অথবা বুঝতে শিখে গেছেন কেউ কথা রাখেনি , কেউ কথা রাখেনা , যিনি বলতে পারেন শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম , শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি -- সে ই তিনি কেন জ্বলন্ত জিরাফ দেখেন- কেন পেচ্ছাপ ও কান্নার সম্পর্ক নিয়ে বই লিখতে বসে যান ?
কেনইবা মহারাজ কে মনে করিয়ে দেবার দরকার পড়ে তিনি তাঁর বালক ভৃত্য কেন লিখতে হয় ' "তুমি খাও এঁটো থুতু , আমি তোমার রক্ত চাটি বিলিবিলি খাণ্ডাগুলু , বুম চাক ডবাং ডূলূ হুড়মুড় তা ধিন না উসুখুসু সাকিনা খিনা মহারাজ , মনে পড়েনা ?
আমি বুঝতে পারিনা , এই সবের মানে কি ? কেন সুনীলের শ্রেষ্ঠ কবিতার আসনে একসাথে এরা বসতে পেরেছে । তা ও আবার কবির নিজের বিচারে ই । আমি কবিতা বুঝিনা বুঝতে পারিনা কোনটা ভালো আর কোনটা ভালো নয় !! কোনটা শ্রেষ্ঠ আর কোনটা নিকৃষ্ট !!